মাটি খুঁড়ে তেল বার করতে গিয়ে বীভৎস অগ্নিকাণ্ডে শেষ হয়ে গেল এক বিশাল জলাবন। অসমের তিনসুকিয়ার মাগুরি বিল। গ্রাম ছেড়ে পালালেন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। পুড়ে খাক হয়ে গেল গাঙ্গেয় শুশুক, ঘরচ্যুত হল বুনো জলমহিষের দল, ছাই হয়ে গেল প্রচুর পাখির বাচ্চা।
অগভীর জলে মাগুর মাছের প্রাচুর্য থেকেই নাম ‘মাগুরি’। এক সময় এখানে ১১০ রকমের পাখি দেখা যেত, তাই এটি ‘ইম্পর্ট্যান্ট বার্ড এরিয়া’ (আইবিএ)। ৮৪টি প্রজাতির মিষ্টি জলের মাছও ছিল। এবং এই বিলের উপর নির্ভরশীল স্থানীয় মানুষ। অসমের ডিব্রু শইখোয়া থেকে অরুণাচল প্রদেশের নামদাফা পর্যন্ত এই অঞ্চলটায় বাদলা চিতা, প্যাঙ্গোলিন, এশিয়াটিক বুনো কুকুর, পিগ-টেলড বাঁদর, অসমিয়া বাঁদর প্রভৃতি বহু অতি-বিপন্ন প্রাণী পাওয়া যায়। সে কারণেই মাগুরি ‘ইকো সেন্সিটিভ জ়োন’। এখানে কী করে তেলের খনির ছাড়পত্র পেল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড? ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এক কিলোমিটারের মধ্যে ‘মাইনস অ্যান্ড মিনারেলস (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যাক্ট ১৯৫৭’-এ নথিভুক্ত খনির কাজ করা যাবে না। অয়েল ইন্ডিয়া জানাল, তারা অন্য আইনের আওতায় পড়ে: ‘অয়েল ফিল্ডস (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যাক্ট, ১৯৫৮’। সুপ্রিম কোর্টের রায় তাদের ক্ষেত্রে খাটে না।
২০১৬ ও ২০১৭ সালে তিন বার এই প্রকল্পের প্রভাব খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনার কথাও বলা হয়। অয়েল ইন্ডিয়ার বক্তব্য, ২০১২ থেকে ২০১৬ অবধি তারা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথোপকথন করতে চাইলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের স্বার্থে মানুষকে ভুল বোঝায়। এতে দেশেরই ক্ষতি, কারণ বাইরে থেকে তেল আমদানি অন্তত ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। অথচ তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দেশ প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা লোকসান করছে।
অনুমতি আসে তড়িঘড়ি। ‘ন্যাশনাল বোর্ড অব ওয়াইল্ডলাইফ’-এর স্ট্যান্ডিং কমিটির ছাড়পত্রও পেয়ে যায় অয়েল ইন্ডিয়া। অথচ ২০১৩ সালে তারা যখন অসমে বিনা অনুমতিতে তেল নিষ্কাশনের কাজ শুরু করে দিয়েছিল, তখন এই কমিটিই হাতেনাতে ধরেছিল। অসমের বন দফতরকে দশ বছর আর্থিক সহায়তা দেওয়াই ছিল আইন ভাঙার শাস্তি। কিন্তু সরকারকে টাকা দিয়ে পার পেয়ে যায় সংস্থা।
২০১৯-এ কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক জানিয়েছিল, জনশুনানি ছাড়া মাগুরিতে খননের অনুমতি মিলবে না। আবার তার পরেই ‘এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ (ইআইএ) সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের খনির প্রকল্প ‘বি২’ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেখানে জনশুনানির দরকার হয় না। ১১ মে পরিবেশ মন্ত্রকের কাছ থেকে অসমে আরও সাতটি তেলের খনি এবং ডিব্রু শইখোয়ার নীচে থাকা তেল নিষ্কাশনের অনুমতিও পায় অয়েল ইন্ডিয়া। সম্ভবত খুব হিসেব কষেই জনশুনানির কথা বলেছিল সরকার। কোন দিক থেকে কী বাধা আসছে, তা বুঝে নিতে পারলে তাকে পরাস্ত করার যুক্তি তৈরি করা যায়। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর অয়েল ইন্ডিয়া আশ্বাস দিয়েছিল যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে খননকাজ শুরু হবে, এবং মাটির নীেচর খনন পথ ব্যবহার করে তেল নিষ্কাশন করা হবে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ বললেন, এমন বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষমতা বিশ্বের কোনও তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস সংস্থার নেই! ২০০৫ সালে ডিব্রুগড় জেলায় তাদেরই পরিত্যক্ত তেলের খনিতে আগুন লাগে এবং বিস্ফোরণ হয়। পাঁচ হাজার গ্রামবাসীকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষায় বার বার ফেল করা এক সংস্থার উপর কিসের ভিত্তিতে আস্থা রাখছে সরকার? আর পরিবেশ মন্ত্রকের কাজ প্রকৃতি রক্ষা করা, তাকে বিপদে ফেলা তো নয়!।
বাঘজানের মানুষ ঘরছাড়া। তেল চিটচিটে হয়ে গিয়েছে তাঁদের চাষের জমি, চা বাগান। ৯ জুন সকাল সাড়ে ১০টায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল ১২ কিলোমিটার দূর থেকে। আজও আশেপাশের লোকালয়ে ছেয়ে আছে কালো বিষবাষ্প। তেল ভেসে এলাকাগুলির কী অবস্থা, তা জানা নেই।
আমাদের দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের আইন সারা বিশ্বে সমাদৃত। তাকে ধাপে ধাপে শিথিল করে ফেলা হচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে ঘোষিত হয়েছে ‘এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০২০’-র খসড়া। সংশোধনগুলি পাশ হয়ে গেলে বহু দূষণকারী কারখানার আর পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র লাগবে না। স্থানীয় মানুষের মত নেওয়ারও প্রয়োজন থাকবে না। তারা দূষণ করে পার পেয়ে যাবে, ধরা পড়লে অয়েল ইন্ডিয়ার মতো ব্যবস্থাও করে নেবে। সরকারি তত্ত্বাবধানও থাকবে না, নিজেরাই নিজেদের রিপোর্ট কার্ড তৈরি করবে। আর এমন ‘উন্নয়ন’ ক্রমাগত বিকলাঙ্গ করে দেবে ভারতের আত্মাকে।
দ্য ইউনিভার্সিটি অব ট্রান্সডিসিপ্লিনারি হেলথ সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি, বেঙ্গালুরু