আনন্দীবাই জোশী।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে তোলা এক ঐতিহাসিক ছবিতে ছিলেন তিন মহিলা— জাপানের কেই অকামি, সিরিয়ার তাবাত এম ইসলামবুলি ও ভারতের আনন্দীবাই গোপালজোশী। উদ্যাপনে উপস্থিত ছিলেন আর এক বিদুষী। তিনি ভারতীয় মেয়েটির দূর সম্পর্কের আত্মীয়া— যাঁকে বিশ্ব চিনবে পণ্ডিতা রমাবাই নামে। ছবির তিন জনই তাঁদের দেশ থেকে পশ্চিমে ডাক্তারি পড়তে আসা প্রথম মহিলা।
আনন্দীবাই জোশী। জন্ম ৩১ মার্চ ১৮৬৫ সালে, মহারাষ্ট্রের কল্যাণে। বাবা গণপতরাও জোশী ও মা গঙ্গাবাই ছিলেন স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী, তাই অল্প বয়সেই মরাঠি পড়তে শেখেন আনন্দীবাই ও অন্য বোনেরা— বাড়িতে আলাদা করে খোলা স্কুলে। কিন্তু অনটনের মুখে আনন্দীবাই-এর বিয়ে হয়ে যায় ডাকবিভাগের ক্লার্ক, বিপত্নীক গোপালরাও জোশীর সঙ্গে। স্ত্রীকে উচ্চশিক্ষিত করবেন, এই শর্তেই ৯ বছরের আনন্দীকে বিয়ে করতে রাজি হন ২৯ বছরের গোপালরাও। বিয়ের পর আনন্দীবাই-এর পড়াশোনার অভ্যাসে ছেদ পড়েনি, তবে ত্বরান্বিতও হয়নি। ১৪ বছর বয়সে, এক পুত্রসন্তানের মা হন। দশ দিন বয়সে মারা যায় সন্তান, প্রায় বিনা চিকিৎসায়।
তার পরই আনন্দীবাই ঠিক করেন, ডাক্তার হতে হবে। মহারাষ্ট্রের সেই গ্রামে যেখানে পুরুষ ডাক্তারই নেই, সেখানে মহিলা ডাক্তার? পুত্রশোকে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, ভাবলেন সকলে। ইংরেজি দূরে থাক, সংস্কৃত পর্যন্ত পড়তে পারেন না তিনি। কিন্তু আনন্দীবাই অনড়। কলকাতায় চলে আসেন আনন্দীবাই— মূলত ইংরেজি ভাষা পড়বেন বলে। সরকারি চাকরিতে বদলির ব্যবস্থা করে আসেন গোপালরাও-ও। স্বামী-স্ত্রী থাকতেন শ্রীরামপুরে।
বাংলায় থাকাকালীন ১৮৮০ সালে গোপালরাও জানতে পারেন স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী মার্কিন মিশনারি রেভারেন্ড ওয়াইল্ডারের কথা। গোপালরাও লম্বা চিঠিতে রেভারেন্ডকে লেখেন আনন্দীবাই-এর ডাক্তার হতে চাওয়া, কলকাতায় আসা, অধ্যয়নের বিষয়ে। স্ত্রীর শিক্ষার জন্য তিনিও আমেরিকায় যেতে পারেন, এ কথাও বলেন। চিঠি পড়ে রেভারেন্ড অবাক। প্রিন্সটন মিশনারি রিভিউ নামের পত্রিকায় চিঠিটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন, ব্যক্তিগত ভাবে উত্তরও দেন।
পরের ঘটনা প্রায় অবিশ্বাস্য। থিয়োডিসিয়া কার্পেন্টার নামের এক মহিলা, ডেন্টিস্টের চেম্বারে হঠাৎই দেখতে পান খবরটি। পত্রালাপ করেন আনন্দীবাই-এর সঙ্গে। ‘আন্ট’ থিয়োডিসিয়া-ই চিঠিতে জানান থোরবোর্ন নামের ডাক্তার দম্পতির কথা, যাঁরা আমেরিকায় আনন্দীবাই-এর ডাক্তারি পড়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। আরও জানান, তাঁদের চেনা দু’জন মিশনারি ভারত থেকে জাহাজে আমেরিকায় আসছেন, আনন্দীবাই চাইলে তাঁদের সঙ্গে চলে আসতে পারেন। ১৮৮৩ সালে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে থিয়োডিসিয়ার চিঠির ভরসায় একা আমেরিকা পাড়ি দেন আনন্দী। হিন্দু ব্রাহ্মণ মহিলা, ছোঁয়াছুঁয়ি-খাওয়ার সমস্যায় ভুগতেন। শেষে এই সমস্যা খুব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর প্রবাসী জীবনে।
আমেরিকায় থিয়োডিসিয়ার কাছে রোসেল-এ ওঠেন তিনি। থোরবোর্ন দম্পতির সহায়তায় পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিতে ভর্তি হন এবং প্রত্যেকটি ধাপে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এর পর ১৮৮৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি এবং সেই ঐতিহাসিক ছবি।
আশ্চর্য সমাপতন, প্রায় এই সময়ই কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। দুই দেশের শিক্ষাবর্ষের পার্থক্যের কারণে মাত্র কয়েক মাস আগে আনন্দীবাই জোশী, ১১ মার্চে, কয়েক মাস পরে কাদম্বিনী। বছরটা একই, ১৮৮৬।
একই বিন্দু থেকে আনন্দী আর কাদম্বিনীর জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নেয়। ১৮৮৮ সালে লেডি ডাফরিন কলেজে কাজ শুরু করবেন কাদম্বিনী, হয়ে উঠবেন ভারতের প্রথম প্র্যাক্টিসিং মহিলা ডাক্তার। ১৮৯৩ সালে পাড়ি দেবেন বিদেশেও, উচ্চশিক্ষার জন্য। আর আনন্দীবাই? যিনি চোদ্দো বছর বয়সে মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে ঠিক করেছিলেন ডাক্তার হবেন এবং সাত বছরের মধ্যে তা বাস্তবায়িত করলেন— কেমন হল তাঁর যাত্রাপথ?
১৮৮৭ সালে দেশে ফেরেন আনন্দীবাই। কোলাপুরের রাজা বিশেষ সংবর্ধনার সঙ্গে অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের দায়িত্ব তুলে দেন তাঁর হাতে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রবাসে থাকাকালীন প্রতিকূল আবহাওয়া ও খাদ্যাভ্যাস সহ্য হয়নি আনন্দীর। যক্ষ্মা বাসা বেঁধেছিল শরীরে। ১৮৮৭ সালে, ২৬ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ২১ বছর বয়সে মারা যান আনন্দীবাই।
স্বল্প পরিসরের জ্যোতিষ্কজীবনটি নিয়ে মরাঠি চলচ্চিত্র, দূরদর্শনের ধারাবাহিক ইত্যাদি কিছু আখ্যান মেলে। বিদেশে তাঁর জীবনী লিখেছিলেন ক্যারোলিন হিলি ডাল। মরাঠিতে জীবনী লেখেন কাশীবাই কান্তিকর, উপন্যাস লেখেন শ্রীকৃষ্ণ জোশী। তাঁর নামে শুক্র গ্রহের এক জ্বালামুখের নামকরণ হয় ‘জোশী’। তবুও, ২০১৯ সালে তাঁর জীবন অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে পরিচালকের খেদ— কত কম গবেষণা, কত কম তথ্য তাঁর জীবনী নিয়ে!
কে প্রথম স্নাতক হয়েছিলেন— কাদম্বিনী না চন্দ্রমুখী, কে প্রথম মহিলা ডাক্তার— আনন্দীবাই না কাদম্বিনী, শেষ পর্যন্ত হয়তো তা জরুরি কথা নয়। এ এক এমন সময় যখন এঁদের সবাইকে বেশি মনে করার আর মনে পড়ার কথা। এ হল সম্মান, উদ্যাপন এবং মানবী ইতিহাসের অভিমানের প্রশ্ন।