দলিত ছেলে বিয়ে করলে

প্রশ্নটা জাতিগৌরবের, বললেন সমাজতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর গুপ্ত

এখন যে হেতু অনেকগুলো কারণে সেই পরিস্থিতি বদলেছে, দলিতদেরও এক ধরনের ক্ষমতায়ন হয়েছে, ফলে এই কথাগুলো আগের চেয়ে বেশি প্রকাশ্যে আসছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৯ ০০:০৪
Share:

প্রশ্ন: উচ্চবর্ণের মেয়ে তথাকথিত নিম্নবর্ণের কোনও ছেলেকে বিয়ে করলে মেয়ের বাড়ি থেকে হরেক রকম ঝামেলা বাঁধাবে, এমনকি খুনোখুনি অবধি গড়াতে পারে ঘটনা— এটা ভারতে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হামলা করছে মেয়ের উচ্চবর্ণ পরিবারটি। এটা কি দলিত-বিদ্বেষের প্রকাশ?

Advertisement

দীপঙ্কর গুপ্ত: এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হবে। সৃষ্টিকর্তার মাথা থেকে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি, ঘাড় থেকে ক্ষত্রিয়ের, উরু থেকে বৈশ্যের আর পা থেকে শূদ্রের— এই আখ্যানটা সম্ভবত শুনেছেন। কিন্তু, এটাই একমাত্র আখ্যান নয়। এটা শুধু ব্রাহ্মণদের আখ্যান। তথাকথিত নিম্নবর্ণের প্রতিটি জাতের এ রকম আখ্যান রয়েছে— আমরা বলব মিথ বা গল্পকথা, ওঁরা বলবেন সত্য ঘটনা— কিন্তু আসল কথা হল, প্রতিটি জাতির এই অরিজিন-মিথ বা সৃষ্টি-আখ্যানে সেই জাতিটি শ্রেষ্ঠ। যে জাতি সামাজিক কাঠামোয় সবচেয়ে নিচুতলায় থাকতে বাধ্য হয়, নিজেদের আখ্যানে তারাও শ্রেষ্ঠ। কোনও তথাকথিত নিম্নবর্ণই নিজেদের নিচু, অশুদ্ধ মনে করে না। কখনও তাঁরা জানান যে তাঁরা ব্রাহ্মণ ছিলেন, কখনও কোনও দেবতার সন্তান ছিলেন, চাঁদ-সূর্যের সন্তান ছিলেন। আমার কাছেই বহু অরিজিন-মিথ সংগৃহীত আছে। হান্টারের মতো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আধিকারিকরাও এই গল্পগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। আখ্যানের শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে বাস্তবের দুরবস্থার সূত্র বাঁধা আছে কোনও অভিশাপ বা বিশ্বাসঘাতকতার গল্পে। এই আদি-গৌরব জাতিগুলোর কাছে আত্মপরিচয়ের একটা জরুরি অংশ। কাজেই, তথাকথিত নিচু জাতের ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে হলে ব্রাহ্মণ বাবা যেমন অসন্তুষ্ট হন, তেমনই অসন্তুষ্ট হন সেই দলিত বাবাও। কারণ, ভিন্জাতে বিয়ে করা মানেই নিজের জাতের শ্রেষ্ঠত্ব বিসর্জন দেওয়া। যত দিন অবধি জাতিব্যবস্থাই সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থির করে দিত, দলিতরা এই কথাগুলো প্রকাশ্যে বলতেন না। এই জাতি-গৌরবের গল্পগুলো সম্প্রদায়ের মধ্যেই মুখে মুখে ফিরত। এখন যে হেতু অনেকগুলো কারণে সেই পরিস্থিতি বদলেছে, দলিতদেরও এক ধরনের ক্ষমতায়ন হয়েছে, ফলে এই কথাগুলো আগের চেয়ে বেশি প্রকাশ্যে আসছে।

তা হলে, আক্রমণকারীর ভূমিকায় দলিতদের দেখি না কেন, কেন শুধুই উচ্চবর্ণের পরিবারকে দেখি? তার কারণটা জাতির দাবি অনুযায়ী বোঝা যাবে না। উচ্চবর্ণের পরিবার অধিকাংশ সময়েই বেশি অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তির অধিকারী। তাদের হাতে পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে, ক্ষমতাশালী বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের রাগ হলে তারা সেই রাগ ফলাতে পারে। বহু দলিত পরিবারেই রাগ হজম করে ফেলা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। দলিত ছেলে একটা উচ্চবর্ণের মেয়েকে বিয়ে করলে কিন্তু সেটা দলিতদের কাছে, নিদেনপক্ষে সেই পরিবারের কাছেও, সামাজিক উত্তরণের ঘটনা নয়। কারণ, জাতিগত ভাবে তারা উচ্চবর্ণকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখে। কিছু বছর আগে উত্তরপ্রদেশে একটা ঘটনা ঘটেছিল। এক দলিত পরিবার মেয়ের বিয়ের দিন জানতে পারে যে পাত্রটি দলিত নয়, জাঠ। উত্তরপ্রদেশে জাঠরা কিন্তু অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী। এই দলিত পরিবারের লোকরা রেগে গিয়ে বিয়ের ঘটককে প্রবল প্রহার করল!

Advertisement

প্র: আপনি বলছেন যে দলিতদের মধ্যেও উচ্চবর্ণের প্রতি সমান বিদ্বেষ বা ঘৃণা রয়েছে?

উ: শুধু উচ্চবর্ণের প্রতিই নয়। অন্য নিম্নবর্ণের প্রতিও রয়েছে। কারণ, প্রত্যেকটা জাতিই মনে করে যে আমরা শ্রেষ্ঠ— কোনও ঐতিহাসিক অবিচারের ফলে খারাপ অবস্থায় আছি, এইমাত্র। ফলে, অন্য কোনও জাতে বিয়ে করার অর্থই হল সেই শ্রেষ্ঠত্ব থেকে চ্যুত হওয়া। বস্তুত, ব্রাহ্মণরা যে জাতিশ্রেষ্ঠ, এই বিশ্বাসটা নিতান্তই ব্রাহ্মণদের। আপনি বিহারের কোনও গ্রামে যান, যাদবদের সঙ্গে কথা বলুন, দেখবেন তাঁরা ব্রাহ্মণদের বড় জোর সবচেয়ে ওপরের সার্ভিস ক্লাস বলে মানতে পারেন— মুচি বা নাপিতদের থেকে ওপরে। কিন্তু তাঁদের পরিবারের কোনও ছেলে বা মেয়ে ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ে করতে চাইলে যথেষ্ট আপত্তি হবে। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তো উচ্চাবচতা আছে। গুজরাতের অনাভিল বা বিহারের ঝা-দের মতো জমিদার ব্রাহ্মণরা পূজারি ব্রাহ্মণের বাড়িতে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। আবার, জমিদার বাড়ির পূজারি ব্রাহ্মণরা ভাবেন যে মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণের চেয়ে তাঁদের অবস্থান ওপরে। সেখানেও বৈবাহিক সম্পর্কে আপত্তি উঠবে। মোট কথা, কোনও জাতিই মানতে রাজি নয় যে জাতি হিসেবে তারা কারও থেকে ছোট।

আসল গল্পটা ক্ষমতার। যে যেখানে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষমতাবান, সে সেখানে এক নম্বর। তার পর কে দুই, কে তিন, আর কে সবার শেষে, সেটাও ঠিক করত তারাই। অন্যরা যে সেটা মানত, তা নয়। কিন্তু ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলার জোর না থাকায় মেনে নিতে হত। রাজস্থানে এক সময় জাঠদের সামাজিক অবস্থান রাজপুতদের চেয়ে নীচে ছিল। ১৯৫০-এর দশকে এক জাঠ যুবক রাজপুতদের মতো ঘোড়ায় চেপে, ব্যান্ড বাজিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছিল বলে রাজপুতরা তাকে বেধড়ক পেটায়। আজ রাজস্থানে কোনও রাজপুতের সেই সাহস হবে না। জাঠদের প্রচুর জমিজায়গা, টাকা হয়েছে। রাজপুতদের আবার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। কিন্তু, এই কিছু দিন আগেই ঘোড়ায় চড়ার জন্যই এক দলিত যুবককে পিটিয়ে মারা হল রাজস্থানে। ক্ষমতাই ঠিক করে দেয়, কে কত নম্বরে থাকবে।

প্র: এই ক্ষমতার গল্পে পুরুষতন্ত্রের ভূমিকাও আছে?

উ: অবশ্যই। অনুলোম আর প্রতিলোম বিবাহের ধারণাটাই তো পুরুষতন্ত্রের। মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্কস্মৃতি, সর্বত্র রয়েছে এই ধারণা। কোনও নিম্নবর্ণের ছেলে যদি কোনও উচ্চবর্ণের মেয়েকে বিয়ে করে, সেটা প্রতিলোম বিবাহ। ছেলে উচ্চবর্ণের আর মেয়ে নিম্নবর্ণের, এটা যদিও বা সহ্য করা যায়, নিম্নবর্ণের ছেলে উচ্চবর্ণের মেয়েকে বিয়ে করছে, এটা উচ্চবর্ণের কাছে সামাজিক ভাবে অসহ্য। কারণটা সহজ— সামাজিক ভাবে পুরুষ নারীর ওপরে, ফলে বিবাহের সময়ও এই নিয়ম ভাঙা চলবে না। তবে, শুধু পুরুষতন্ত্র নয়, তার সঙ্গে ক্ষমতারও প্রশ্ন আছে। আমি যতই প্যাট্রিয়ার্ক হই, আমার যদি যথেষ্ট আর্থিক প্রতিপত্তি না থাকে, ক্ষমতা না থাকে, তা হলে রাগ হজম করে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

প্র: নেহরু-পর্বের ভারতে ভিন্‌জাতের বিবাহ সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার একটা রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা ছিল। তবুও এই ধরনের বিয়ে মান্য হল না কেন?

উ: অম্বেডকর ভেবেছিলেন, এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির বিয়ে হলেও জাতিভেদপ্রথা ভেঙে পড়বে। ভেবে দেখুন, জাতিভেদপ্রথার যে স্তম্ভগুলো ছিল— জল না ছোঁয়া, একসঙ্গে না খাওয়া, কাজের বিভাজন— সবই কিন্তু কার্যত লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। পড়ে আছে শুধু বিয়ের প্রশ্নটা। আমার ধারণা, নগরায়ন যত বাড়বে, ভিন্জাতে বিয়ে করার প্রবণতাও ততই বাড়বে। কারণ, শহরের মা-বাবাদের পক্ষে সন্তানকে আড়াল করে রাখা অনেক বেশি কঠিন। আর একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন— জাতিপ্রথা জিনিসটা কিন্তু কার্যত লুপ্তই হয়ে গিয়েছে। এখন যেটা পড়ে আছে, সেটা হল কাস্ট আইডেন্টিটি— জাতি পরিচিতি। একটা জাতিভিত্তিক অস্মিতা। বিয়ের প্রশ্নটা আটকাচ্ছে এখানেই। মেয়েরা কিছু করলে পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়। কারণ, পরিবারের শুদ্ধতা, পবিত্রতা সব কিছু রক্ষার দায় পুরুষতন্ত্র মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে রেখেছে। প্রসঙ্গত, বাংলায় ‘মাদার কাল্ট’-এর সূচনাও এই জায়গা থেকেই। পুরুষরা বাইরে যাবে, ইংরেজদের সঙ্গে কাজ করবে, কিন্তু মেয়েরা বাড়িতে থাকে, তাই শুদ্ধ, আর সেই শুদ্ধতা রক্ষার দায়ও তাদেরই। মেয়ে নিচু জাতে, অথবা ভিন্জাতে, বা অন্য ধর্মে, বিয়ে করলে সেই শুদ্ধতায় আঘাত লাগে। আমার ধারণা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এবং নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে, এটা কমবে।

সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement