প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস অতিমারি যে সঙ্কটসাগরে ফেলিয়াছে, তাহার কূল দেখা যাইতেছে না। তাহারই মধ্যে এ রাজ্যে বাজিয়া উঠিল আর এক বিপদসঙ্কেত— আসিতেছে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক রোগ, বৈশাখের বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে। অজানা মহামারির সহিত পরিচিত মহামারি যোগ হইলে কী হইতে পারে, ভাবিলেও শিহরিয়া উঠিতে হয়। অথচ তাহাই প্রত্যাশিত, বলিয়াছেন বিশেষজ্ঞেরা। ডেঙ্গি এ রাজ্যে কতটা বিস্তার লাভ করিতে পারে, কী প্রকার মারণরূপ লইতে পারে, তাহা রাজ্যবাসী দেখিয়াছেন। স্বীকার করিতেই হইবে যে, বর্ষার সহিত পতঙ্গবাহিত রোগগুলির আবির্ভাব, এবং তাহার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত হইবার পরেও এ রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তাহার মোকাবিলায় যথেষ্ট সাফল্য লাভ করে নাই। মশা বংশবৃদ্ধি করিয়াছে, রোগের প্রকোপে হাসপাতালে রোগী উপচাইয়া পড়িয়াছে, অতি-আক্রান্ত এলাকা হইতে মানুষ ঘর ছাড়িয়াছে, মৃত্যুর সংখ্যাও ভয়প্রদ। প্রতি বৎসরেই এই সঙ্কটের সম্মুখে দাঁড়াইয়া অঙ্গীকার করা হইয়াছে যে, অতঃপর আরও আটঘাট বাঁধিয়া মশকনিয়ন্ত্রণ হইবে। এ বৎসর করোনাভাইরাস সেই আগাম প্রস্তুতির পরিকল্পনায় আঘাত করিয়াছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা-জ্বরে আক্রান্তদের সংবাদ লইতে ব্যস্ত, পুরসভাগুলিও আক্রান্তদের চিকিৎসা এবং কর্মহীন, গৃহহীন মানুষদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করিতে সকল শক্তি প্রয়োগ করিতেছে। এই অবসরে মশারা বংশবৃদ্ধি করিতেছে। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করিয়াছেন যে গত শীতে এডিস মশারা যে সকল ডিম পাড়িয়াছিল, সেগুলিতেও অকালবর্ষণের জলের স্পর্শে প্রাণের স্পন্দন হইবে, এবং সেই সকল নূতন মশা ডেঙ্গিবাহী হইতে পারে। অতএব অপেক্ষার অবকাশ নাই। করোনার অতিমারি চলিতে চলিতেই ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের কাজে নামিতে হইবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তারা ভারত-সহ ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশগুলিকে বহু পূর্বেই সতর্ক করিয়াছেন যে, করোনার অতিমারি চলিতে চলিতেই ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের কাজ চালাইতে হইবে। নচেৎ ফল হইবে ভয়ঙ্কর। করোনা-আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিয়োজিত, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেরা আক্রান্ত হইয়া দীর্ঘ দিন কর্মক্ষেত্র হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিতেছেন। এই সময়ে অপরাপর রোগ প্রবল হইয়া উঠিলে সেই সকল রোগীর চিকিৎসা ও পরিচর্যা প্রায় অসম্ভব হইয়া উঠিবে। অতিমারি এড়াইবার জন্য যে লকডাউন চলিতেছে, তাহাও ঔষধ প্রভৃতি পৌঁছাইবার কাজ দুরূহ করিয়া তুলিবে। পতঙ্গবাহিত রোগগুলি সকল বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করিতে পারে। অতএব মশা নিয়ন্ত্রণ, পুরসভার ওয়ার্ডগুলিতে রক্তপরীক্ষার আয়োজন, সকল ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে আগাম প্রস্তুত করিতে হইবে। রোগের প্রাদুর্ভাব পর্যন্ত অপেক্ষা করিলে তাহার পরিণাম হইবে মারাত্মক।
আপৎকাল হইতেও শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে সেই শিক্ষা এই যে, জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট মোকাবিলার ব্যবস্থাটি তখনই কার্যকর হইবে, যদি সম্বৎসর তাহা সক্রিয় থাকে। পুরসভা ও ব্লকস্তরে যথেষ্ট জনস্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন, তাঁহাদের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম প্রয়োজন, সকল সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয়ও প্রয়োজন, যাহাতে তৃণমূল স্তরে কর্মীরা সকল সংক্রামক রোগের উপর নিয়মিত নজরদারি করিতে পারেন। এমন একটি ব্যবস্থার অভাবে প্রসূতি ও শিশুস্বাস্থ্যের সুরক্ষার কাজ হইতে সরাইয়া কর্মীদের করোনা প্রতিরোধের কাজে পাঠাইতে হয়। করোনার রোগী খুঁজিতে গিয়া মশার লার্ভা খুঁজিতে বিলম্ব হয়। দূষিত পানীয় জল হইতে অসুখ ছড়াইবার সম্ভাবনা উপেক্ষিত হয়। নিত্যনূতন সঙ্কটের মোকাবিলায় এক একটি চটজলদি ব্যবস্থা খাড়া না করিয়া, একটি সুসংহত ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এমন পরামর্শই দিয়া থাকেন। কথাটি শুনিবার সময় আসিয়াছে।