—ফাইল চিত্র
যুদ্ধের আগে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনের একটি রীতি ছিল। অমিত শাহের এই বারের সফরটি ছিল পরিদর্শনের সফর। তিনি পশ্চিমবঙ্গ দেখিয়া গেলেন। তাঁহাকেও পশ্চিমবঙ্গ দেখিল, আর এক বার। এই রাজ্য তাঁহার মুখে যাহা শুনিল, তাহার অধিকাংশ কথাই জনমনোরঞ্জনের তাগিদে তাৎক্ষণিকতার সৌরভে মণ্ডিত, অনুভবের গভীরতার স্পর্শবর্জিত। কিন্তু তাহাতে কিছু আসে যায় না। রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা অধিকাংশ সময়েই মনোরঞ্জনী কথা বলিয়া থাকেন, তাহাই তাঁহাদের কাজ: ইহা এত দিনে সকল ভারতীয় নাগরিক বুঝিয়া লইয়াছেন। ভোটের বাজনা বাজিলে সে-সব কথার তোড় ও প্রতিশ্রুতি প্লাবন সজোরে বহিতে থাকে, তাহাও জানিয়াছেন। সুতরাং তাৎক্ষণিকতা সমস্যা নহে। সমস্যা হইল, বিশ্বাসযোগ্যতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহ যে কেরিয়ার-রেখচিত্র তৈরি করিয়াছেন, তাহাতে আজ তাঁহার মুখে ‘হিংসার জবাব হিংসা দিয়া হয় না’ জাতীয় কথা বড় বেমানান। কাশ্মীর হইতে কর্নাটক কিংবা শাহিনবাগ হইতে অসম বিষয়ে তাঁহার মনোভাবটি ভাবিয়া শ্রোতৃ-সমাজ শিহরিয়া উঠে। বরং তিনি বলিতে পারেন, যেন তেন প্রকারেণ বাংলাকে তাঁহার চাই, তিনি সেই পরিকল্পনার রূপায়ণে মগ্ন। তাহা একটি আন্তরিক কথা হইত, বাস্তবসম্মতও হইত। কে না জানে, নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বময় মুখ হইতে পারেন, কিন্তু শাসক দলের হস্তপদমস্তক অনেকাংশেই অমিত শাহ স্বয়ং। নির্বাচনের কারিগর হিসাবেও তিনি বার বার সফলকাম, দোর্দণ্ডপ্রতাপ।
অমিত শাহ মন্তব্য করিয়াছেন, কে পি নড্ডার যাত্রাপথে যে কাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহা ‘গণতন্ত্রের উপরে হামলা’। সত্য কথা। যে বা যাহারাই এই হামলা ঘটাইয়া থাকুক, ইহা গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ নহে। তবে কে কী অভিযোগ তুলিতেছেন, তাহাও বিচার্য বইকি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিশ্চয় গণতন্ত্রের উপর হামলার অন্যান্য নজিরও জানা আছে, যেখানে সরকারের কাজের সমালোচনা করায় সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ শানানো হয়, পুলিশ ডায়রি করা কিংবা মামলা ঠোকা হয়, এমনকি সোজাসুজি গ্রেফতার করা হয়। সদ্য-পাশ-হওয়া আইনের বিরোধিতায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান বা আন্দোলনে সরাসরি দমন আরম্ভ হয়। কিংবা মাসের পর মাস বিরোধী নেতাদের গৃহবন্দি রাখিয়া কোনও রাজ্যে কেন্দ্রীয় আইনের ন্যায্যতা দিবার ব্যবস্থা হয়। কিংবা নাগরিক অধিকার পদদলিত করিয়া বয়ঃপ্রাপ্ত যবক-যুবতীকে ‘লাভ জিহাদ’-এর অভিযোগে হেনস্থা করা হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁহার সরকারের বিরুদ্ধে বিস্তর সমালোচনা সম্ভব, তাহা জরুরি সমালোচনাও বটে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার গত কয়েক বৎসরে যে অপশাসন ও অগণতন্ত্রের নজির তৈরি করিয়াছে, তাহাতে আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজ্য সরকারের সমালোচনার ভিন্ন কোনও পথ লইলেই তাহা সহনীয়।
ভোটের পরই নাগরিকত্ব (সংশোধিত) আইন কার্যকর করিবার বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়া গেলেন, তাহাও বিপজ্জনক। স্পষ্টত সাম্প্রদায়িক এই আইনটিতে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলমান মিশ্রিত সমাজ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইবার সম্ভাবনা। তদুপরি দলিত গোষ্ঠীগুলিকে কাছে টানিতে নাগরিকত্বের টোপের ব্যবহারও আশঙ্কাজনক। মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশ জানাইয়াছেন, এই আইন কার্যকর হইলে তাঁহারা বিপন্নতর হইবেন। ঘটনা হইল, বিজেপির দল ভাঙিয়া দল গড়া বিবমিষা-উদ্রেককারী হইলেও অনস্বীকার্য, তৃণমূল কংগ্রেসও একদা এই ভাঙা পথের রাঙা পথিক ছিল। নির্বাচনী রাজনীতির বহু কুপথই ইতিমধ্যে পরিচিত, এবং/অগত্যা স্বীকৃত। কিন্তু রাজ্যবাসীর স্বার্থে, তুলনায় অপরিচিত এই সংগঠিত অসত্যভাষণ ও বিভ্রান্তি-প্রচার বন্ধ হওয়া জরুরি। নাগরিককে ভুল বুঝাইব, এবং পাত্র-মিত্র-অমাত্য দিয়া সমাজমাধ্যমে মিথ্যাকে সত্য করিয়া দিব: এই কর্মপদ্ধতি রাজনীতির সর্বনাশ করিতেছে, সমাজের ভয়ঙ্কর বিপদ আনিতেছে।