পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তুলিতেছেন যাঁহারা, তাঁহারা ‘রাজনৈতিক নেতা’, স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন অমিত শাহ। একই সঙ্গে এই কথাটিও স্মরণে রাখিয়াছেন হয়তো যে, তিনি নিজে কিন্তু রাজনৈতিক নেতামাত্র নহেন, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁহার কথার ওজন, পদাধিকারবলেই, বিপুল। বাংলার বিজেপি নেতাদের রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করিবার দাবিটিকে মুক্তকণ্ঠে ‘ন্যায্য’ বলিবার পূর্বে তাঁহার নিজ পদের গুরুত্বের কথাটি ভাবা উচিত ছিল। ঘটনা হইল, ভারতের ইতিহাস বলিতেছে, রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করিবার দাবি বিরোধীরা করিয়াই থাকেন— এখন বাবুল সুপ্রিয়েরা করিতেছেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরাও করিতেন। এই দাবিটি রাজনৈতিক বুলির মধ্যে পড়ে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও সেই ইঙ্গিত করিয়াছেন। একদা ভারতীয় রাজনীতিতে এই কু-অভ্যাসটি বেশ শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছিল। ১৯৬৬ হইতে ১৯৭৭ সালের মধ্যে ইন্দিরা গাঁধী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় চল্লিশ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করিয়াছিলেন। জরুরি অবস্থার পর গঠিত জনতা সরকারও পূর্বসূরির অভ্যাসটি বজায় রাখিয়াছিল— বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসি সরকারকে ফেলিতে তিন বৎসরে নয় বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। তাহা গণতন্ত্রের সুদিন ছিল না। সেই কার্যক্রমের ফলও ভাল হয় নাই, দলের পক্ষেও নয়, দেশের পক্ষেও নয়। অমিত শাহ তাঁহার দলীয় কর্মীদের দাবিটিকে ন্যায্য আখ্যা দেওয়ার সময় এই ইতিহাস স্মরণে রাখিয়াছেন নিশ্চয়!
সংবিধানের ৩৫৬ ধারা— যাহার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করিতে পারে— প্রসঙ্গে ভীমরাও অম্বেডকর বলিয়াছিলেন, তাঁহার আশা, ধারাটি সংবিধানে ‘ডেড লেটার’ হইয়াই থাকিবে। নিতান্ত অপরিহার্য না হইলে তাহা প্রয়োগ করা হইবে না। সংবিধান প্রণেতাদের আরও অনেক সদিচ্ছার ন্যায় ইহাও রাজনীতির ঘোলাজলে হারাইয়া গিয়াছিল। তবে, ১৯৯৪ সালে এস আর বোম্মাই বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় এই প্রবণতাটিকে অত্যন্ত জরুরি রাশ পরাইয়াছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয় জানেন, পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করিতে হইলে এস আর বোম্মাই মামলার নির্দেশিকা অনুসরণ করিয়াই তাহা করিতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় রাজ্যে, যেখানে সরকারপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রশ্নাতীত, সেখানে সরকার ফেলিতে হইলে দেখাইতে হইবে, রাজ্যে শুধু প্রশাসনিক কাঠামোই নহে, সাংবিধানিক কাঠামো ভাঙিয়া পড়িয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, যে রাজ্যে ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে কোনও নাগরিকের জীবনের অধিকার রক্ষায় রাজ্য সরকার দৃশ্যত অনিচ্ছুক, সেই রাজ্যে সাংবিধানিক কাঠামো বিঘ্নিত। এহেন রাজ্যের খোঁজ করিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী— পশ্চিমবঙ্গ নয়— উত্তরপ্রদেশ নামক রাজ্যটির সন্ধান পাইবেন।
পশ্চিমবঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করিবে কেন্দ্রীয় সরকার— যুক্তি বলিতেছে, তেমন সম্ভাবনা প্রবল নহে। তাহার একটি কারণ, এই সিদ্ধান্তটি বিচারবিভাগের বিবেচনার অতীত নহে, ফলে আদালতে সিদ্ধান্তটি টিকিবে কি না, সেই সংশয় আছে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন সমাসন্ন। নির্বাচিত সরকার ফেলিয়া দিলে জনমত কোন দিকে ধাবিত হইবে, সেই প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। তবুও আশঙ্কা থাকিয়া যায়। প্রথমত, যেন তেন প্রকারেণ রাজ্যের ক্ষমতা দখল করিবার যে প্রবৃত্তি বিজেপি গত ছয় বৎসরে দেখাইয়াছে, তাহা ভয়ঙ্কর। দ্বিতীয়ত, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি বিজেপি নেতাদের শ্রদ্ধা অতি ক্ষীণ— জিএসটি কাউন্সিলে নিয়ত তাহার প্রমাণ মিলিতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ার কতখানি, সেই লক্ষ্মণরেখাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা মানেন কি না, সংশয় থাকা স্বাভাবিক। তবে লক্ষ্মণরেখা অতিক্রমের ফল যে ভাল হয় না, রামভক্ত রাজনীতি তাহা জানে নিশ্চয়।