বে-এক্তিয়ার

জওহরলাল নেহরুর প্রসঙ্গ উত্থাপন আকস্মিক বা অকারণ নহে। ভারতীয় গণতন্ত্রের রূপটি যে এখনও পরিপূর্ণ সংসদীয়, তাহা যে সেনা-শাসিত স্বৈরতন্ত্র নহে, কিংবা সেনা-অধীন নামমাত্র গণতন্ত্রও নহে— তাহার কারণ স্বাধীনতার পরই প্রথম প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়ত।

সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত বৃহস্পতিবার যে মন্তব্য করিয়াছেন, তাহাতে এই দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত, স্পষ্ট এবং সপাট। সেই প্রতিক্রিয়া হইল— জেনারেল রাওয়াত অনধিকার চর্চা বন্ধ করুন। কোনটি ঠিক নেতৃত্ব, কোনটি ভুল, প্রতিবাদ কেমন হওয়া উচিত, কেমন নহে, ইহার কোনও কিছুই তাঁহার মুখ হইতে শুনিতে এই দেশ রাজি নহে, কেননা এখনও তাহার কপালে গণতন্ত্রের অক্ষয়টিকা। স্বাধীনতার পর এখনও পর্যন্ত কোনও ক্ষমতাসীন সেনাপ্রধান এই ভাবে নিজের অধিকারের গণ্ডি পার হন নাই, এমন প্রকট রাজনৈতিক মন্তব্য করেন নাই। এই স্পর্ধা কেবল উপেক্ষণীয় নহে, চূড়ান্ত অনৈতিক, এবং প্রবল প্রতিবাদযোগ্য। জেনারেল রাওয়াত সম্ভবত ভুলিয়া যাইতেছেন যে তিনি সেনাপ্রধান হইতে পারেন, কিন্তু সেনাবাহিনী ভারতীয় গণতন্ত্রের এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাহা দেশের জন্ম-ইস্তক রাজনৈতিক অধিকার-বিহীন। সেনা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান— সরকারের সম্পত্তি নহে, এবং সেই কারণেই কোনও রাজনৈতিক দল বা মত বা সংগঠন বিষয়ে তাঁহারা মন্তব্য করিতে পারেন না। কাজটি কিছু কঠিনও নহে। রাওয়াতের পূর্বে আরও বহু সেনাপ্রধান আসিয়াছেন-গিয়াছেন, তাঁহারা যে ভাবে অধিকারের সীমা মানিয়া চলিয়াছেন, রাওয়াত মহাশয়ও তেমনটাই করিবেন— ইহাই গণতান্ত্রিক সমাজের বক্তব্য। এই বিষয়ে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। ভারতের প্রথম আর্মি চিফ ফিল্ড মার্শাল কারিয়াপ্পা এক বার বলিয়াছিলেন তৎকালীন সরকারের অর্থনৈতিক কাজকর্মে দুর্বলতা আছে। মন্তব্য করিবার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার হইতে নির্দেশ আসিয়াছিল, কারিয়াপ্পা যেন অনধিকার চর্চা বন্ধ করেন! যে বিষয়ে তাঁহার কথা বলিবার অধিকার নাই, সেই বিষয় যেন তিনি মুখেও না আনেন।

Advertisement

জওহরলাল নেহরুর প্রসঙ্গ উত্থাপন আকস্মিক বা অকারণ নহে। ভারতীয় গণতন্ত্রের রূপটি যে এখনও পরিপূর্ণ সংসদীয়, তাহা যে সেনা-শাসিত স্বৈরতন্ত্র নহে, কিংবা সেনা-অধীন নামমাত্র গণতন্ত্রও নহে— তাহার কারণ স্বাধীনতার পরই প্রথম প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হন। এশিয়া ও আফ্রিকার নূতন স্বাধীন দেশগুলির অনেকেই তখনও এবং এখনও সেনাবাহিনীর দ্বারা চালিত হইত/হয়। শিশু দেশের উপর সেনার বিরাট করাল ছায়া যে কতটা প্রবল হইয়া উঠিতে পারে, সেই ছায়ার দাপটে নাগরিক অধিকার কী ভাবে রাহুগ্রস্ত হইতে পারে, পাকিস্তানের উদাহরণই ভারতকে তাহা শিখাইবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ভারতে সেনার প্রতিপত্তি কম হইবার কৃতিত্ব কোনও মতেই সেনাকে দেওয়া যাইবে না, কেননা ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর ঠিক একই উৎস ও সংস্কৃতি হইতেই পাকিস্তানের সেনাও জন্ম লইয়াছিল, এবং ইসলামাবাদের উপর রাওয়ালপিন্ডির প্রতিপত্তি তাহাতে বিন্দুমাত্র আটকানো যায় নাই! সুতরাং এই কৃতিত্ব নেহরুকেই দিতে হইবে, যিনি সামরিক বিভাগকে অসামরিক সরকারের অধীন রাখিবার কঠিন লক্ষ্যে কতকগুলি সুবিবেচিত পদক্ষেপ করিয়াছিলেন। এক, সেনাপ্রধানের বাসস্থান তিনমূর্তি ভবন প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে আনিয়াছিলেন, দুই, সেনানিমিত্ত নির্দিষ্ট বাজেট অনেক কমাইয়া ফেলিয়াছিলেন, এবং তিন, প্রতিরক্ষার বিভাগটি সেনা হইতে আলাদা করিয়া ফেলিয়াছিলেন। শুনিতে আলঙ্কারিক হইলেও, সব মিলাইয়া বার্তাটি ছিল পরিষ্কার, উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট। অতঃপর দেশে বহু সঙ্কটকাল আসিলেও দেশের ‘সিভিলিয়ান’ শাসক ও সেনার মধ্যে প্রাচীরটি বরাবর ছিল নিরেট ও কঠিন। অতীব দুর্ভাগ্য, আজ সেই প্রাচীরে ফাটলের ইঙ্গিত। ইহার দায়িত্ব যুগপৎ সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী মোদীর। কেননা, এই ফাটল ধরিত না, যদি না তাঁহারা যৌথ ভাবে ফাটলটি ধরাইতে চাহিতেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement