Liz Truss

নামভূমিকায়: সেপ্টেম্বর ২০২২

তিনি জিততে ভালবাসেন, উঁচুর দিকে নজর, সমঝোতায় পিছপা নন। পোশাকেও স্পষ্ট, মার্গারেট থ্যাচারকেই মডেল ঠাওরেছেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস।

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৫০
Share:

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস।

রানির প্রয়াণের অভিঘাতে কিছুটা কি আড়ালে চলে গেলেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী? অথচ সত্যি বলতে, তিনি কিন্তু আড়ালে ঠেলে দেওয়ার মতো নেত্রী নন। কঠিন মানুষ তিনি, দক্ষ, ধুরন্ধর রাজনীতিক। শপথ নেওয়ার বছর তিনেক যেতে না যেতেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কুর্সি গিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে টালমাটাল, আর্থিক ভাবে সঙ্গিন পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্বভার তুলে নিতে হয়েছে ৪৭ বছর বয়সি মেরি এলিজ়াবেথ ট্রাস-কে। ব্রিটিশ গণতন্ত্রে মার্গারেট থ্যাচার, টেরেসা মে-র পর তিনি তৃতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী। লিজ় ট্রাস নিজেই সগৌরবে জানিয়েছেন, টোরি ‘আইকন’ মার্গারেট থ্যাচারই তাঁর আদর্শ।

Advertisement

বহিরঙ্গেও থ্যাচারের অনুকরণে পোশাক পরতে দেখা যাচ্ছে ট্রাসকে। তবে পোশাক তো কেবল উপরের সাজ নয়, ভিতরটাও ফুটিয়ে তোলে সে কখনও কখনও। চরিত্রগত ভাবে প্রথম থেকেই থ্যাচারের মতো সব বিষয়ে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবল মতামত। অঙ্কশিক্ষক বাবা বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ছোটবেলায় লিজ় পরিবারের সঙ্গে থ্যাচারের পারমাণবিক অস্ত্রনীতির বিরুদ্ধে মিছিলেও হেঁটেছিলেন। কিন্তু একটু বড় হতেই থ্যাচারের ভাবধারায় লিজ় এতটাই অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন যে, নিজের বাবার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরে। লিডসে তাঁর স্কুল ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা বলেছেন, তৎপর স্বভাবের লিজ় বরাবরই ভীষণ ভাবে নিজের মতো— দৃঢ়চেতা। চিরকালই তাঁর সাজপোশাক সমবয়সিদের তুলনায় অনেক পরিপাটি, পরিণত। কে জানে, হয়তো, তখন থেকেই তাঁর অভিমুখ শীর্ষের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন দর্শন, ইতিহাস ও অর্থনীতির দুঁদে ছাত্রীটি নানা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তার মধ্যে গাঁজার বিরোধিতাও যেমন ছিল, তেমন ছিল রাজতন্ত্র অবসানের পক্ষে জোর সওয়ালও। তখন অবশ্য লিজ় লিবারাল ডেমোক্র্যাট পার্টির সক্রিয় সদস্য। কিন্তু, বছর দুয়েকেই দল পাল্টে প্রতিদ্বন্দ্বী কনজ়ারভেটিভদের হাত ধরেন!

সেই কনজ়ারভেটিভ পার্টির তরফেই কালচক্রে আজ তিনি রাজা তৃতীয় চার্লসের প্রথম প্রধানমন্ত্রী! প্রথম জীবনের রাজনৈতিক দর্শনকে বলছেন কৈশোরের হঠকারিতা!

Advertisement

এই যে তাঁর অবস্থান বদলে ফেলার প্রবণতা— এই কারণে সমালোচক মহল এখন মনে করছেন, এই মুহূর্তে ব্রিটেনের যে রাজনৈতিক স্থিরতা প্রয়োজন, সেই স্থৈর্য এনে দেওয়ার যোগ্য তিনি নন। উদাহরণে ব্রেক্সিট প্রসঙ্গ আনা হচ্ছে। প্রথম দিকে লিজ় ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকার পক্ষে মুখ খুলেছিলেন, ব্রেক্সিট হওয়ার পর রাতারাতি ব্রিটেনের ইউনিয়ন ত্যাগকে সমর্থন করলেন। অনেকেরই মতে, সাম্প্রতিক নেতা নির্বাচনে তিনি যে শেষ রাউন্ডে গিয়ে ঋষি সুনককে হারিয়ে দিলেন, তার মূলে লিজ়ের এই ‘সুবিধাবাদী’ রাজনীতি। প্রচারের সময় তিনি বলছিলেন, কর কমাবেন, বেসরকারি সংস্থাগুলোর উন্নয়নে জোর দেবেন ইত্যাদি। সবই কনজ়ারভেটিভ সদস্যদের ভোট পেতে মন জোগানো কথাবার্তা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ তখনই বলেছিলেন, গ্যালারির জন্য খেলেন লিজ়! ব্যস, আর যায় কোথা, ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হল লিজ়ের।

সমর্থকদের দাবি, লিজ় ঠিক সুযোগসন্ধানী নন, তিনি পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেন। অনড় নন, উদারপন্থী। কে জানে, তা-ই কি না। তবে, ব্রিটেনের জন্য উদারনীতিই এই মুহূর্তে দরকারি। লিজ়ের ভাই বলেছেন, খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

লিজ় জিততে ভালবাসেন। জেতার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে নেন। তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের অঙ্কখাতায় তারই প্রমাণ। সহস্রাব্দের গোড়ায় লেবার দলের শক্ত ঘাঁটিতে কনজ়ারভেটিভদের হয়ে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছেন, হারলেও ভোটের ব্যবধান কমিয়েছেন। তার পরই নাকি কনজ়ারভেটিভ নেতার সঙ্গে সম্পর্কের জেরে পার্টির প্রথম সারিতে জায়গা করে নেন। যদিও এই অভিযোগকে রীতিমতো ভোটে লড়ে হারিয়েছেন লিজ়। এমপি হওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই মন্ত্রিত্ব পেয়ে গিয়েছেন। ডেভিড ক্যামেরন এবং টেরেসা মে-র মন্ত্রিসভায় শিক্ষা, শিশুকল্যাণ, গ্রামোন্নয়ন, পরিবেশ, আইন প্রভৃতি মন্ত্রকে হাত পাকিয়েছেন। বরিস জনসনের বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে উঠে বাণিজ্য ও পরে বিদেশ মন্ত্রকের গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। ভরসার কথা, এ সময়ে তিন বার ভারত সফরে এসেছেন লিজ়, অতিমারি যুদ্ধে পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গিয়েছেন। অভিযোগদীর্ণ জনসনের পাশে তো থেকেছেন শেষ পর্যন্ত। এই বিশ্বস্ততার ফলেই নেতা নির্বাচনে টোরিদের ভোটে ভরেছে তাঁর ঝুলি।

অনেকের আশঙ্কা, লিজ়ের সরকার জনসনের শাসনকালেরই নামান্তর হতে চলেছে। এ দিকে দিশাহীন প্রশাসন বা থ্যাচারীয় হাতুড়ি-নীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঘা— কোনওটিই সইবার অবস্থায় ব্রিটেন নেই। ব্রেক্সিট, অতিমারিতে তার অর্থনীতি ধুঁকছে। মুদ্রাস্ফীতি, করের বোঝা সামলাতে না পেরে ডাকবিভাগ, রেল, বন্দর ও সাফাইবিভাগের কর্মীরা ধর্মঘট ডাকছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসায় আমদানি-রফতানি ধাক্কা খেয়েছে, দক্ষ শ্রমিকের অভাব ঘটছে। তাপপ্রবাহ চলেছে দেশে, বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। বিদ্যুতের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দার খাদের ধারে দাঁড়িয়ে দেশটা। লিজ়ের প্রতিটি পদক্ষেপের ত্রুটি ধরতে মুখিয়ে থাকবেন বিরোধী লেবার দল। দেখা যাক, এই অবস্থায় লিজ় ট্রাসের নেতৃত্বে কতটা স্থিতি আসে সে দেশে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement