তরুণ বয়স থেকেই শৃঙ্খলা ভাঙতে সিদ্ধহস্ত, কিন্তু তুখোড় বাগ্মী, ছক-ভাঙা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দড়। এ বার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হলেন বরিস জনসন
United Kingdom

নামভূমিকায়: জুলাই ২০২২

হাসপাতালে ক্রমেই বেড়ে চলছিল রোগীর সংখ্যা, নাভিশ্বাস উঠেছিল দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা এনএইচএসের। প্রধানমন্ত্রীর উপরে ভরসা হারাননি মানুষ।

Advertisement

সীমন্তিনী গুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২২ ০৫:৪১
Share:

অপবাদের পাহাড়। যার ভারে যে কেউ চাপা পড়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁর উপরে সে সব কোনও প্রভাবই ফেলত না। অসংখ্য ‘ভুল পদক্ষেপ’ আর ‘অসতর্ক মন্তব্য’ই তাঁর নিজস্ব ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠেছিল। শৃঙ্খলাপরায়ণ নেতাদের মাঝখানে এক মাথা অবিন্যস্ত সোনালি চুলের নিরন্তর কথা বলা আমুদে মানুষটি যেন সত্যিই ‘ব্যতিক্রমী’। লেবারদের ঘাঁটি বলে পরিচিত লন্ডনে দু’-দু’বারের মেয়র। ব্রেক্সিটের পক্ষে জোগাড় করেছিলেন লক্ষ লক্ষ ব্রিটেনবাসীর ভোট, প্রায় একারই চেষ্টায়। ২০১৯-এ, ভোটাভুটি ছাড়াই, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব এসে পড়েছিল কাঁধে। তার চার মাস পরে সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে বোঝালেন, তাঁকে নেতা বেছে ভুল করেনি দল। ২০২০-র গোড়ায় মনে হচ্ছিল, ব্রিটেনে বুঝি সূচনা হবে নতুন এক যুগের— বরিস জনসন জমানা।

Advertisement

তার পরে এল কোভিড। মারণ ভাইরাসকে ঠেকাতে কঠোর লকডাউন জারি করা হবে, না কি অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে স্বাভাবিক ভাবেই চলবে কাজকর্ম, এই কঠিন প্রশ্নের সামনে জেরবার রাষ্ট্রনেতারা। কঠিন সেই পরিস্থিতিতে, জীবনে এই প্রথম বার, নড়বড়ে দেখাল বরিস জনসনকে। অতিমারির প্রথম ও দ্বিতীয় প্রবাহে, অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে, উন্নত দেশগুলির মধ্যে কোভিডে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার ছিল ব্রিটেনেই। হাসপাতালে ক্রমেই বেড়ে চলছিল রোগীর সংখ্যা, নাভিশ্বাস উঠেছিল দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা এনএইচএসের। তবু প্রধানমন্ত্রীর উপরে ভরসা হারাননি মানুষ।

হারালেন গত ডিসেম্বরে। জানা গেল, সারা দেশ যখন লকডাউনে দিশাহারা, তখন তাঁর সরকারি বাসভবনে একের পর এক মদের আসর বসিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরের কয়েক মাস ধরে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। পদত্যাগ ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না বরিসের সামনে।

Advertisement

জনসনকে বহু দিন ধরে যাঁরা চেনেন, তাঁরা কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই পতনে বিশেষ বিস্মিত হননি। যেমন, বরিসের সাংবাদিকতা জীবনের অন্যতম ‘বস’, দ্য ডেলি টেলিগ্রাফ-এর ভূতপূর্ব সম্পাদক স্যর ম্যাক্স হেস্টিংস। তাঁর কথায়, “চাকরিজীবনের প্রথম থেকেই বরিসের শৃঙ্খলাভঙ্গের প্রবণতা ছিল চোখে পড়ার মতো।” বরিসের যখন ১৭ বছর বয়স, তখন তাঁর স্কুলশিক্ষক মার্টিন হ্যামন্ড এক বার অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, “সমালোচনা জিনিসটা কখনওই ভাল চোখে দেখত না কিশোর বরিস। ও মনে করত, স্কুলের আর বাকি পড়ুয়াদের জন্য যা নিয়ম-কানুন, তা ওর জন্য নয়।”

সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া কলেজপড়ুয়া স্ট্যানলি ও শার্লটের দ্বিতীয় সন্তান বরিসের জন্ম নিউ ইয়র্কে। তাঁর যখন পাঁচ বছর বয়স, ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন জনসন দম্পতি। বাবা কাজ করতেন ইউরোপীয় কমিশনে। সেই সূত্রে বেশ কয়েক বছর ব্রাসেলসে ছিলেন বরিস, সেখানেই ফরাসি ভাষা শেখেন। পড়াশোনায় বরাবরই তুখোড়। দেশের সব থেকে নামজাদা প্রাইভেট স্কুলে পড়ার জন্য স্কলারশিপ পেয়েছিলেন সহজেই। তার পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। পড়াশোনার গণ্ডি পার করে যোগ দেন দ্য টাইমস সংবাদপত্রে, শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে। ভুল উদ্ধৃতি ব্যবহার করে সেই চাকরি খোয়ালেও পরে যোগ দেন দ্য ডেলি টেলিগ্রাফ-এ। সেখানেও দুর্নীতিতে নাম জড়িয়েছিল। তবে টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষ শুধু ‘বকুনি’ দিয়েই ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁকে। এর পরে স্পেক্টেটর-এর সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন বেশ কিছু দিন।

সাংবাদিকতা থেকে রাজনৈতিক জীবনে বরিসের ‘চাঞ্চল্যকর’ প্রবেশ ২০০৭-এ। তৎকালীন কনজ়ারভেটিভ নেতা ডেভিড ক্যামেরন বরিসকে বেছে নিয়েছিলেন লন্ডনের মেয়র পদে লড়ার জন্য। সবাইকে চমকে দিয়ে, লেবার পার্টির পোড়খাওয়া নেতা কেন লিভিংস্টোনকে হারিয়ে, জিতে যান জনসন। চার বছর পরে ফের জেতেন মেয়র নির্বাচনে। এই আট বছরে লন্ডনবাসীর জন্য ভাড়ার সাইকেল (যা পরিচিত বরিস বাইক নামে) চালু করা থেকে শুরু করে লন্ডন অলিম্পিক্সে জাতীয় পতাকা হাতে দড়ি থেকে ঝুলে থাকা— রঙিন ছিল তাঁর মেয়র জমানা।

জনসনের রাজনৈতিক জীবনের সব থেকে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা ব্রেক্সিট। সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে রাজি করানোয় প্রধান ভূমিকা ছিল তাঁরই। ফলে ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্তে সিলমোহর পড়ে যাওয়ার পরে জনসন যে নিজেকে দলের নেতা হিসেবে তুলে ধরবেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম— ২০১৯-এ ১০, ডাউনিং স্ট্রিটের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তাঁর প্রবেশ।

কিন্তু যে আশা নিয়ে কনজ়ারভেটিভ দল তথা দেশের মানুষ জনসনকে প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসিয়েছিল, তা আর তিনি পূরণ করতে পারলেন কই! কোভিড বিধি ভেঙে সরকারি বাসভবনে একের পর এক পার্টিতে অংশ নিয়েছেন তিনি— দেশ যখন ডিউক অব এডিনবরার মৃত্যুতে শোকপালন করছে, তখনও। তাঁর এক সতীর্থ যে যৌন হেনস্থাকারী, সে কথা জেনেও চুপ করেছিলেন। এই ‘চুপ থাকা’ই তাঁর রাজনৈতিক কফিনের শেষ পেরেক।

জনসন অনুগামীরা অবশ্য বলছেন, লেবার পার্টিকে ঠেকিয়ে রাখতে কনজ়ারভেটিভ দলের তুরুপের তাস জনসন-ই। এখনও। তাঁর ক্যারিশমা, তুখোড় বাগ্মিতা ও ছক-ভাঙা চিন্তাধারা চিরকালই তাঁকে অনিবার্য পতন থেকে রক্ষা করেছে। অচিরেই আবার মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে রাজনীতির মহাকাশে পাড়ি দেবে জনসন রকেট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement