বাংলায় মুসলিমেরা কিন্তু এত দিন পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি চাননি

এ বার মুসলিম ভোটে ভাগ?

রাজ্যের কুড়িটা জেলায় মিম সক্রিয় সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে।

Advertisement

মিলন দত্ত

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

সক্রিয়: কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছেন মিম-নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি, হায়দরাবাদ, ২১ ডিসেম্বর। পিটিআই

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা কি রাজ্যে মূলধারার রাজনীতির ওপর আস্থা হারিয়ে মুসলিম নেতৃত্বাধীন কোনও দলকে ডেকে আনতে চাইছেন? হায়দরাবাদের একটা ছোটখাটো আঞ্চলিক দল ‘মজলিশ এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (এমআইএম বা মিম)-কে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা করে দেওয়ার জন্য রাজ্য জুড়ে মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তোড়জোড় তারই ইঙ্গিত বলে মনে হতে পারে। কেমন সে প্রস্তুতি?

Advertisement

রাজ্যের কুড়িটা জেলায় মিম সক্রিয় সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। সবচেয়ে জোর পড়েছে অধিক মুসলমানের বাস এমন ছ’টি জেলায়— মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, হাওড়া, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা। ছোট-বড় জনসভা করে চলছে দলের প্রচার এবং সদস্য সংগ্রহ। রাজ্যের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জামিরুল হাসানের দাবি, গোটা রাজ্যে গত নভেম্বর পর্যন্ত ২০ লক্ষেরও বেশি সদস্য হয়েছেন। কেবল মুর্শিদাবাদ জেলাতেই সদস্য সংখ্যা সাড়ে চার লাখ। ওই জেলায় এখন মিমের পনেরোটা পার্টি অফিস। রাজ্যে কোনও রাজনৈতিক দলের এমন দ্রুত স্ফীতি দেখা যায়নি। রাজ্যে মিমের আনুষ্ঠানিক সূচনা এখনও হয়নি। দলের কর্ণধার আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এখনও রাজ্যে পা রাখেননি। তাতে অবশ্য আসাদুদ্দিনের ছবি দিয়ে ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করে জেলায় জেলায় মিছিল বা প্রচার আটকে থাকেনি। ছবির নীচে লেখা ‘ইন্তেজার আব খতম, মিশন ওয়েস্ট বেঙ্গল’।

পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তায় ভাটা ও আসাদুদ্দিন ওয়াইসির নাম-মাহাত্ম্যই এ রাজ্যে মিমের ভরসা। দেশের সংবাদমাধ্যম আসাদুদ্দিনকে কার্যত জাতীয় নেতা বানিয়ে তুলেছে গত কয়েক বছরে। তাঁর ভরসাতেই মিম রাজ্যে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৯০ থেকে ১০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ভাবছে। রাজ্যে কমবেশি ১২৫টি আসনে মুসলমান ভোটারেরা ফলাফলের নির্ণায়ক। তাঁদের দাবি, ৫০টা আসন জিতবে মিম। তেলঙ্গানার বাইরে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, বিহার আর ঝাড়খণ্ডে মিমের রাজ্য কমিটি থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে এখনও কমিটি গড়তে পারেনি। জানুয়ারিতেই রাজ্য কমিটি ঘোষণা করা হবে। তার জন্য ১০ লাখ মানুষ জমায়েত করে ব্রিগেডে জনসভা করার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।

Advertisement

ছয় জেলায় মিম ইতিমধ্যেই তৃণমূল স্তরে সংগঠন সাজিয়ে নিয়েছে বলে তাঁদের দাবি। এই দাবির যে কিছুটা সারবত্তা আছে তা মিমকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথাব্যথা থেকেই বোঝা যায়। মিম যাতে পশ্চিমবঙ্গে কোনও রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারে সেই ব্যাপারে সব জেলার পুলিশ সুপারদের সতর্ক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশ সুপারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী গত ২ ডিসেম্বর ভিডিয়ো কনফারেন্স করে নবান্ন থেকে এই নির্দেশ দেন। মিমকে আটকাতে কেবল দলীয় বাহিনী নয়, পুলিশকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত নানা ছুতোনাতায় মিমের অন্তত ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মমতার শঙ্কা স্পষ্ট: তাঁর একচেটে মুসলিম ভোটে ভাগ বসাতে এসেছে মিম। গত মাসে কোচবিহারে এক সভায় তিনি পরিষ্কারই বলেছেন, ‘‘ওরা কিন্তু বিজেপির বি-টিম। ওরা বিজেপির টাকা নেয়। সংখ্যালঘুরা ভুল করবেন না। ওদের বাড়ি হায়দরাবাদে। এখানে নয়।’’

‘মজলিশ এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করার কথা বলে। নিজাম শাসিত হায়দরাবাদে ১৯২৭ সালে মিমের জন্ম। নিজাম নবাব মির ওসমান আলির পরামর্শে নবাব মেহমুদ নওয়াজ খান দলটি গঠন করেন। ১৯৩৮ সালে বাহাদুর ইয়ার জং মিমের সভাপতি নির্বাচিত হলে দলের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক চরিত্র আরও প্রকট হয়। বাহাদুর জঙের মৃত্যুর পরে (১৯৪৪) সভাপতি হন কাসমি রিজভি। এই রিজভির নেতৃত্বাধীন ‘রাজাকার’রাই ছিল ইসলামি আধাসেনা, যারা হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির বিরোধিতা করে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয় ‘ঝটিকা বাহিনী’ হিসেবে। মিম চেয়েছিল, হায়দরাবাদ হবে স্বাধীন ‘দক্ষিণ পাকিস্তান’। ১৯৪৮ সালে মিম নিষিদ্ধ হয়। রিজভি ন’বছর কারাবাসের পরে দেশত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার শর্তে মুক্তি পান। দেশত্যাগের আগে রিজভি মিমের দায়িত্ব তাঁর উকিল আবদুল ওয়াহিদ ওয়াইসির হাতে তুলে দেন। তিনি ‘অল ইন্ডিয়া মজলিশ এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ নামে দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তার পর থেকে মিমের নেতৃত্ব ওয়াইসি পরিবারের হাতে। আবদুল ওয়াহিদের মৃত্যুর পরে (১৯৭৫) তাঁর পুত্র সুলতান সালাউদ্দিন ওয়াইসি দলের দায়িত্ব নেন। ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত লাগাতার সাত বার তিনি হায়দরাবাদ কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন। তাঁর পর তাঁর বড় ছেলে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দলের সভাপতি হন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি হায়দরাবাদ লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সংসদে যাচ্ছেন। তার আগে ১৯৯৪ থেকে দু’বার অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভার সদস্য ছিলেন। বিজেপি সরকার তাঁকে ২০১৪ সালে সংসদ রত্ন সম্মানে ভূষিত করে।

ওই বছরই মিম তেলঙ্গানার বাইরে পা রাখতে শুরু করে। ২০১৪ সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটে মিম দুটো আসন জেতে। লোকসভা ভোটেও মহারাষ্ট্রে একটা আসন জেতে মিম। সেখানে এ বারের বিধানসভাতেও এক জন বিধায়ক রয়েছেন মিমের। কিন্তু মিম যত আসনে জিতেছে তার চেয়ে অনেক বেশি আসনে মুসলিম ভোট কেটে কংগ্রেসের যাত্রা ভঙ্গ করেছে। তাতে লাভ হয়েছে বিজেপির। একই কাজ তারা বিহারেও করেছে। বাংলার লাগোয়া বিহারের কিসানগঞ্জ উপনির্বাচনে মিমের বড় জয় এ রাজ্যে শাসক দলকে উদ্বিগ্ন করেছে। ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা ভোটে একটি আসনেও জিততে পারেনি মিম, কিন্তু মুসলিম ভোট কাটাকুটির খেলায় বিজেপিকে ৮টি আসনে জিতিয়েছে।

কিন্তু ইতিহাস বলছে এ রাজ্যের মুসলমান কোনও দিনই পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিতে আস্থা রাখেননি। হিন্দুরা বরং লোকসভা ভোটে বিজেপির ১৮ জনকে জিতিয়ে তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রকট করেছেন। কোনও মুসলিম দলই শক্ত জমি পায়নি এ রাজ্যে। ১৯৬৯ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লিগ নামে একটি দল ৪০টা আসনে প্রার্থী দিয়ে তিনটিতে জিতে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে তারা এতটাই হীনবল হয়ে পড়ে যে ১৯৭১-এর নির্বাচনে দুটোর বেশি আসনে লড়ার ক্ষমতা ছিল না। তাঁদের জামানতও জব্দ হয়। গত বিধানসভা নির্বাচনে ওয়েলফেয়ার পার্টি এবং অসমের ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট অনেক চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়েছে। এ রাজ্যের মুসলমান বরাবরই মূলধারার রাজনীতিতে আস্থা রেখেছেন— ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে নয়, রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও ধারার সঙ্গে থেকে। ১৯৭৭-এর আগে কংগ্রেস, পরে বামফ্রন্ট বা ২০১১ থেকে তৃণমূল মুসলিম ভোট যা পেয়েছে তা সব সময়েই মোট ভোটের সমানুপাতিক।

কিন্তু রাজ্যে এমন কী ঘটে গেল যে মুসলিমেরা রাজ্য-রাজনীতির মূলধারা ছেড়ে সাম্প্রদায়িক দলের দিকে ঝুঁকছেন? মিমের নেতারা বলছেন, মুসলিমদের জন্য কোনও দলই কিছু করেনি। সংখ্যালঘু উন্নয়নে তৃণমূল সরকারের ভূমিকা নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। আবার বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূলকে যথেষ্ট আন্তরিক নয় বলে মনে করেন তাঁরা। মিমের দাবি, বিজেপির মোকাবিলা করতে পারেন একমাত্র আসাদুদ্দিন ওয়াইসি।

কিন্তু মিম যে একটি বিশুদ্ধ সাম্প্রদায়িক দল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। মিমের এক বিধায়ক ২০০৭ সালে তসলিমা নাসরিন আর সলমন রুশদিকে খুনের হুমকি দিয়ে ফতোয়া জারি করেন। পরে হায়দরাবাদ প্রেসক্লাবে এক সভায় তসলিমার ওপর হামলা করার অভিযোগে মিমের তিন বিধায়ককে গ্রেফতার করে পুলিশ। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে মিমের নেতা আকবরুদ্দিন ওয়াইসি কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও হয়।

মুসলমানদের শিক্ষিত এবং সুশীল অংশ শঙ্কিত এই দেখে যে মিমের উত্থানের ফলে সমাজটা আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। তাঁদের বক্তব্য, সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। এ রাজ্যে মিম কিছু ভোট নিশ্চয়ই পাবে। কোনও আসন জিতুক বা না জিতুক তারা যেটুকু ভোট কাটবে তাতে পুরোটাই বিজেপির লাভ। অনেক রাজ্যেই তা প্রমাণ হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement