প্রতিবাদের আগুনে জ্বলছে ট্রেন। ছবি: পিটিআই।
সরকারি কোনও প্রকল্প সফল হবে না ব্যর্থ, তা নির্ভর করে একমাত্র তার বাস্তবায়নের উপরে। ওটাই একমাত্র চাবিকাঠি। জাদুকাঠিও বলা যায়।
সম্প্রতি ভারত সরকার একটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে। সাড়ে ১৭ থেকে ২১ বছরের তরুণ-তরুণীরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখা— স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনায় চুক্তিভিত্তিক ভাবে চার বছরের জন্য যোগ দিতে পারবেন। তাঁদের নাম হবে ‘অগ্নিবীর’। পরে যদিও ২১ বছরের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ২৩ করা হয়েছে। চার বছর শেষে সেনায় শূন্যপদ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতি ব্যাচের সর্বাধিক ২৫ শতাংশ অগ্নিবীরকে সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বাকিদের সম্মানজনক আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে ‘বিদায়’।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, প্রতিরক্ষা খাতে পেনশন বাবদে বাজেট কমানো। কম বয়সের তরুণ-তরুণীদের এ ভাবে নেওয়া হলে তাঁদের পেনশন দিতে হবে না। ফলে প্রতিরক্ষা খাতে অর্থ বাঁচবে। সেই অর্থে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উন্নতি করা হবে।
অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের মতো অগ্নিপথেরও অনেক ভাল দিক রয়েছে। অনেকগুলো দিক আবার অতটা ভাল নয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কী ভাবে হচ্ছে বা হবে, তার উপরেই সবটা নির্ভর করছে।
সরকারকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব নিতে হবে। সেনার থেকেও এই প্রকল্পের অনেক বেশি দায়িত্ব সরকারের। সরকারকেই পুরো বিষয়টা নজরদারিতে রাখতে হবে। করতে হবে তার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন। সেই বাস্তবায়ন যদি ঠিকঠাক ভাবে না হয়, তবে এই প্রকল্পও অনেক কিছুর মতো মুখ থুবড়ে পড়বে। আর সাফল্য পেলে গোটা দেশের জন্য ভাল। ভাল দেশের তিন বাহিনীর জন্যও। তবে এটাও ঠিক যে, বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের হলেও সশস্ত্র বাহিনী এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কী ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
অগ্নিপথ-বিক্ষোভে অগ্নিগর্ভ দেশের নানা প্রান্ত। ছবি: পিটিআই।
আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য লিখতে বসে মনে হচ্ছে, প্রাক্তন ফৌজি হিসেবে প্রথমে অগ্নিপথের ভাল দিকগুলোর কথা বলি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে সব তরুণ-তরুণী সেনায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পাবেন, তাঁদের দক্ষতা অন্য অনেকের থেকে কয়েক মাইল এগিয়ে থাকবে। যে ভাবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখায় প্রশিক্ষণ হয়, তাতে ওই অগ্নিবীরদের শৃঙ্খলাবোধ ভীষণ পোক্ত হবে। তাঁদের শারীরিক এবং মানসিক ফিটনেস, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োগ— এক কথায় তাঁরা সকলে সব দিক থেকে হয়ে উঠবেন পারদর্শী। ‘চৌখস’ শব্দটাও ব্যবহার করতে চাই সচেতন ভাবে। এমনকি, ওই অগ্নিবীরেরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে নিজেদের প্রশিক্ষণের কারণেই সেটা সম্ভব হবে।
ধরা যাক, সেনা তার তিন বাহিনীতে এই অগ্নিবীরদের এক একটা ব্যাচ থেকে ২৫ শতাংশকে অন্তর্ভুক্তি করল। অর্থাৎ, পাকা চাকরি দিল। বাকি ৭৫ শতাংশকে দেওয়া হল ‘আর্থিক প্যাকেজ’। প্রশ্ন উঠছে, ওই প্যাকেজ নিয়ে কী করবেন তাঁরা? চার বছর শেষে তখন এক এক জন অগ্নিবীরের বয়স সাড়ে ২১ থেকে ২৭-এর মধ্যে থাকবে। এক জন যুবার তো তখন সেটাই কর্মদক্ষতা দেখানোর আদর্শ সুযোগ। অথচ সেই বয়সেই তিনি বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি শেষ করে সামাজিক জীবনে ফিরে এলেন।
এটাই এই প্রকল্পের সবচেয়ে ‘স্পর্শকাতর’ জায়গা। সরকারকে ঠিক এই জায়গাটাতেই জোর দিতে হবে। এটাকে আমি ‘এগজিট প্ল্যান’ হিসাবেই দেখতে চাইছি। সরকার এখানে যত গুরুত্ব দেবে, ততই এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে। কারণ, যে ২৫ শতাংশকে বাহিনী নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করবে, তাদের পেশাগত নিশ্চয়তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকবে না। চিন্তা তো বাকি ৭৫ শতাংশের জন্য।
এখানেই কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্য সরকারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ-সহ সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রের বিভিন্ন যোজনা ও প্রকল্পে এই অগ্নিবীরদের সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা তো তাদেরই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই অগ্নিবীরেরা অন্য অনেকের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক বেশি পারদর্শী হবেন। সরকার যদি নিজেদের অগ্নিপথ প্রকল্পে এই ‘এগজিট প্ল্যান’-এর সবিস্তার পরিকল্পনা না রাখে, তা হলে সমস্যা দেখা দেবে। নানা প্রশ্ন উঠবে। এবং বহু তরতাজা যুবার পেশাগত জীবনকে একটা ঝুঁকিপূর্ণ অধ্যায়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। কারণ, পেশাগত জীবনের শুরুতেই এই ‘বিদায়’ অসহনীয় মনে হতে পারে অনেকের।
প্রতিবাদীদের হঠাতে তৎপর পুলিশ। ছবি: পিটিআই।
আরও একটা বিষয় এই লেখায় বলতে চাই। ‘এগজিট প্ল্যান’-এর মতো প্রকল্প শুরুর পরিকল্পনাও আর একটু ভাল ভাবে করা যেত। মনে রাখতে হত, কোভিডকালে গত দু’বছর সেনায় ভর্তির কোনও পরীক্ষা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা পিছিয়েও গিয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার্থীদের বয়স থেমে থাকেনি। তাঁদের বয়স ইতিমধ্যেই দু’বছর বেড়েছে। ফলে বয়সের কারণে পরীক্ষা দেওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা হাতছাড়া হয়েছে অনেকের। কর্তৃপক্ষের প্রথমেই সে কথা মাথায় রাখা উচিত ছিল। পরে যদিও বিক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার বয়ঃসীমা দু’বছর বাড়ানো হয়েছে। সেটা খুবই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু এটা আগে করলে কিছুটা প্রতিবাদ হয়তো এড়ানো যেত।
প্রতিবাদের আর একটা দিকও আমাকে একটু ভাবাচ্ছে। সেটা বাহিনীর জন্য হয়তো ভাল। কিন্তু আঞ্চলিক ভাবে দেখলে একটু জটিল। আগে যেমন শিখ, গোর্খা, রাজস্থান, জাঠ, অসম— ইত্যাদি রেজিমেন্ট অনুযায়ী নিয়োগ হত। এখন কিন্তু সেই নিয়োগ ব্যবস্থাটা ‘সর্বভারতীয়’ হয়ে গেল। অর্থাৎ, অনেকের সুযোগ বেড়ে গেল। পাশাপাশি, যাঁরা আঞ্চলিক ভাবে সুযোগ পেতেন, সেটাও হয়তো খর্ব হল। আমার মনে হয় প্রতিবাদীদের একটা অংশ এটা ভেবেও পথে নেমে থাকতে পারেন।
তবে আবার বলছি, বাহিনীর জন্য কিন্তু এই অগ্নিপথ অত্যন্ত ভাল একটা প্রকল্প। প্রতি বছর একটা তাজা ব্যাচ বাহিনীতে যোগ দেবে। চার বছর ধরে তারা প্রশিক্ষিত হবে। তার পর সেরা অংশটি বাহিনীতে আসবে। এখন তিন বাহিনীতেই জওয়ানদের গড় বয়স ৩২। ওটাই কিন্তু নেমে ২৫ হবে অগ্নিবীরেরা এলে। বাহিনীর জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
মনে-প্রাণে চাইছি, এই প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন হোক। সরকার বাহাদুর নিশ্চয়ই সেটা করবেন। তিন বাহিনীতে তরুণ প্রজন্মের এমন অন্তর্ভুক্তির আশা আমাকে অন্তত অবসর জীবনে অদ্ভুত এক আনন্দ দিচ্ছে।
(লেখক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় বায়ুসেনা প্রধান। মতামত নিজস্ব)