ছবি: সংগৃহীত
মাগো, এত রক্ত কেন— মৃত্যুশয্যায় হাসির প্রশ্নের উত্তরে ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য বলিয়াছিলেন, ‘‘মা, এ রক্তস্রোত আমি নিবারণ করিব।’’ প্রতিশ্রুতি রাখিয়াছিলেন তিনি। ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পশুবলি বন্ধের আদেশ দিবার পাশাপাশি বলিয়াছিলেন, তাঁহার রাজ্যে যে ব্যক্তি দেবতার নিকট জীববলি দিবে, তাহার নির্বাসন দণ্ড হইবে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের আধারে রচিত ‘বিসর্জন’ নাটকের শেষে প্রথা, বিশ্বাস আর প্রভুত্বের দাবিকে পরাজিত করিয়া জয়যুক্ত হইয়াছিল প্রেম। ইহা সাহিত্যের ত্রিপুরা। বাস্তবের ত্রিপুরা কিন্তু অন্য কথা বলে। সেখানকার মন্দিরে পশুবলি প্রথা এখনও চলিতেছে। ত্রিপুরা হাইকোর্ট যদিও তাহার সাম্প্রতিক রায়ে জানাইয়াছে, রাজ্যের কোনও মন্দিরে পশু বা পাখি বলি দেওয়া যাইবে না। সঙ্গে সরকারের প্রতি আদালতের নির্দেশ, সংবিধানস্বীকৃত মূল্যবোধ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করিতে হইবে। তাহাদের বুঝাইতে হইবে, সমস্ত প্রাণীর প্রতি প্রেম, মানবতা, সহানুভূতি প্রদর্শনের গুরুত্ব।
কিন্তু আদালতের রায় এখনও রাজ্যের সর্বত্র মানা হয় নাই। প্রধান দুই মন্দিরে বলিদান অব্যাহত থাকিয়াছে। পরিচালন সমিতির পক্ষ হইতে জানানো হইয়াছে, নিষেধাজ্ঞার নোটিস তাঁহাদের হাতে আসে নাই বলিয়া বলি বন্ধ করা যায় নাই। ত্রিপুরার বর্তমান মহারাজা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাইবার কথাও বলিয়াছেন। রাজ্য সরকারের পক্ষ হইতে জানানো হইয়াছে, ত্রিপুরার ভারত ভুক্তিকরণের চুক্তি অনুযায়ী, মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির-সহ অন্যান্য মন্দিরের পূজার্চনার কাজটি তো ঐতিহ্য অনুসারেই হইবার কথা। অর্থাৎ, এত বৎসরের ঐতিহ্যে হঠাৎ এ-হেন আইনি খবরদারি কেন? সর্বোপরি, আদালতের এই রায়কে হিন্দুধর্ম-বিরোধী বলিয়া প্রচার করা হইতেছে। প্রশ্ন তোলা হইতেছে, কেন শুধুমাত্র মন্দিরেই বলি বন্ধের কথা বলা হইবে? অন্যান্য ধর্মে, এমনকি জনজাতীয়দের কিছু আচারেও পশু-পাখি বলির রেওয়াজ আছে। পশুহত্যা নিষিদ্ধ করিতে হইলে সমস্ত ক্ষেত্রেই তাহা সম ভাবে প্রয়োগ করা উচিত।
অবশ্যই উচিত। কুপ্রথা ধর্ম এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে বন্ধ করিতে হইবে। এখানে পক্ষপাতের স্থান নাই। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, খাদ্যের জন্য পশুহত্যার সঙ্গে দেবতাকে তুষ্ট করিবার জন্য পশুবলির পার্থক্য আছে। প্রথমটি মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন। দ্বিতীয়টি নহে। দ্বিতীয়টি আড়ম্বর। কুৎসিত আড়ম্বর। দরিদ্র জনজাতীয়দের কিছু প্রথার মধ্যে বলি থাকিতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাহার উদ্দেশ্য গ্রামবাসীদের একত্রভোজন। কিন্তু ‘বলি’ তাহা নহে। সেখানে মানুষ নহে, দেবতার তৃপ্তিই প্রধান। ধর্ম এখানে প্রাণিজগতের কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় নাই, বরং অসহায় প্রাণীদের খুন করা হইতেছে ধর্মের নামে। ইহার মধ্যে এক ধরনের আস্ফালন প্রকট, ক্ষমতার আস্ফালন। ঐতিহ্যের অজুহাতে দুর্বলের প্রতি ক্ষমতার এই আস্ফালনকে প্রশ্রয় দেওয়া ঘোরতর অন্যায়। এই অন্যায় চলিতে দেওয়া যায় না। নরবলির প্রথা যদি আইন করিয়া বন্ধ করা যাইতে পারে, জীববলির ক্ষেত্রে তাহা করা যাইবে না কেন? ঐতিহ্যে আঘাত লাগিলেও এই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোনও ভাবনার স্থান নাই। ধর্মের ঐতিহ্য ও সংস্কার অনেক সময়ই সময়োচিত ভাবে পাল্টাইতে হয়।