পাঁঠার দিক থেকে দেখলে এ তো সমীচীন বিপ্লব, নিগূঢ় ন্যায়বিচার! ‘ক’ পশু পেলে তুমি কাঁউকাঁউ খাবে, আর ‘খ’ পশুর মশলা-টুকরো মনশ্চক্ষে ভাসলেও ওয়াক তুলবে— এ সটান সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জিভচালনা কদ্দিন চলতে পারে! কুকুর বুক ফুলিয়ে পাড়ায় চৌকিদারি ফলাবে, বেড়াল পাঁচিল বেয়ে লঘু পদচারণায় হেঁশেলে লাফাবে, আর পাঁঠারা সারে সারে জটিল যোগাসনের পোজ়ে সামনের পা দুটো লম্বা প্যারালাল জুড়ে শিক হতে উল্টো ঝুলবে: প্রকট আকাট বৈষম্য! ছাগল না ওটা নেড়িঘেউ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? তারা একই প্লেটে দুইটি কাবাব, টেস্টে সব সমান! আজ তবে আচমকা, দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে, অচেতনে, ঘুরপথে, এক অ’সাম সাম্য পৃথিবীতে সাধিত! প্রথা যা-ই বলুক, অভ্যাস যা-ই ডিকটেশন দিক, মানুষ তার মানে অ্যাদ্দিন সকল পশুকেই গপগপিয়ে খেয়েছে, পাঁঠা একেলা সাফার করেনি! যাদের আমরা ভয়াল ভিলেন ভাবছি, যারা আমাদের পাতে নিয়মিত জোগান দিয়েছে পাঁচশো পঁচাত্তর প্রকার জানোয়ার, তারা তাইলে প্রকৃত প্রস্তাবে জাঁকালো জাস্টিসের জয়পতাকাই বয়ে বেড়িয়েছে আবাং জনতার ভিড়ে। আহা, আজ রবীন্দ্রনাথ থাকলে নির্ঘাত মেগা-খাগের কলম হতে উৎসারিত হত: ‘ছিলেম দেবতাশিশু, হয়েছি মাংস বিশু, কে বলিছে পিপুফিশু বাঙালি ডুবিল?/ ভাল কাজ করে তব esteem খুবই low! ’
মুরগি অবশ্য এ সিনে আর্তনাদ করে বলতে পারে, কোথায় সাম্য? কাটা পড়েছি আম্মো! পচা হোক ধসা হোক, আমাকেই তো কামড়েকুমড়ে একশা করেছে ফ্যাসিস্টরা। সত্যি, ক’টা চড়াই বা ঘুঘু নিকেশ করলে অন্তত ওদের কিছু রিলিফ হত, পাঁঠাদের ঐতিহাসিক অংশনিষ্কৃতির বিবরণ জেনে বেচারারা ফোঁস ছাড়ছে দ্বিগুণ বঞ্চনাবিষাদে! কিন্তু ‘কারও পৌষমাস কারও উপবাস’ চিত্রনাট্যে আসলি ক্লাইম্যাক্স এন্ট্রি নিল অন্য উইংস দিয়ে। মেয়র পারিষদ (বাজার) বলে দিয়েছেন, পুরসভার বাজারগুলিতে বাইরে কেটে এনে মুরগির মাংস বিক্রি করা যাবে না। অবশ্য নির্দেশ-টির্দেশ আসার আগেই, ভাগাড়-বাগড়া বোঝার সঙ্গে সঙ্গে, বাজাড়ু জেঠু পূর্বকর্তিত মাংসের গামলার দিকে কটমট ভুরু কুঁচকে বলছিলেন, না হে, তুমি আমায় টাটকা একটা কেটেই দাও। তাই পাঁড় তামসিকরা এ বার তুঙ্গ নাচছেন: রসিয়ে ‘লাইভ’ হত্যা দেখতে পাবেন, নিত্যি, গ্যাদাড়ে। যে লোক আগে মুরগি-গর্দান কুচুৎ দেখলে শিউরে চোখ বন্ধ করে ফেলতেন, ‘তুমি সাতশো তৈরি রাখো, আমি ঝিঙের দিকটা দেখে আসছি’ বলে সব্জিঝুড়ির পানে এসকেপ-হনহন, তিনি অবধি নিজেকে বকুনি: গ্যাঁট দাঁড়াও টাটিয়ে তাকাও বাপ, নইলে হাঙর উদ্বেড়াল শকুন অবধি মিশিয়ে দিতে পারে। শোনোনি, শকুনও কম পড়িতেছে? ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে সিদ্ধার্থ মুরগিহত্যা দেখতে পারেনি, তাই তার হৃদয় সুকুমার— এ মানেবইয়ের দিন তবে শেষ। আগে নিশ্চিত করতে হবে থালায় খেলিছে মোটমাট একটিই প্রাণী়, তার পর নরমতার শৌখিন ফুটনোট।
অচিরেই তক্ক উঠবে, মুরগির বেলা এ নিয়ম চালু হলে পাঁঠা বাদ যাবে কেন? সত্যি বলতে, মুরগির মাংসে বুলবুলি মিশিয়ে দিলে মানুষের যা আপত্তি, পাঁঠার প্রক্সিতে ডালকুত্তা খাইয়ে দিলে ঢের অধিক ঘিনঘিন। ঝুলন্ত দেখে বোঝাও যায় না ছাই, ছালটাল ছাড়িয়ে নিলে গোলাপি লাবণ্যে সব পশুই এক, কে অজ কে গজ না-মালুম। সমীপে একটা পাঁঠার আধবোজা মুন্ডু নিপুণ সেট করে দিলেই হল। এবং নীতিঠিকতায় মহাব্যস্ত অধুনা-পৃথিবীতে, মুরগির প্রতি যে অন্যায় হবে, সে অন্যায় ছাগল গরু ও অন্যান্য তাবৎ খাদ্য-জানোয়ারের প্রতি আলবাত করতেই হবে। তাই, নিদান হওয়া উচিত, সামনে ছাগল কাটো, তা থেকে খাবলে মাংস দাও।
তা হলে কী দাঁড়াল? বাজারময় পশুপাখির বিস্ফারিত আতঙ্ক, ঘড়ি ঘড়ি প্রকাণ্ড আর্তনাদ, আর ঝপাঝপ নিষ্ঠুর কোপ। বারান্দায় বেরোলেই বধ্যভূমি, মোবাইলে তুলে রাখলে রেকারিং আমোদ। না, একদমই ইতরকাণ্ড নয়, বরং উদ্দাম উপকারী, কারণ বিভিন্ন জানোয়ারের রক্তপাত, ছটফট, পলায়ন ও ‘ধর ধর’ উল্লাস-ধাওয়া, ঠান্ডা মাথায় কচাকচ নিধন দাঁড়িয়ে দেখার অভ্যাস হয়ে গেলেই ল্যাতপ্যাতে বাঙালির খোলস হতে বাহিরাবে বীরপ্রতাপ ডাকু। ঝপাংটা হাতে পেলেই যে অনায়াসে ভতাং করা যায়, এ বিরাট কিচ্ছু অন্যায় নয়, বরঞ্চ প্রকৃতির সুনিয়ম, সে বোধে দীক্ষিত হলেই আর মনোনয়নের সময় পেটাইয়ের জন্য ভাড়াটে বহিরাগত আনতে হবে না, লোকালদেরও তেজ হইহই জাগ্রত। গোটা রাজ্যে উত্তিষ্ঠত টাইপ চনমন। ভায়োলেন্স মানুষকে সতত উজ্জীবিত রাখে, মানে যারা ভায়োলেন্সটা হানছে তাদের। পুঁয়ে-পাওয়া বাঙালি চোখের সামনে অহরহ দুর্বলের অধীনতা ও অবধারিত পরাজয় দেখে শিখবে, প্রতিরোধহীন নিরীহকে ঘায়েল করার অনন্ত আরাম কারে কয়। পরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সুপার-সুবিধে, জল্লাদ জল্লাদ খেলতে তিরিশ গুণ লোক প্রস্তুত ও উৎসুক, টিভিতে সাত হাজার কুপিয়ে মার্ডারের খবর অন্তে নয়া ‘অনুশীলন সমিতি’র প্রশিক্ষিত কঠিন-কলিজা জনগণ: ‘‘তা ভালই হয়েছে, স্লো-মোশনে দেখতেও ফ্যান্টা, তবে খেয়াল রেখো, পাতে এসে না পড়ে!’’
কিন্তু যারা প্রাণপণ লড়ে বলি বন্ধ করেছিল? কেউ যৌথ পরিবারের পূত হাড়িকাঠে কিক মেরে জ্বালাময়ী দরদ-বক্তিমে আউড়ে স্ট্যাচুপ্রায়, আর প্রফেটের ‘এত রক্ত কেন’ কোটেশন তো ব্যবহৃত হতে হতে, ইয়ে, তন্দুরি চিকেন। বাজার-জবাইকাণ্ডে তাদের মাথায় সামূহিক বজ্রপাত সামলাতে, প্রেমসে বোঝাও: বলি তো কোনও দিন বন্ধ হয়নি বাপু, বন্ধ হয়েছিল প্রকাশ্যে বলি। গোপনে গলা কেটে অত্যাচার করে প্রাণ নিংড়ে নিয়ে নিষ্পাপ পশুকে পিস পিস করে সাজানো থাকবে, আর তুমি নিরাপদ থলেয় সে-খণ্ড ভরে শিস দিতে দিতে তব বলিবিরোধিতায় জুস সিঞ্চন করবে, চলবে কেন? যদি মাংস খাওয়া উপভোগ করো, যে কোনও উদ্যাপনেই বেহদ্দ বিরিয়ানি সাবড়াও, তা হলে তার গোটা উৎস-প্রক্রিয়াটা ডিটেল-সহ দেখার বেলায় থরথর বেহ্মপনা বাগালে সে তো ধাস্টামি বই কিছু নয়। বরং এ খুল্লমখুল্লা নিকেশ দেখে তোমার শিশুরা বুঝুক, তাদের নোলাতৃপ্তির ব্যাকস্টেজে কী প্রকাণ্ড নৃশংসতা নিহিত। তার পর তোমার নীতি-পোজ়িশন সম্বন্ধে টীকা টাইপ করুক: হত্যার বিরুদ্ধে নহে, উহার দর্শন স্রেফ প্রদর্শনের বিরুদ্ধে!
তবে, যে কোনও অস্বস্তি এমনিতেই মাস দেড়েকের মধ্যে সয়ে যায়, তা ছাড়া এ দেশ অনুভূতিহীনতারই দেশ, এখানে অকারণে বেড়ালের কান ছেঁচে দেওয়া, কুকুরকে লাথি কষানো, কেন্নো পিষে পাউডারের তামাশা জনজীবনে বোনা। আরে, সামনে ধর্ষণ হলেও লোকে দিব্যি হেলেদুলে সুস্থিত, আর এ তো ‘‘খাবার জিনিস খাবুনি?’’ তার চেয়ে বড়, উদর-বদনাম যত রটুক, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বাঙালির শরীর-মন তুরীয় তৈরি। আমরা মিনারেল ওয়াটার ভেবে খাই পানাপুকুরের জল, পাঁঠা ভেবে খাই হুলো বেড়াল, গণতন্ত্র ভেবে খাই কানের গোড়ায় ঠাটিয়ে চার থাপ্পড়। বসের অপমান, বাড়িওলার ঘাড়ধাক্কা র্যান্ডম খেতে খেতে, চোখের সামনে কয়েকটা প্রাণীকে কাটারির ঘা-য়ে লুটোতে দেখলে, ‘‘যাক, তা হলে অন্যেরও ব্যাড লাক হয়!’’ থিমে জিভে ও চোখে যুগপৎ জল এসে যাবে!