সাহেব বিবি গোলাম’ দেখেছেন? বিমল মিত্রের গল্প। বাংলা ছবিতে ছিলেন উত্তমকুমার আর হিন্দিতে গুরু দত্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় সেই রকম এক জমিদারবাড়িতে আশ্রয়গ্রহণকারী ভূতনাথ আমি। ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ভূতনাথের কাছে জমিদারবাড়ির সকলেই তাদের প্রাণের কথা শোনাত। কিন্তু ভূতনাথ সেই প্রাসাদোপম অট্টালিকার কেউ নয়। ঘড়িবাবু ভূতনাথকে পুরনো দিনের কথা শোনাচ্ছে। ছোট বৌ বহুব্যঞ্জনে থালা সাজিয়ে পেট ভরে খাইয়ে জীবনের দুঃখের কথা বলছে। চাকরদের ঝগড়া থেকে জবার হৃদয়ের কথা, সবই শুনতে হয় তাকে। তবু ভূতনাথ জমিদারবাড়ির কেউ নয়। সে শুধু এক দ্রষ্টা। নিরপেক্ষ অনলুকার।
সেই কোন ছোটবেলা থেকে এই শাহি দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে পথচারী। বয়স তখন পঁচিশ। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। শাস্ত্রী ভবন থেকে উদ্যোগ ভবন, নর্থ ব্লক থেকে সাউথ ব্লক, সংসদ ভবন থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন— পথ হেঁটে চলেছে ভূতনাথ। একত্রিশ বছর কেটে গেল। তিরিশ বছরে দেখলাম ন’জন প্রধানমন্ত্রী। তবে চূড়ান্ত দুঃসময়েও এমন প্রশাসনিক নৈরাজ্য দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, যা দেখছি আজ নরেন্দ্র মোদীর জমানায়।
আসুন, আজ আমি, এই ভূতনাথ-গাইড, খুব অল্প সময়ে দিল্লির নর্থ ব্লক-সাউথ ব্লকটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসি আপনাদের। সাইট সিয়িং। ইন্ডিয়া গেট থেকে বিজয় চক হয়ে নর্থ ব্লকে ঢুকছি। দিনের বেলাতেও প্রচুর বাঁদরের ধুপধাপ দাপট। এ হল অর্থ মন্ত্রক। এখানে সমস্যা হল অর্থমন্ত্রী কে? অসুস্থতার জন্য অরুণ জেটলিকে সরিয়ে পীযূষ গয়ালকে করা হয়েছে অর্থমন্ত্রী। অরুণ এখন মিনিস্টার উইদাউট পোর্টফোলিয়ো। সংবিধান অনুসারে পীযূষই অর্থমন্ত্রী। অরুণকে সরানোর বেশ কিছু দিন আগে থাকতেই দিল্লির গুঞ্জন ক্লাবে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল অরুণ জেটলি অর্থমন্ত্রী, কিন্তু মন্ত্রক চালাচ্ছেন অর্থসচিব হাসমুখ আঢিয়া। গুজরাতি ওই আমলা নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ। মনে আছে, তাজ মান সিংহ হোটেলের অভিজাত চেম্বার্স ক্লাবে বসে মুম্বইয়ের এক ডাকসাইটে ব্যবসায়ী জানিয়েছিলেন, দেশের প্রথম সারির এক শিল্পপতি অরুণ জেটলিকে সরাতে চাইছেন। তিনি প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, তাঁর বিরাগভাজন হয়ে এ দেশে অর্থমন্ত্রী থাকা যায় না। আমি বলেছিলাম, সে তো কত দিন আগে রয়টার্স লিখেছিল পীযূষ গয়ালকেই অর্থমন্ত্রী করা হবে, কারণ তিনি এক ক্ষমতাবান শিল্পপতির ঘনিষ্ঠ। সরকার তখন সে খবর খণ্ডন করে। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সে দিন দেখা, বললেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত হল তো!’’
আশ্চর্যের বিষয়, অরুণের কিডনি প্রতিস্থাপন হবে এই যুক্তিতে তাঁকে সরানো হল, অথচ সুষমা যখন একই কারণে ছুটি নেন, তখন তাঁকে কিন্তু দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়নি। আর এখন কী বিচিত্র অবস্থা! রাষ্ট্রপতি ভবনের বিজ্ঞপ্তিতে অরুণকে দফতরহীন করা হলেও লেখা হয়েছে, তিনি সুস্থ হলে আবার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এখন অরুণ ফিরে এসেছেন। সংক্রমণের ভয়ে যোগাযোগ আরও কিছু দিনের জন্য বন্ধ, কিন্তু তিনি এমনিতে সুস্থ। নর্থ ব্লকে অরুণের ব্যক্তিগত সচিব ও অন্য প্রাইভেট স্টাফরা একই ভাবে বহাল। অরুণ নিজে বাড়ি থেকে ভিডিয়ো পর্দার সাহায্যে আর্থিক নীতি নিয়ে কথা বলছেন। আর অফিসারেরা এক বার দৌড়চ্ছেন রেল ভবন, এক বার যাচ্ছেন কৃষ্ণ মেনন মার্গ, অরুণের বাড়ি। তাঁরা বলছেন, বাপের জন্মে এমনটা দেখিনি বাপু। আ টেল অব টু ফাইনান্স মিনিস্টার্স। আসলে মোদীর এখন উভয়সঙ্কট। অরুণকে বিক্ষুব্ধ করলে প্রভূত লোকসান তাঁর।
এমন এক অবস্থায় যখন অর্থ মন্ত্রকে চলছে ঘোর কলি, নীরব মোদী থেকে বিজয় মাল্য, জিএসটি থেকে বিমুদ্রাকরণ, চিদম্বরমের পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা থেকে টাকার দামের রেকর্ড অধোগতি তেলের দাম নিতে হিমশিম খাওয়া, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী নামক এক ব্যক্তি-সেনার টুইট, টুইটের পর টুইট। অভিযুক্ত অর্থ মন্ত্রকের অফিসার রাজেশ্বর সিংহ চিঠি দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে বলেছেন, দালাল রাজ চার বছরে খতম হল কোথায়? চার দিকে ঘুরছে তো বিবিধ দালাল।
চলুন চলুন, নর্থ ব্লক থেকে এখনই পালাই সাউথ ব্লকে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে। ওখানে ঢোকার বাধা আরও অনেক বেশি। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। কিন্তু ভিতরে কী হচ্ছে জানেন? শোনা যায়, সেখানে আর এক নৈরাজ্য। সেনাপ্রধানের সঙ্গে নাকি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আড়াআড়ি সম্পর্ক। আবার সেনা বনাম আইএএসদের বিরোধও নাকি চরমে। ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা জনস্বার্থে খুলে দেওয়া? উন্নয়নের জন্য সেনার জমি নেওয়া? ‘রে রে’ করে উঠছেন সেনা অফিসারেরা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক আর সেনা ভবনের মাঝখানে সবুজ লনে দুপুরবেলা প্রতিরক্ষা কর্মীরা খবরের কাগজ পেতে দল বেঁধে টিফিন বক্স খুলে মধ্যাহ্নভোজন সারছেন। সঙ্গে গরম আলোচনা। অন্দরমহলের কেচ্ছা। আর বলবেন না, কোটি কোটি টাকার অস্ত্র ডিল হচ্ছে, সেনাকর্তা চেঁচাচ্ছেন— আমরা যুদ্ধ করি, আমাদের ক’টা কামান, কত গুলি আর ক’টা সাবমেরিন লাগবে তা তো আমরা ঠিক করব। ওই আইএএস অফিসাররা কে? অথচ ওরাই তো সব কেনাকাটা করছে!
অন্য ব্যক্তি, ধরুন তিনি রবীন্দ্রনাথের পঞ্চভূত-এর ক্ষিতিবাবু, বলে উঠলেন, সেনাবাহিনীর ক’টা অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দেখেছ? অস্ত্রশস্ত্র কেনা নিয়ে গোলমালের কথা সব দেশেই শোনা যায়, কিন্তু এখানে তেমন অভিযোগ অত্যধিক, এবং সেনাবাহিনীও তার নিশানা থেকে মুক্ত নয়। অন্য জন অপ্-বাবু, তিনি মোদী সমর্থক। বললেন, সেই কৃষ্ণ মেননের সময় থেকেই তো চলছে চুরি। কী করা যাবে? পাল্টা জবাব, তা হলে আর মোদী যুগে অচ্ছে দিন এল কোথায়? কৃষ্ণ মেনন, বাবু জগজীবন রামের আমলে জিপ কেলেঙ্কারি, এখন তো মিসাইল-সাবমেরিন! ভূতনাথ সব শুনছে।
এক সেনা অফিসারকে প্রশ্ন করলাম, ডিফেন্স ডিল নিয়ে গুজব তো দাবানলের মতো ছুটছে। সবাই বলছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরই আসলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক চালায়। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আসলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। সে জন্যই তো নির্মলাকে মন্ত্রী করা হয়েছে। তিনি শিক্ষিতা। ইংরেজি বানানটা ঠিক লেখেন। কমা, দাঁড়ি দেখে সই করেন। ওই সেনা অফিসার তাঁর সযত্নে লালিত গোঁফে তা দিতে দিতে বললেন, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতিরক্ষা ডিল, কেউ যদি বলেন কোনও কাট-মানি কেউ নেয়নি, তবে বলব তিনি দিল্লির প্রশাসনের অ-আ, ক-খ, জানেন না। এর মধ্যেই আবার পাহাড়ি সেনাপ্রধান মাঝে মাঝেই পাক-বিরোধী বিবৃতি দিয়ে গর্জন করছেন। দাবি তোলা হচ্ছে, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদটি তৈরি করে সেনাপ্রধানকেই তাতে বসানো হোক— আরে ভাই, যুদ্ধ তো স্থল সেনারাই করে। নৌ আর বায়ু সেনা তো হাত তোলা পার্টি। এ সবের মধ্যে সেনা কর্তারা আরও বাজেট বাড়ানোর জন্য চিলচিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। সংসদীয় কমিটির কাছে গিয়েও সেনাপ্রধান দাবি জানিয়েছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট। ভোটের বছর। এখন সামাজিক প্রকল্পে টাকা ঢালব না কি আরও টাকা দিতে হবে অস্ত্র কেনাবেচায়?
মোদী সরকার অস্ত্র কেনাবেচায় বেসরকারি কিছু সংস্থাকে শতকরা ২৬ ভাগ অংশীদারি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। টাটা থেকে অনিল অম্বানী বা পুঞ্জ লয়েড সেই তালিকায় ছিল। এতে দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছেন অনেকেই। আমলারা আজও ওই ফাইল আটকে রেখেছেন। ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। তা বলে কি দুর্নীতি দমন হচ্ছে? লন্ডনের পাঁচতারা হোটেলে কোনও এক ভারতীয় শিল্পপতি এখন কার্যত একটি ফ্লোর নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন, সেখান থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অস্ত্র কেনাবেচার দালালি করছেন। আর এক পঞ্জাবি ব্যবসায়ী— বৃদ্ধ বয়সে বিউটি কুইনকে বিয়ে করে তিনিও একই কাজ করে চলেছেন। ঠিকই, গত চার বছরে রাজধানীতে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কোনও দুর্নীতির প্রমাণ মেলেনি। তবে বড় বিদ্যা এ সব। ধরা না পড়লেই আপনি সৎ। রাজধানীতে গুঞ্জন উড়ন্ত, দেওয়ালেরও কান আছে।
শেষে সিবিআইয়ের কথা বলি। সিবিআই প্রধান অলোক বর্মা অবসর গ্রহণ করতে চলেছেন। তিনি প্রধান হলে কী হবে, সিবিআই চালাচ্ছেন নম্বর টু গুজরাত ক্যাডারের রাকেশ আস্থানা। তাঁরই সিবিআই প্রধান হওয়ার কথা ছিল। তিনি দু’হাতে মাথা কাটতেন। এখন শেষ বেলায় বেঁকে বসেছেন বর্মা। প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে বলেছেন মায়াবতীই হোক আর জগন রেড্ডি— যা তদন্ত হবে সব লিখিত নির্দেশ করতে হবে। মুখের কথায়, ফোনের হুকুমে আর তদন্ত নয়। অমিত শাহের বিজেপির সে এক মস্ত গেরো। আরএসএস আর সঙ্ঘ পরিবারের অঙ্গুলিহেলনে ভোটের আগে শেষ বছরে আমলাতন্ত্র আর কথা শুনতে চাইছে না। একের পর এক দফতরে চলুন আমার সঙ্গে, দৃশ্য একই।
মনমোহন সিংহের জমানায় তো এমনটাই হয়েছিল। টু-জি দুর্নীতি আর কয়লা ব্লক লিজ় দেওয়ার কেলেঙ্কারির পর আমলারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ফাইলে সই করা বন্ধ করে দিয়েছিল। জন্ম হয়েছিল নীতিপঙ্গুতা। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চার বছর অতিবাহিত। আবার সেই নীতিপঙ্গুতা? ভূতনাথ সে দিন ছিল দ্রষ্টা। আজও তা-ই। প্রশাসনের এ নৈরাজ্যকে ‘অচ্ছে দিন’ বলাটা মুশকিল হয়ে যায়। তাই না?