এখন: সনাতন শবর, নাথু শবরের পুত্র। ২০০৪ সালে আমলাশোলে মারা গিয়েছিলেন নাথু শবর। ছবি: শান্তি সরকার
আমলাশোলের কথা মনে আছে? ২০০৪ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর (এখন ঝাড়গ্রাম) জেলার ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন, শবর-মুন্ডা (মুড়া) অধ্যুষিত যে অখ্যাত গ্রামটি পাঁচ জন মানুষের ‘অনাহার মৃত্যু’র জন্য সংবাদপত্রের শিরোনামে চলে এসেছিল? তাই নিয়ে তৎকালীন শাসক-বিরোধীর তুমুল কাজিয়া; প্রশাসক, সমাজকর্মী, গবেষক, বৈদ্যুতিন মাধ্যম, তথ্যচিত্র নির্মাতাদের একক বা দলবদ্ধভাবে আমলাশোল যাত্রা ও মৃত্যুর ‘কারণ’ নিয়ে নানা অবস্থানের কত চাপানউতোর! এর পর যা হয়— আমাদের চিন্তা ও চর্চা থেকে আমলাশোল নামটা ফিকে হতে হতে, একসময় প্রায় মুছে গেল।
এক যুগের বেশি সময় পেরিয়ে এ বার আমলাশোল যাত্রা— ‘পশ্চিমবঙ্গে খাদ্যের অধিকার ও অনাহারের রাজনীতি (২০০০-১০)’ বিষয়ক গবেষণার সূত্রে। যে ক’জন ২০০৪ সালে মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সনাতন মুড়া (৪৭) বাদে আর বাকি সব শবর— সময় শবর (৫৩), মঙ্গলী শবর (৩০), নাথু শবর (৫৫-৬০) ও শম্ভু শবর (৫০)। ২০০৪ সালের পর, কোকিলা শবরও (প্রায় ৫০) একই কারণে (‘অনাহারে’) মারা যান বলে তাঁর পুত্রবধূর দাবি, যদিও মিডিয়ায় এই নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় (২৩ আগস্ট ২০০৬) অবশ্য ২০০৪-এই ৮ জন ও ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির সংস্করণে আর এক জনের— পার্বতী শবর (৩০)— ‘অনাহার মৃত্যু’র খবর প্রকাশিত হয়। পরে, ডেনমার্কের গবেষক অলিভার রুবেন গবেষণা-নিবন্ধ (২০১১) লেখেন; ২০১৩ সালে প্রকাশ পায় দীপক কুমার বড় পন্ডা-র ‘জঙ্গলমহলের আদিবাসী জীবন: আমলাশোলের দিনলিপি’ ও চন্দন সিংহের ‘কিন্ডলিং অব অ্যান ইনসারেকশন: নোটস্ ফ্রম জঙ্গলমহলস্’।
শ্রীসিংহ ২০০৪-এ পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শাসক ছিলেন। গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে তিনি আমলাশোলে ‘অনাহারে’ মৃত্যুর বিষয়টিই উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, সনাতন মুড়া মারা গিয়েছিলেন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে। এক স্থানীয় কবিরাজ তাঁর চিকিৎসা করত। সনাতনদের পাঁচ বিঘা জমি, ডজনখানেক ছাগল, কিছু মুরগি নিয়ে মোটামুটি সম্পন্ন পরিবার। পাশাপাশি বাবুই ঘাসের দড়ি বেচে সস্তায় চাল কেনার পয়সা আসত। মৃত্যুর সময় সনাতনের বাড়িতে খাওয়ার মতো যথেষ্ট চাল মজুত ছিল। নাথু শবরের মৃত্যুও ‘অনাহারে’ নয়। তাঁর কোনও অসুখ ছিল না। পেশায় ওঝা নাথু রোগী দেখতে পাহাড় পেরিয়ে পাশের গ্রামে গিয়ে ফেরার সময় সন্ধের দিকে কিছু লোকের সঙ্গে বসে খাবার খান ও স্থানীয় মদ পান করে বাড়ির দিকে রওনা হন। পথে প্রবল ঝড় ওঠে। পরের দিন তাঁর স্ত্রী এক টিলার কোলে সনাতনের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। একই ভাবে শ্রীসিংহ শম্ভু শবর, সময় শবরের মৃত্যুও অনাহারে নয় যক্ষ্মায় হয়েছে বলে দাবি করেছেন। সময় শবরের বাড়িতে ‘সোমবারী’ শবরের মৃত্যুর কথাও উল্লেখ করেছেন। এঁরা হতদরিদ্র, কিছু পালিত মুরগি আর বাবুইয়ের দড়ি তৈরিই ভরসা। চিকিৎসাও জোটেনি ঠিকঠাক। কিন্তু এঁদের কারও মৃত্যুই ‘অনাহারে হয়নি’। যদিও, রুবেন ও বড় পন্ডা তাঁদের লেখায় ‘অনাহার মৃত্যু’ ও সরকারি অব্যবস্থার কথা সবিশেষ উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত, ১১৭৬ বঙ্গাব্দ বা ১৯৪৩-এর মন্বন্তরেও মানুষ মরেছে অনাহারে নয়, অনাহারজনিত রোগে।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আমলাশোল যান নানা উন্নয়নের বার্তা নিয়ে। এর আগে গিয়েছিলেন এক দশক আগে, ‘অনাহার’ মৃত্যু-পর্বে, বিরোধী নেত্রী হিসেবে। একদা প্রায়-অগম্য আমলাশোল পৌঁছনোর রাস্তা এখন পাকা, তবুও ধেড়ুয়া ছাড়িয়ে বেলপাহাড়ি পেরিয়ে (আমলাশোলের সবচেয়ে নিকটবর্তী ছোট্ট গঞ্জ, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও আছে) শিমূলপাল, ভুলাভেদা ফরেস্ট রেঞ্জের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে, এরই মধ্যে বেহাল হয়ে ওঠা রাস্তার দশা টের পাওয়া যায়! ২০১১ সালের জনশুমারি বলছে, আমলাশোলের আশেপাশের ডাবার, সিংলাহারের মতো বেশ কিছু মৌজা ‘জনশূন্য’ (ডি-পপুলেটেড) হয়ে পড়েছে। কেন? এই জনবিস্ফোরণের যুগে এই সব লোক যাচ্ছেই বা কোথায়?
আমলাশোলে ঢুকেই চোখে পড়বে বিরসা মুন্ডার মূর্তি, নীচে সমাজবাদী পার্টির বিজয় উপাধ্যায়ের নাম ‘উদ্বোধক’ হিসেবে শোভা পাচ্ছে। এখানে সমাজবাদী পার্টি! রহস্যটা ভাঙল একটু পরে। আমলাশোলে অধিকাংশ শবরেরই রেশন কার্ড ছিল না, রেশন দোকানও ছিল বেশ দূরে। এখন কার্ড হয়েছে, গ্রামের রেশন-দোকানে দু’টাকায় চাল পাওয়া যাচ্ছে, প্রাথমিক স্কুল চলছে, ১০০ দিনের কাজের (এনআরইজিএস) জব কার্ড ছিল না, এখন হয়েছে, যদিও অনেকেই কাজ পেয়েছেন নামমাত্র দিন। আমলাশোলের ‘অনাহার’ মৃত্যুর খবর ‘বাইরে’ আনায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, তদানীন্তন পঞ্চায়েতের একমাত্র সিপিএম সদস্য, কৈলাস মুড়া। বাকি সবাই তখন ঝাড়খণ্ড পার্টি (হাঁসদা)-র। কৈলাসকে তাঁর পার্টি বহিষ্কার করে, আর একটু দূরে জঙ্গলে বাড়তে-থাকা ‘বন-পার্টি’ (মাওবাদীরা) ‘পুলিশের চর’ সন্দেহে পিটিয়ে আধমরা করে দেয়। রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে মরিয়া কৈলাস সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন, সেই সূত্রেই বিরসার মূর্তি উন্মোচনে দলীয় নেতার আগমন। কৈলাস এখন ভাঙাচোরা একটা চা আর টিফিনের দোকান চালান। কোনও পার্টি করেন না।
ক্ষেত্রসমীক্ষার বিভিন্ন দিনে আমরা গ্রামের কিছু ‘নির্দিষ্ট’ (টার্গেটেড) পরিবারের মধ্যে (যেখানে ‘অনাহার’ মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল) এবং কিছু র্যান্ডম সমীক্ষা চালিয়ে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলি। স্থানীয় অধিবাসীদের বেশির ভাগই হয় শবর, নয় মুড়া/মুন্ডা। সবাই অভাবের শিকার হলেও মুড়াদের হাতেই বেশির ভাগ জমি, যা প্রায়-অনুর্বর, বড় জোর একফসলি। শবররা হতদরিদ্র।
এবং চন্দন সিংহের বক্তব্যের বিপরীতে, সনাতন মুড়া, নাথু শবর, সময় শবর (প্রসঙ্গত, শ্রীসিংহ জানিয়েছেন সময়ের কন্যার নাম ‘সোমবারী’, কিন্তু তাঁর পরিবার ও অন্যন্যদের মতে, তাঁর নাম মঙ্গলী), শম্ভু শবরের পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, এঁরা সকলেই তীব্র অনাহারজনিত অসুখে ভুগছিলেন, ‘অন্নপূর্ণা’, ‘সম্পূর্ণ গ্রামীণ রোজগার যোজনা’ (এনআরইজিএস-এর আগের প্রকল্প) বা অন্য কোনও দরিদ্রমুখী প্রকল্পের সাহায্য পাননি, রেশন কার্ড ছিল না, থাকলেও চাল মেলেনি। সনাতন মুড়ার বাড়িতে ‘যথেষ্ট চাল’ মজুত থাকার কথাও তাঁর স্ত্রী অস্বীকার করেছেন।
নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছে, অনুর্বর আমলাশোলের মানুষ বরাবরই সামান্য চাষ আর বাবুই-ঘাসের দড়ি বানানোর পাশাপাশি একটু দূরের জঙ্গলের কাঠ কাটার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ২০০৪ সালের আগে থেকেই ঝাড়খণ্ড-সংলগ্ন বনগুলিতে মাওবাদীদের প্রভাব বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে পুলিশও। দুইয়ের মাঝে পড়ে স্থানীয় মানুষের জঙ্গলে ঢোকা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আয়ও কমে যায়। তার সঙ্গে ছিল জনকল্যাণ প্রকল্পগুলির ও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর প্রায়-অনুপস্থিতি, ২০০৪ সাল বা তার পরেও যা এতগুলি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল!
শিবাজীপ্রতিম বসু ও শান্তি সরকার
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যথাক্রমে শিক্ষক ও গবেষক