—ফাইল চিত্র।
‘...প্রথম, প্রথম!/ কারো অধিকার নেই দ্বিতীয় হওয়ার...’
—জয় গোস্বামী
এই রকমই কোনও চাপিয়ে দেওয়া ভাবনার রাশ টানতেই হয়তো জীবন–মৃত্যুর সীমানা মিটিয়ে দিয়ে গেল কৃত্তিকা পাল। বৈষ্ণবঘাটায় আর কৃত্তিকা পালকে দেখা যাবে না। মাত্র ১৪ বছরের একটি ছোট্ট জীবনের অসহায় সমাপ্তি ঘটল। মর্মান্তিক ভাবে নিজের নিঃশ্বাস দমন করল সে। একা। নিজের হাতে। নিজের পরিকল্পনা মতো। সুইসাইড নোটের তৃতীয় পাতায় লিপিবদ্ধ করে গেল মৃত্যুর কঠিন মুহূর্তের হিসেব! এই অদম্য সাহসী মেয়েটিকে পথ দেখাতে আমরা ব্যর্থ হলাম। একটা পরিবার, একটা বিদ্যালয়, একটা গোটা সমাজ ব্যর্থ হল। এ পাপ আমাদের সকলের। কৃত্তিকা স্বপ্ন দেখত। তাই সে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিত। সে আবেগপ্রবণ ছিল। তাই শখ হিসেবে বেছে নিয়েছিল নাচ। ক্লাসে প্রথম, ‘ভাল মেয়ে’ কৃত্তিকা বাবা-মায়ের জন্য বাঁচত। তাই সব আগে নিজের বাবা-মাকে যেন বিরক্ত না করা হয় তা বলতে ভোলেনি সে। ঘাতক ছিল অবসাদ। চাপ ছিল চিহ্নিত শত্রু।
কৃত্তিকার এই অকালমৃত্যু ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’-এর সমাজকে। ‘অভাববোধ’ আর ‘হ্যাভ নট’দের একার অধিকারে নেই। বদল হয়েছে সংজ্ঞা। অভাববোধ শুধু টাকা –পয়সা না থাকা বা নামী বিদ্যালয়ে পড়তে না পাওয়ার অসুবিধার কথা বলে না। বলে এক বিশেষ অবস্থার কথা। যে অবস্থায় নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে ফিরতে হয়। নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হলে কৃত্তিকাদের মুখোমুখি হতে হয়। এই কৃত্তিকাকে ‘রিড’ করার সময় পায়নি ব্যস্ত সমাজ। আসলে গল্পের শুরু সেখান থেকেই। কোনও অভিভাবক কল্পনাও করতে পারেন না যে, তাঁর সন্তান মুখে প্লাস্টিক বেঁধে গলায় গিঁট দেবে। নিজের এক হাত দিয়ে অন্য হাত এলোপাথাড়ি পেন্সিল কাটার দিয়ে কাটতে থাকবে। তার পরে শুধু স্থির মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে বিদ্যালয়ের শৌচালয়ে। হাড় হিম করা এই বাস্তবের কাছে সব অভিভাবকের আজ মাথা নিচু করে দাঁড়ানোর কথা। কৃত্তিকাদের মনের মধ্যে কী চলছে তা নিয়ে আমরা কেউ সিরিয়াস নই। আসলে আমরা কৃত্তিকাদের প্রজন্মের মন বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি। ওদের চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে, অভিমান অনুভব করছি না। মেলাতেও পারছি না হয়তো কোথাও। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি সন্তান ছাড়া কে-ই বা আছে আমাদের! ওদের জন্যই তো সব! আমাদের এই উদ্দাম আবেগ ও বিশ্বাসের ফাঁকে পড়ে থাকছে কৃত্তিকাদের অন্য স্বপ্ন, অন্য চাহিদা।
জানা গিয়েছে, দ্বাদশ শ্রেণির পরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে চাইছিল কৃত্তিকা। তার প্রস্তুতি সে এখন থেকেই শুরু করে দিয়েছিল। এর জন্য সে নাকি তিন মাস ঘুমোতে পারেনি। কিন্তু শুধু এই কারণে কি কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে? সবে তো দশম শ্রেণি। কৃত্তিকার হাতে অঢেল সময় ছিল। তবে কি বাবা-মায়ের উপরে অভিমান? ‘আমি যখন থাকব না, তোমরা আমার অভাব বুঝতে পারবে’— নিজের অস্তিত্ব কি এতটাই বিপন্ন মনে হয়েছিল কৃত্তিকার? এতটাই ‘অ্যাটেনসন’-এর অভাববোধে ভুগছিল সে? নাকি ‘K’ এর জন্য অভিমান? মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যার কাছে করুণ মিনতি ছিল কৃত্তিকার—‘আমায় ভুলো না’। সেখানেও নিজের অস্ত্বিত্বের জন্য আকুতি। মরে গিয়ে নিজেকে প্রিয়জনদের কাছে বাঁচিয়ে রাখার এমন আগুন খেলায় কেন কৃত্তিকা আস্থা রেখেছিল তা কেউ জানে না। কৃত্তিকা হয়তো নিজের অবস্থান বা অভিমতের গুরুত্বটা বুঝে নিতে চেয়েছিল এক বার। সেটা স্পষ্ট হয়নি কারও কাছে। তাই সে ঠান্ডা মাথায় সুইসাইড নোটের তিন পাতার মধ্যে দু’পাতা অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিল।
‘আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।’ এ কথা বলে কি কৃত্তিকারা মৃত্যুকে উদ্যাপন করতে শিখছে? মুক্তির পথ কি তারা এ ভাবে বাছতে চাইছে? মানুষ হিসেবে কি অন্য মর্যাদাবোধের অহং কাজ করছে? আমায় পাত্তা দিচ্ছ না অতএব তোমাদের শাস্তি দেব। আমায় ছাড়া বেঁচে দেখো তো কেমন লাগে? নিজের যন্ত্রণাক্লিষ্ট হওয়ার ভার কি ওরা এ ভাবেই চুকিয়ে দিতে চাইছে? চিকিৎসাবিদ্যা আত্মহত্যার যে সব ব্যাখ্যা দেয় তা কৃত্তিকার মধ্যে কেন প্রকট হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ থেকে যায়। এই আত্মহত্যা নিশ্চিত ভাবে তাৎক্ষণিক আবেগ বা সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়ছে না। নইলে একটি শব্দ কাটা নেই এমন সুন্দর হাতের লেখার দীর্ঘ সুইসাইড নোট পাওয়া যেত না। তবে কি দীর্ঘ দিনের কোনও ক্লান্তি বা গ্লানি কৃত্তিকাকে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জীবন ছেড়ে পালাতে বাধ্য করছে? জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে শেখানো সেই তৃতীয় শক্তির তল্লাশি চালানো প্রয়োজন।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের ‘কমিউনিকেশন স্কিল’ বাড়ানোর কথা নতুন করে ভাবতে হবে। ছোটদের মন পর্যন্ত সত্যি কেন পৌঁছতে পারছে না বিদ্যালয় ও পরিবার এ নিয়ে আলোচনা দরকার। বিশ্বায়নের পরের পৃথিবীতে এসেছে পরিবর্তন। সম্পর্কে আবেগ ও বিশ্বাসের মানদণ্ডে এসেছে নতুন যুক্তি। মানুষের অপার চাহিদার ঢলে এসেছে অন্য এক বোহেমিয়ান সত্তা। এই নিয়ত পরিবর্তনের বাতাবরণে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় কৃত্তিকাদের সামনে থাকছে পরিবার ও বিদ্যালয়। তাই এই দুই প্রান্তকেই আরও বেঁধে বেঁধে থাকতে হবে কৃত্তিকাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য। দরকারে বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্তিকারা দেশের সম্পদ, পরিবারের স্বপ্ন, বিদ্যালয়ের নক্ষত্র। ওদের মন-মেধা-মনন বাঁচিয়ে রাখতে সমস্ত প্রয়াস জারি রাখতে হবে।
মানসিক চাপ ও অবসাদে থাকা অনেকেই বিশ্বাস করেন, আত্মহত্যা আসলে অন্তিম মুক্তি। কৃত্তিকারা কি সেই পথে হাঁটতে শিখছে? তবে তো ভয়ঙ্কর সর্বনাশ! ওদের এখনই ফেরাতে হবে জীবনের মূল স্রোতে। বোঝাতে হবে জীবনের মূল্য কোনও বিশেষ প্রাপ্তির মধ্যে লুকিয়ে নেই। কোনও অপূর্ণতাই বিকল্পহীন নয়। এক না পাওয়াকে ঢেকে ফেলে নতুন কোনও অপ্রত্যাশিত পাওয়া। জীবনের সামনে এসে পড়া প্রবল ‘না’ এর সামনে পরাস্ত নয়, নতজানু হয়ে সংসার করতে শেখাতে হবে কৃত্তিকাদের প্রজন্মকে। সময়ের হাতে নিজেকে সমর্পণ করার আস্থা অর্জন করতে শেখাতে হবে। এভারেস্ট জয় জীবনের শেষ কথা নয়। সৎ ও সাধারণ হয়ে বাঁচার মধ্যেও কোনও লজ্জা নেই। অপমান নেই। জীবনের প্রতি সম্মানবোধই মানুষের সবথেকে বড় জয়। এই জয়কে ‘সেলিব্রেট’ করতে শেখাতে হবে কৃত্তিকাদের। যে বড় কিছুই করতে পারে না, সে শুধু বাঁচতে পারে। সেটাও একটা সেলিব্রেশন। এতে মন খুলে শামিল হতে হবে সব্বাইকে। শেখাতে হবে— ‘চলো বাঁচি একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের জীবন। একদম অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত।’ সেই জার্নিটাও হিরোয়িক। প্রতিটি মানুষই হিরো। নিজের মতো করে, নিজের পরিসরে। এই আদর্শের পথ ধরে কৃত্তিকাদের না চলতে শেখালে সামনে চোরাবালি। শূন্যগর্ভ সাফল্যের খতিয়ানের মিথ্যা অহঙ্কারে বুক চওড়া হবে পরিবারের। বাড়বে বিদ্যালয়ের নিষ্প্রাণ গৌরব। ঝরে পড়বে হাজার কৃত্তিকার মতো ধূমকেতু।
মৃত্যুতে মেয়ের এত সাহস, এত দৃঢতা! জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে তবু একটি বার মুখ থেকে প্লাস্টিক সরানোর জন্য হাত ওঠে না মেয়ের! আগামীতে সেই জীবন সত্যিই কত প্রাণবন্ত হতে পারত! কৃত্তিকার এই প্রতিজ্ঞার কাছে মাথা হেঁট করে স্যালুট জানাক বড়রা। ওর মন বুঝতে না পারার জন্য এক বার সকলেই ‘সরি’ বলুক। কৃত্তিকারা সমাজকে একটু বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই বুঝি জন্ম নেয়! এই ‘ক্ষণজন্মা’দের জন্য ঘরে ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলুক। আমাদের ব্যর্থতা ও অজ্ঞতা যেন এই প্রজন্ম ক্ষমা করতে পারে!
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল