অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় খাদ্যরসিক। কিন্তু খাদ্যের উৎকর্ষকে যে শহরের আর্থিক উন্নতির মাপকাঠি হিসাবেও ব্যবহার করা সম্ভব, তাঁহার কথায় স্পষ্ট হইল। কলিকাতার আর্থিক উন্নতি প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী বলিয়াছেন, পূর্বে কলিকাতায় সন্দেশের দাম পঁচিশ পয়সা হইতে বাড়িত না— কিন্তু তাহার আয়তন ক্রমেই কমিত, ছানায় মিশিত ময়দার ভেজাল। এখন এক একটি সন্দেশের দাম হরহামেশা কুড়ি-পঁচিশ টাকা ছাড়াইয়া যায়, এবং উপাদানে-স্বাদে সেগুলি উৎকৃষ্ট। এই অতি ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ কলিকাতা সম্বন্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলে— এই শহরের অন্তত একটি অংশের মানুষের তুলনায় দামি জিনিস কিনিবার প্রবণতা বাড়িয়াছে, কারণ তাঁহাদের আয় বাড়িয়াছে। শহরের আর্থিক উন্নতি না হইলে আয় বাড়ে না। সন্দেশের দামের মাপকাঠিতে শহরের আর্থিক সমৃদ্ধি মাপা কতখানি যুক্তিযুক্ত? কিছু দিন পূর্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলিয়াছিলেন, বলিউডের সিনেমা দিব্য রমরম করিয়া চলিতেছে— তাহা হইলে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, এমন কথা বলা চলে কি? দুই মন্তব্যের মধ্যে তুলনা করিবার পূর্বে একটি কথা স্পষ্ট করিয়া লওয়া প্রয়োজন। দুই জনে সমান পরিস্থিতিতে মন্তব্য করেন নাই— অভিজিৎবাবুর কথাটি নেহাত কথার ছলে বলা, আর শ্রীপ্রসাদ মন্তব্যটি করিয়াছিলেন তাঁহার সরকারের পার্শ্বে দাঁড়াইবার উদগ্র তাড়নায়। কিন্তু, তাহা গৌণ পার্থক্য। মূল কথাটি হইল, আপাত-লক্ষণ দেখিয়া পরিস্থিতি বিচারের এই পদ্ধতি তখনই গ্রাহ্য, যখন সেই বিচারের ফলাফলের সহিত সার্বিক পরিসংখ্যানের সাযুজ্য থাকে। পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক উন্নতির পরিসংখ্যান অভিজিৎবাবুকে সমর্থন করিবে। কিন্তু, প্রকাশিত ও চাপিয়া যাওয়া যাবতীয় পরিসংখ্যান বলিবে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভুল বলিতেছেন। না-জানিয়া, অথবা জানিয়াই।
নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রীর মজার ছলে করা মন্তব্যটিতে একটি গূঢ় সত্য নিহিত আছে— শুধুমাত্র বৃহত্তর চিত্রটির দিকে নজর না করিয়া যদি আপাত-অকিঞ্চিৎকর প্রাত্যহিকতাকে অর্থনীতির চশমা পরিয়া দেখা যায়, তবে সাধারণ মানুষের ভাল-মন্দ সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্টতর হইতে পারে। তাঁহার, এবং এস্থার দুফলোর, সাম্প্রতিক বই গুড ইকনমিকস ফর হার্ড টাইমস-এর প্রচ্ছদে একটি রেঞ্চ-এর ছবি আছে; বইয়ের ভূমিকায় তাঁহারা জানাইয়াছেন, অর্থশাস্ত্রী হিসাবে তাঁহাদের কাজ কলের মিস্ত্রির কাজের ন্যায়— লাইনের কোনও অংশে ফাটল ধরিলে তাহা মেরামত করিয়া দেওয়া, কলের মুখ হইতে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়া বন্ধ না হইলে প্যাঁচ কষিয়া দেওয়া। সন্দেশের উৎকর্ষবিচারের সহিত এই রেঞ্চটির মস্ত মিল রহিয়াছে— দুই ক্ষেত্রেই অর্থশাস্ত্রীর নজর ক্ষুদ্রের দিকে। তিনি গোষ্পদে সিন্ধুদর্শন করিতেছেন না— অর্থনীতির বৃহৎ ছবিটির দিকে তাঁহার নজর আছে পৃথক ভাবে— কিন্তু, তিনি ক্ষুদ্রকে অবজ্ঞা করিতেছেন না। তিনি জানেন, তুচ্ছ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র উন্নতি-অবনতিকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে হয়, কারণ আপাত-অকিঞ্চিৎকর জনসমূহকে বাদ রাখিয়া অর্থব্যবস্থা হয় না। প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব প্রণোদনা, নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা, লাভ-ক্ষতির হিসাবকে মাথায় রাখিয়া তাঁহাদের স্বক্ষমতা অর্জনের পথে আগাইয়া দিতে পারিলে তবেই উন্নয়ন। ক্ষুদ্রকে ভুলিয়া যে অর্থশাস্ত্রে বৃহতের সাধনা হয় না, অভিজিৎবাবু আরও এক বার স্মরণ করাইয়া দিলেন।