জনসংযোগ: নির্বাচনী প্রচারে দিল্লির রাজপথে মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরীবাল। ২২ জানুয়ারি ২০২০। পিটিআই
২০১৯-এ, পাঁচ বছর বাদে আবার লোকসভায় ধুন্ধুমার বিজয় মোদীর, আর ২০২০-র ফেব্রুয়ারির গোড়ায় দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। ঠিক যেন পাঁচ বছর আগের রিপ্লে। পূর্ণ রাজ্যের ক্ষমতা (যেমন, স্বরাষ্ট্র দফতর) না থাকায় হয়তো আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে কিছুটা গুরুত্বহীন দিল্লির বিধানসভা। কিন্তু দেশের রাজধানী যে রাজ্যে, যার ভোটার সমাজ অনেকাংশেই গোটা দেশের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ, তার ভোটারদের পছন্দ আর সরকার গঠন অবশ্যই জাতীয় রাজনৈতিক বিন্যাসে তাৎপর্যপূর্ণ।
পাঁচ বছর আগে একতরফা জিতে আসে আম আদমি পার্টি। অভূতপূর্ব ভাবে খোলা রামলীলা ময়দানে শপথ নেন অরবিন্দ কেজরীবাল ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। উদ্বেলিত জনতা নির্বাচনী প্রতীক ঝাড়ু ছাড়াও নানা পোস্টার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির রামলীলা ময়দানে। মাত্র কয়েক মাস আগেই জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির উত্থানে বিচলিত মানুষের বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার স্বর ছিল প্ল্যাকার্ডে। প্রত্যয় ছিল: ‘আপ’ই পারে দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক বাড়বাড়ন্ত রুখে দিতে। অন্য দিকে ছিল অত্যধিক বিদ্যুৎ মাসুল আর পানীয় জল পরিষেবা সংক্রান্ত দাবির প্রশ্নে আপ সরকারের উপর আস্থা জ্ঞাপন।
২০১৫-তে সদ্য-গঠিত মোদী সরকারের সবচেয়ে প্রচারিত প্রকল্প ছিল ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’। প্রথমেই স্বচ্ছতার হাতিয়ার ঝাড়ুকে নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক বানিয়ে ফেলে আপ। ঝাড়ু প্রতীক চিহ্নের মাধ্যমে কাছে টানে সমাজে অচ্ছুত বাল্মীকি সম্প্রদায়কে, যাঁদের নিত্যদিনের পরিচিতি সাফাইকর্মী হিসেবে। বেশ কয়েক বছর কেটে গেলেও ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের প্রয়োগসাফল্য নিতান্তই সরকারি প্রচারনির্ভর। মাঝেমধ্যে ঝকঝকে রাস্তায়, স্টেশন বা পার্লামেন্ট চত্বরে ঝাড়ু হাতে ফটো সেশন এক জিনিস। আর বর্জ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিচালনায় সম্যক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোনো স্বতন্ত্র এক চ্যালেঞ্জ। রাজ্যের ফিটফাট এলাকা বাদ দিলে, বৃহত্তর জনবহুল মহল্লা অঞ্চলে এই স্বচ্ছতার প্রাপ্তি সামান্যই। ‘আপ’ সরকার স্বচ্ছতার প্রশ্নকে ফটো সেশনের বাইরে নিয়ে এসে আমজনতার দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্নগুলোকে প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়ে সরকারি পদক্ষেপ করতে থাকে গত পাঁচ বছরে।
যে বিষয়গুলোকে সামনে আনে ‘আপ সরকার’, তা হল শিক্ষাব্যবস্থা, বিজলি-পানির সহজলভ্যতা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মহিলাদের নিরাপত্তা, সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি। সরকারি স্কুল আর শিক্ষার গোটা ধাঁচাটাকেই আমূল বদলে দিয়েছে তারা। রীতিমতো গবেষণা চালিয়ে অবহেলার সরকারি স্কুলগুলোকে আর পাঁচটা নামী-দামি বেসরকারি স্কুলের সমকক্ষ করে তুলেছে শিক্ষা দফতর। সরকারি স্কুলের শ্রীবৃদ্ধি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ আর ছাত্রছাত্রীর ফলাফল নজর কেড়ে নিয়েছে সকলের। এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত অতিশি মারলেনার উদ্ভাবনী শিক্ষাবিজ্ঞানমূলক উদ্যোগ। পানীয় জল পরিষেবা আর বিদ্যুৎ সরবরাহ, দিল্লিবাসীর এই দুই সমস্যা বহু পুরনো— বিশেষত নিম্নবিত্ত আর ঝুগ্গি-ঝোপড়ি বাসিন্দাদের কাছে। সাবেক কালের অনিয়মিত আর অপর্যাপ্ত জল সরবরাহ অনেকটাই সামাল দেওয়া শুধু নয়, মাসে পরিবার-পিছু কুড়ি হাজার লিটার জল বিনামূল্যে সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও রেখেছে আপ সরকার। পূর্ববর্তী সরকারের বিদ্যুৎ সরবরাহ বেসরকারিকরণে যে চড়া মাসুল দিতে হত, অনেক আইনি কাঠখড় পুড়িয়ে তাতে লাগাম টানা শুধু নয়, মাসে দু’শো ইউনিটের কম বিদ্যুতের ভোক্তাদের কাছে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে আম আদমি সরকার। বিজলি-পানি সহজলভ্য করে আর উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার সাহায্যে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে পিছিয়ে থাকা মানুষকে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মহল্লা ক্লিনিক আর মহিলাদের জন্য সরকারি পরিবহণে ফ্রি টিকিট। মহল্লা ক্লিনিক দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেখানে সরকারি ব্যবস্থায় উন্নত মানের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে পাচ্ছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত; মধ্যবিত্তরাও প্রাইভেট ক্লিনিকে জেরবার হয়ে এগুলোকে ভরসা করতে শুরু করেছেন, মূলত মধ্য-নিম্নবিত্ত জনবসতি মহল্লাতেই এই সব কেন্দ্র। কর্পোরেশনের পার্কে ম্যানুয়াল জিম বসিয়ে এই সরকার জনপ্রিয় হয়েছে তাঁদের কাছে, যাঁদের আর টাকা গুনে জিমে যেতে হবে না। নারী সুরক্ষার স্বার্থে সরকার চালু করেছে ‘পিঙ্ক টিকিট’, যাতে সরকারি পরিবহণে মহিলারা বিনা খরচে চলাচল করবেন। যুক্তি হল, মহিলারা যত বেশি করে জনপরিসরে আসবেন তত বেশি নিজেকে এবং পরিবারকে সুরক্ষা দিতে পারবেন, আর্থিক এবং সামাজিক।
জনপরিষেবায় সফল সরকার নির্বাচনের জন্য নিয়ে এসেছে ‘টেন পয়েন্ট গ্যারান্টি কার্ড’। প্রতিশ্রুতির থেকেও জোরদার শব্দ: গ্যারান্টি। চালু পরিষেবাগুলোর উন্নতি ছাড়াও সেখানে আছে পরিবেশ দূষণ কমানো, নারী সুরক্ষায় মহল্লা মার্শাল, ছাত্রদের জন্য ফ্রি পরিবহণ প্রকল্প আর ‘জহাঁ ঝুগ্গি ওয়হি মকান’: বস্তিবাসীদের পাকা বাড়ির গ্যারান্টি।
একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যে ধারাবাহিক ভাবে বাস্তবায়িত করছে আপ সরকার, বিরোধীরা সে সত্যকে এড়িয়ে পপুলিজ়মের কাঠগড়ায় এই সরকারকে বিঁধছে। স্পষ্টতই, সীমিত ক্ষমতায় ছোট রাজ্যে ওয়েলফেয়ার, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের এক ভারতীয় সংস্করণ পরখ করতে চাইছে আপ। লক্ষ্য: ব্যবহারিক স্তরে জীবনযাপনের কিছু মৌলিক চাহিদা সেই মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাঁরা মাঠে ময়দানে জনপথে রাষ্ট্রের থেকে কিছু আশা করেন, আর সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের তাগিদে নির্বাচনের দিনে বুথে বুথে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন।
ঠিক কোন কৌশলে আপ সরকার ব্যতিক্রমী? সুসংগঠিত ক্যাডার নয়, স্বেচ্ছাসেবী ভিত্তিক ‘ক্রাউড সোর্সড’ পার্টি হিসেবেই আপ জনমানসে পরিচিত। নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক আদর্শে আম আদমিকে চিহ্নিত করা যাবে না। বিতর্কিত কাশ্মীর প্রশ্ন থেকে অযোধ্যা রায়— বাকি বিরোধী দলের সঙ্গে গলা মেলাননি কেজরীবাল। কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ক্ষেত্রে আবার সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করেছে আপ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের মতো দেশের মিশ্র জনসমাজে ডকুমেন্টেশনের যে হয়রানি, তাতে আম আদমির মেজাজ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে আসা এই দলের। যদিও একক ভাবে রাজনৈতিক প্রশ্নে দল হিসেবে রাস্তায় নামেনি কেজরীবালের পার্টি। তারা অনেক বেশি সক্রিয় সরকারি প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে বাড়ির দরজায় দরজায় বা ছোট ছোট মহল্লা মিটিংয়ে।
কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনমুখী এই প্রত্যাশিত সাফল্যে গণতন্ত্রের বিকাশ কতটা সম্ভব? বিভিন্ন আদর্শগত প্রশ্নে দেখা গিয়েছে আপ-এর অবস্থান অনেকটাই রক্ষণশীল বয়ানে ভরা। বাইরে থেকে, উন্নত চেতনার বাহক হয়ে কোনও অগ্রণী ভূমিকায় থাকে না এই দল। প্রায় প্রত্যেক জনসভায় আপ-কান্ডারি শুরু করেন ‘ভারতমাতা কি জয়’ স্লোগান দিয়ে, শেষ করেন ‘ইনকিলাব’ স্লোগানে। আবার, এর অন্য ব্যাখ্যাও সম্ভব। সাধারণ মানুষের জীবনবোধ আর অভ্যাসে যে চিহ্নগুলো বহুলব্যবহৃত, তাকে তত্ত্বের অস্ত্রে কাটাছেঁড়া না করে মানুষের মধ্যেই মিশে থাকার রাজনীতি করে আপ। প্রাত্যহিক লোকাচারে, পার্বণে যে সব চিহ্ন সম্বল করে মানুষ পারস্পরিক ভিন্নতার ঊর্ধ্বে উঠে যাপন করে, সেই ‘ভারতীয়ানা’কেই রাজনৈতিক রসদ করতে চায় তারা। সে দিক থেকে তাদের আচরণকে কট্টর সাম্প্রদায়িক কব্জা থেকে ‘ভারতমাতা’-কে পুনরুদ্ধারের একটা চেষ্টা হিসেবেও দেখতে পারি।
গণতন্ত্র কোনও সীমিত ধারণা বা প্রত্যয় নয়। ঐতিহাসিক ভাবেই গণতন্ত্রের পরিধি অকপট, প্রশস্ত। বৃহত্তর সমাজে আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ আর শামিল হওয়ায় ক্রমাগত তার বিস্তার। নয়া সময়ের নয়া সমাজে গণতান্ত্রিকতার বড় উপাদান হল কৌশলগত উন্নয়ন। গবেষণার মাধ্যমে বিকল্প কৌশল বাছাই আর ঠিক সেই খাতেই সম্পদ বণ্টন, যেখান থেকে তুলে নেওয়া সম্ভব সর্বাধিক ফসল। সংসদীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আপ এই ভাবে ‘নিউ এজ’ পার্টি হতে চাইছে। উল্টো দিকে এই কৌশলী প্রয়োগের যাঁরা ভোক্তা, অর্থাৎ ভোটার সমাজ, তাঁরাও সহজাত কৌশলগত পছন্দ প্রয়োগ করেন নির্বাচনী বুথে।
গোটা ভারতবর্ষের বৈধ ভোটারের মাত্র দুই শতাংশ যে ভোটদানে অংশগ্রহণ করবেন ৮ ফেব্রুয়ারি, তার সামগ্রিক গুরুত্ব তাই ওই অনুপাতের চেয়ে অনেক বেশি। যে ভাবে আধিপত্যবাদ সংসদীয় গণতন্ত্রে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, সেখানে কিছুটা আশার আলো দেখাতে পারে বিকল্প স্বর, দিল্লি রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলে।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়