বাংলার জন্য বার্তা
AAP

আপ-এর ভোটকৌশল থেকে রসদ মিলতে পারে তৃণমূল কংগ্রেসেরও

অরবিন্দ কেজরীবালের দলই যে ক্ষমতায় ফিরবে, সেই হাওয়া ভোটের আগে মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল। পরে বুথফেরত সমীক্ষাতেও তা উঠে আসে।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:৪০
Share:

ছবি: সংগৃহীত

দিল্লির এই নির্বাচনী ফল কি খুব অপ্রত্যাশিত? সম্ভবত নয়। অরবিন্দ কেজরীবালের দলই যে ক্ষমতায় ফিরবে, সেই হাওয়া ভোটের আগে মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল। পরে বুথফেরত সমীক্ষাতেও তা উঠে আসে। আগ্রহ ছিল আসনসংখ্যা নিয়ে। কেজরীবালের আম আদমি পার্টি কত আসন পেতে পারে, বিজেপি কুড়ি-পঁচিশটি আসন পেতে পারে কি না, চর্চার অভিমুখ ছিল এই সব। ঝাড়ু-ঝড়ে পদ্ম সাফাই তারও উত্তর দিয়েছে।

Advertisement

দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কোনও রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনই রাজনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে লোকসভা ভোটে বিজেপির ‘অভাবিত’ সাফল্যের অব্যবহিত পর থেকেই বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে তাদের পরাজয় ঘটে চলেছে। দিল্লি সেই তালিকায় নবতম সংযোজন।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গোটা দেশ নাগরিকত্ব আন্দোলন ঘিরে যে ভাবে উত্তাল হয়েছে, সিএএ-র বিরোধিতায় এবং এনআরসি রুখতে প্রতিবাদ যে ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে সংহত ও আপসহীন চেহারা নিয়েছে, তাতে দেশের ‘একচ্ছত্র’ শাসক বিজেপির প্রতি জনগণের একটি অংশের মনোভাব খুব স্পষ্ট। অনেকের মতে, এই নির্বাচনের রায়ে তা-ও অনেকটা প্রতিফলিত হচ্ছে। সেই দিক থেকে ধরলে দিল্লির এই ফল যতখানি কেজরীবালের কর্মধারার পক্ষে, বিজেপির বিরুদ্ধে তার চেয়ে কম কিছু নয়।

Advertisement

একটি ভোটের রায়কে কোনও একক তত্ত্বের উপর দাঁড় করানো কত দূর সঙ্গত, সেটা অবশ্যই বিতর্কসাপেক্ষ। তবু জয়-পরাজয়ের প্রাথমিক কারণ খুঁজতে গেলে হাতের কাছে বড় ইসুই আগে নজরে আসে। তাই দিল্লির রায়কে নাগরিকত্ব আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেখলে হয়তো ভুল হবে না।

সে যা-ই হোক, দিল্লির এই ফল বাংলার পক্ষে নানা ভাবে অর্থবহ। শুধু আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের জন্যই নয়, আসন্ন পুরসভা-নির্বাচনগুলির জন্যও দিল্লির জনমত বাংলার জন্য কিছু বার্তা দেয়। শাসক তৃণমূলের নিরিখে যা প্রাসঙ্গিক। এক এক করে বিষয়গুলি দেখা যাক।

গত লোকসভা নির্বাচনের ফল বিবেচনায় রাখলে দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবালের অবস্থা ছিল শোচনীয়। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিজেপির কাছে ১৮টি আসন খুইয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন। বিধানসভা আসনের হিসেবে তাঁদের পিছিয়ে পড়া আসনের সংখ্যা কমবেশি ১২৬। তবু লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তৃণমূলই দখলে রেখেছে। ফলে বিধানসভা আসনের অঙ্কেও মোটের উপর তারা এগিয়ে। দিল্লি তুলনায় অনেক ছোট হলেও রাজনৈতিক গুরুত্ব বিচারে ফেলনা নয়। সেই দিল্লিতে লোকসভার ফলের ভিত্তিতে হিসেব করলে কেজরীবালের দল একটি বিধানসভা আসনেও এগোতে পারেনি। ৭০টি বিধানসভা কেন্দ্রের ৬৫টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। পাঁচটিতে কংগ্রেস।

কিন্তু এখন বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হওয়ার পাশাপাশি বিজেপি এবং আপ-এর পারস্পরিক অবস্থান কার্যত বদলে গেল। আপ ৬২ আসন দখল করল। বিজেপি আটকে গেল আটে।

এই রাজ্যের মতো দিল্লিতেও শাসক দলের পরামর্শদাতা ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। লোকসভা ভোটের ফল দেখার পরে তাঁকে বাংলায় এনেছেন মমতা। আর দিল্লির ভোটে কেজরীবালের ‘রণনীতি’ চূড়ান্ত করে ছকে বেঁধে দেওয়ার কাজ করেছেন পিকে।

দিল্লির ক্ষেত্রে একটি বিষয় নজর এড়ায় না। তা হল, প্রচারপর্বে ক্ষমতাসীন আপ কিন্তু স্থানীয় বিষয়গুলিকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। সিএএ, এনআরসি-র মতো জাতীয় বিষয়গুলি ছিল অপেক্ষাকৃত পিছনে। বড় জায়গা নিয়েছিল দিল্লির জল-আলো-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবেশ ইত্যাদি। আর ছিল স্বচ্ছতার দাবি। অনেকে এমনও বলেছেন, কেজরীবাল যেন পুরনির্বাচন লড়তে নেমেছেন!

প্রচারের মঞ্চেও কেজরীবাল স্থানীয় অর্থাৎ নিজেদের লোকেদের উপরেই প্রধানত নির্ভর করেছেন। বড় বড় বিরোধী নেতা বা মুখ্যমন্ত্রীদের দিয়ে প্রচার করায়নি আপ।

অন্য দিকে বিজেপি তাদের প্রচারে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ থেকে শুরু করে তাবড় নেতা ও দলীয় মুখ্যমন্ত্রীদের মিছিল লাগিয়ে দিয়েছিল। সেখানে শাহিন বাগ অবস্থানের মুণ্ডপাত, সিএএ-এনআরসি-র জয়গান, প্রতিবাদীদের হুমকি দিয়ে ‘দেশছাড়া’ করার ভয় দেখানো কিছুই বাদ যায়নি।

এ বার যদি ধরে নেওয়া যায়, দিল্লির সরকারের উন্নয়ন ও সাফল্যের দাবি এবং ফিরে এলে আরও কী কী করবেন, সেই প্রতিশ্রুতি মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে, তবে অবশ্যই এই নির্বাচনী জয়ের একটি উত্তর মিলবে। এই জন্য বিজেপি বিরোধী হয়েও কংগ্রেস জনগণের আস্থা অর্জনে একশো ভাগ ব্যর্থ হয়েছে।

আবার এটাও ঠিক, দেশে— আরও সঠিক ভাবে বললে খাস দিল্লিতে— লাগাতার নাগরিকত্ব আন্দোলনের তীব্রতা, ও পাশাপাশি সেই প্রতিবাদের আবহকে বিজেপি যে ভাবে দমন করতে চায়, তার ভীষণতা, এ সবেরও একটি সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া মানুষ এই ভোটে দিয়েছে। নইলে বিজেপির বিপর্যয় এতটা পাতালগামী হত না। ফল দেখে বোঝা যায়, জনগণ মনস্থির করে নিয়েছিল, বিজেপিকে তারা মাথা তুলতে দেবে না। দিল্লির রায়কে তাই উন্নয়ন ও বিজেপি-দমন দুইয়ের মিলিত ফসল বললে ভুল হবে না। মানুষ কেজরীবালের সরকারের উপর আস্থা রেখেছে। আবার বিজেপিকে বর্জন করার স্পষ্ট ঘোষণাও করেছে।

এখানেই এসে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের কথা। নাগরিকত্ব আন্দোলনে মমতা এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম প্রধান মুখ। সবাই জানেন, অসমে খসড়া নাগরিক পঞ্জি প্রকাশের সময় থেকে তিনি প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। একের পর এক ধাপ পেরিয়ে এখন সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-এর বিরোধিতায় তাঁর লড়াই অনেক বড় আকার নিয়েছে। তিনি নিজেও পথে নেমে এসেছেন।

কেউ কেউ মমতার এই প্রতিবাদের নেপথ্যে মূলত সংখ্যালঘু ভোটের অঙ্ক দেখতে পান। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তা বলে না। সিএএ-র কবলে সংখ্যালঘুদের বিপাকে পড়ার আশঙ্কা হয়তো বেশি। কিন্তু এনআরসি? সেই উদ্বেগ তো শুধু সংখ্যালঘুদের নয়। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের উপর চাপ। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা ভাবের ঘরে চুরি করে এখন বিষয়টি যতই ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করুন, এনআরসি হবে না, এমন কোনও নির্দিষ্ট ঘোষণা কেন্দ্র করেনি। ফলে খাঁড়া ঝুলছেই। মমতার লক্ষ্য, সেই শঙ্কাকে প্রতিবাদে টেনে আনা।

এই পরিস্থিতিতে দিল্লির রায় যে বার্তা দিল, তাতে আগামী দিনে এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেও নাগরিকত্ব আন্দোলন যে নিশ্চিত ভাবে প্রভাব ফেলবে, তা বলা বাহুল্য।। এর জন্য কোনও পরিকল্পনার প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক গতিতেই বিষয়টি সামনে আসবে। মমতাও তা পূর্ণোদ্যমে কাজে লাগিয়ে যাবেন। ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর দিল্লির জনমত দেখে ভারতের ‘অন্তরাত্মা সুরক্ষিত’ হল বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থ পরিষ্কার।

তবে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলি কেজরীবালের নির্বাচনে যে ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, সেটাও মমতার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। আসন্ন পুরভোটে তার একটি বড় পরীক্ষা হবে।

উন্নয়নের সাফল্য ঘটলে সুফল মিলতে থাকে তৃণমূল স্তর থেকে। মমতা এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বার বার এ নিয়ে তিনি দল ও প্রশাসনকে সজাগ করেন। প্রয়োজনে তিরস্কারও। ‘অল ইজ় নট ওয়েল’ বুঝে লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলাও করার চেষ্টা করছেন তিনি। ভোটকুশলী পিকে-র পরামর্শে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির মাধ্যমে একেবারে নিচুতলার অভাব-অভিযোগ জানা এবং তার নিরসনের উদ্যোগ কিছুটা হলেও কাজে এসেছে। সেই সঙ্গে বাড়তি নজর পড়েছে স্বচ্ছতার উপর।

কতটা কী হল, তার কিছু আভাস পুরভোটের ফল থেকে মিলতে পারে। রাজ্যের যে ১২৬টি পুরসভায় ভোট হবে, তার জনসমষ্টি সামগ্রিক ভোটার সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তো বটেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা হল, তিনি তৃতীয় বার সরকার গড়তে চেয়ে ভোটে যাওয়ার আগেই অবস্থা বুঝে নেওয়ার একটি সুযোগ পাচ্ছেন।

তবে হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে নিজহস্তে নির্দয় আঘাত করার কাজটিও তাঁকেই করতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement