ছবি: সংগৃহীত
মঙ্গলবার যখন অরবিন্দ কেজরীবাল ও তাঁর দলের প্রার্থীরা ‘ঝাড়ু’ হাতে দিল্লির মহল্লা থেকে মহল্লায় ‘পদ্ম’-বন সাফ করছিলেন এবং প্রায় গোটা দিল্লির আমজনতা তাঁর জন-বিকাশমুখী সরকারের তৃতীয় সূচনার আনন্দে তীব্র উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন, তখন একটা ঈষৎ-প্যাঁচালো প্রশ্ন মনে ঘুরঘুর করছিল। এই উল্লসিত শব্দের ডেসিবেলের মাত্রা কোথায় বেশি হচ্ছিল, শাহিন বাগে? না কি, সেই হনুমান মন্দির চত্বরে, যেখানে ‘হনুমান চালিশা’ আবৃত্তি করতে করতে ‘আপ’-অধিনায়ক ভোটের দিন ‘দর্শন’ করতে গিয়েছিলেন? যদি উত্তর হয়, ‘দুই জায়গাতেই’, তবে বুঝতে হবে, ভারতীয় রাজনীতির গত ছ’-সাত বছর চলে আসা আখ্যানে একটা পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে, যেখানে ‘শাহিন বাগ’ ও ‘হনুমান মন্দির’ পরস্পরের বিপ্রতীপ বা ‘শত্রু’ নয়, দুটোই একই সঙ্গে ‘সহাবস্থান’ করতে পারে। তাত্ত্বিক ভাষায় একেই বলে ‘রাজনৈতিক মধ্যপন্থা’। স্বাধীনতার পর প্রায় সাত দশক এই পরিসর ও রাজনীতির ইজারা জাতীয় কংগ্রেসের নেওয়া ছিল, এবং মোদী-শাহ জুটির প্রবল উত্থানে যে পরিসরটি ক্ষয়ে লোপ পেতে বসেছিল— সেই ‘রাজনৈতিক মধ্যপন্থা’র নবসূচনা হল দিল্লির ভোটে।
কংগ্রেসের ঘর শূন্য করে তাদের ভোটারেরা হয় আপ নয়তো বিজেপির ঘর ভরেছে। যেখানে কংগ্রেস লড়াই করেছে, সেখানে বিজেপির সুবিধা হয়েছে। দিল্লির অভ্যন্তরের চেয়ে পরিসীমায় শক্তি বৃদ্ধি করে, বিজেপি গত বারের চেয়ে আপ-এর সঙ্গে অনেক বেশি জুঝেছে, কিন্তু মধ্যবিত্ত-অধ্যুষিত অঞ্চল, নিম্নবিত্ত ও দলিতদের মধ্যে আপ-এর সাফল্য আকাশ-ছোঁয়া। কিছুটা অন্য প্রবণতা দেখা গিয়েছে ওখলা কেন্দ্রে, যার মধ্যে আছে শাহিন বাগ।
তার মানে এই নয় যে কেবল রাজনৈতিক স্থানাঙ্ক নির্ণয়ই দিল্লির নির্বাচনের মোদ্দা কথা। অবশ্যই, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিষেবায় ‘মহল্লা ক্লিনিক’, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উন্নতি, নারী সুরক্ষার উদ্যোগের মতো বহু জনমুখী পরিষেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় আপ-সরকারের সাফল্য চোখে পড়ার মতোই। কিন্তু এর সঙ্গেই ছিল ‘পরিবার কা বড়া বেটা’ হিসেবে কেজরীবাল-এর বয়স্কদের নিখরচায় নানা হিন্দু ‘ধাম’-এ ‘তীর্থযাত্রা’য় পাঠানোর উদ্যোগ। তার সঙ্গে, প্রতিটি সভার শুরুতে ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনি দেওয়া; কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, কাশ্মীরি নেতাদের আটক কিংবা, সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) ‘বাতিল’ বিষয়ে একটি কথাও উচ্চারণ না করা; শাহিন বাগে নাগরিকত্ব বিষয়ক আন্দোলনে অবস্থানরত মুসলিম নারীদের সমাবেশে এক বারও না-যাওয়া, বা বালাকোট-কাণ্ডের পর পাকিস্তানকে ‘যোগ্য জবাব’ দেওয়ার পক্ষে জোর সওয়াল করা, এই সবও আছে।
এক দিকে জনসাধারণের জন্য জনপ্রিয়তাবাদী কল্যাণকর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা, বিদেশি ‘শত্রু’দের বিরুদ্ধে অনমনীয় (কখনও ‘জঙ্গি’) মনোভাব— এটাই ১৯৬২-র ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে ভারত সরকার ও কংগ্রেস দলের ‘লাইন’। তখন দেশের নাগরিক বা শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ‘শত্রুদের বিরুদ্ধে’ রণহুঙ্কার ও নানা সাংস্কৃতিক রূপে, যেমন, রেডিয়োর গানে বা শিল্পীর ছবিতে, তাকেই জনমনে প্রতিষ্ঠার অন্ত ছিল না। একটু বয়স্কেরা শৈশবের স্মৃতি হাতড়ালে মনে করতে পারবেন, ১৯৬২-র সংঘাতের আবহাওয়ায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘‘বুদ্ধ-গান্ধী-বিবেকানন্দ-বিশ্বকবির মহান দেশে/আজ শান্তির মহান পতাকা, কেড়ে নিতে চায় শত্রু এসে’’; বা একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে একই শিল্পীর গান ‘‘মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি...’’ ইত্যাদি। বা, জরুরি অবস্থার হাঁসফাঁসে অবস্থায়, যখন বাসে বাসে লেখা থাকত ‘‘কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই’’ (যার প্রতি তীব্র শ্লেষে শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষ ‘বিকল্প’ নামক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘‘কঠোর বিকল্পের পরিশ্রম নেই!’’) মকবুল হুসেনের আঁকা ‘দুর্গা’-রূপী ইন্দিরার ছবি! ষাট থেকে আশির দশকের বহু জনপ্রিয় বলিউডি ছবিরও এটাই মুখ্য প্রতিপাদ্য। এই যে ভিতরে জনকল্যাণ নীতি ও মোটের ওপর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ‘মিঠে’ সুবাতাস ও জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে দেশের ‘ভিতরে’ ও ‘বাইরে’ ঝাঁজালো ‘কড়া’ মূর্তি, পোখরানে প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ, গণভোটে সিকিমের ভারতভুক্তি, শিখ জঙ্গিপনা রুখতে অমৃতসরে ‘অপারেশন ব্লু-স্টার’ প্রভৃতি যার সাক্ষ্য, এই জাতীয়তাবাদী আখ্যানের কপিরাইট কংগ্রেসের একচেটিয়া ছিল, রামমন্দির আন্দোলনের আগে অবধি।
’৯০-দশকের শুরু থেকে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন, চরমপন্থী ইসলামের স্ফুরণ ও নব্য উদারবাদী বিশ্বায়নের আবহে যে জাতীয়তাবাদী মধ্যপন্থাটি ক্রমশ স্থানাঙ্ক বদলে দক্ষিণমুখী হতে শুরু করে। ভারতীয় জনতা পার্টি প্রায় তিন দশক ধরে কংগ্রেস ঘরানার পরিচিত মিঠেকড়া মধ্যপন্থাকে কোণঠাসা করে কোনও লুকোছাপা না করে সদম্ভে আগ্রাসী সংখ্যাগুরু-প্রধান রাজনীতির মডেলটি সামনে নিয়ে এসেছে।
ফলে, রাজনীতির ভাষাও পাল্টেছে। প্রথমে কিছুটা যুক্তি-তর্কের সুযোগ থাকলেও ক্রমশ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে হিংস্র, ঘৃণাভিত্তিক ও প্রতিশোধপরায়ণ। যে হেতু, এই রাজনীতির অভীষ্ট লক্ষ্য সংখ্যাগুরুর একত্রীকরণ, তাই ‘বাইরের শত্রু’ হলেই কাজ চলে না, দেশের ভিতরেও ‘শত্রু’ খুঁজতে হয়। প্রধান সংখ্যালঘুরাই (মুসলিমেরা) হয়ে ওঠে জাতির অঘোষিত শত্রু। ‘পাকিস্তান’ আর দেশের ‘বাইরে’ থাকে না, দেশের ভেতরেই ছোট-বড় (শাহিন বাগের মতো) ‘পাকিস্তান’ চিহ্নিত হয়, নেতারা বলতে থাকেন ‘গোলি মারো শালো কো’, বন্দুক হাতে তরুণ তেড়ে যায় সংখ্যালঘুর প্রতিবাদী জমায়েতে।
কিন্তু এই যে প্রতি দিন কথাবার্তায়, স্লোগানে, শরীরী ভাষায় ও কার্যকারিতায় হিংসা ও ঘৃণার প্রকাশ ও বিস্তার, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যদি এই বিদ্বেষের সঙ্গে বিকাশ ও সমৃদ্ধির অনুপান যুক্ত হত, তা হলেও হয়তো এই রাজনীতি দীর্ঘকালীন সাফল্য পেতে পারত, কিন্তু গত কয়েক মাসে দেশের অর্থনীতিতে হাঁড়ির হাল, জিডিপির গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী, চাকরি নেই, কৃষির অবস্থা শোচনীয়। ফলে, নাৎসি-শাসিত জার্মানিতে যে ভাবে সার্বিক আর্থিক সচ্ছলতার আবহে
(যখন, অধিকাংশ পশ্চিমি দেশই আর্থিক ‘মন্দায়’ কাবু) ইহুদিবিরোধী ঘৃণার রাজনীতির দীর্ঘকালীন
চাষ সম্ভব হয়েছে, ভারতে দীর্ঘদিন অর্থনীতির এই করুণ অবস্থায় তা সম্ভব নয়। তাই, এই বিদ্বেষী রাজনীতির ভাঁড়ার এক সময় নিঃশেষ হবে। অধিকাংশ মানুষ হয়তো ‘শাহিন বাগ’কে সমর্থন করবে না, জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারেও ‘আপস’ চাইবে না, কিন্তু তারা প্রতি দিনের রণরক্তমত্ততার বদলে মোটের ওপর শান্তি ও সম্প্রীতি চাইবে এবং চাইবে, তাদের জীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও পানীয় জল-সহ মৌলিক পরিষেবায় সরকারের অগ্রণী ভূমিকা অটুট থাকুক।
দিল্লিতে আপ রাজ্য-স্তরে কংগ্রেসের ফেলে যাওয়া এই শূন্যস্থান পূরণ করতে চাইছে। আপ-এর এই জনপ্রিয়তাবাদী মধ্যপন্থার অবশ্যই কিছুটা দক্ষিণমুখী ঝোঁক আছে, যার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খানিকটা বামঘেঁষা জনপ্রিয়তাবাদী মধ্যপন্থার বেশ কিছু পার্থক্য আছে, তবে সেই পার্থক্য অনেকটাই বাংলা ও উত্তর ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পার্থক্যের মধ্যেই নিহিত। তবে, বিরোধী দলগুলির এটা বোঝার সময় এসেছে যে বিজেপির আগ্রাসী দক্ষিণপন্থার মোকাবিলা করতে তার উল্টো ‘বামপন্থী’ অবস্থান নিয়ে বিশেষ লাভ নেই। বামপন্থীদের কাজ বামপন্থীরাই করুক, কিন্তু তাই বলে ভারতীয় রাজনীতির মধ্যবর্তী পরিসরটি ছেড়ে দেওয়া কেবল দলের জন্য নয়, ‘ভারত’ নামক বহুত্ববাদী অথচ সম্পৃক্ত ধারণাটির পক্ষেও বিশেষ শুভ নয়। আপ-এর চমকপ্রদ তৃতীয় বার দিল্লিবিজয় সশব্দে এই বার্তা ছড়িয়ে দিল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়