—ফাইল চিত্র
জীবনের আট দশক পূর্ণ করিবার প্রাক্কালে, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে রবীন্দ্রনাথ যে প্রবন্ধটির রচনা সম্পন্ন করেন, তাহার সীমিত পরিসরে কবি শান্তিনিকেতনে তাঁহার ‘আশ্রম’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, সেই প্রতিষ্ঠানের আদর্শ এবং সেই আদর্শের সহিত আপন জীবনদর্শন ও জীবনচর্যার গভীর সংযোগ লইয়া কিছু কথা লিখিয়াছিলেন। তাহার অনেক কথাই তিনি আগেও বলিয়াছেন, কিন্তু জীবনসায়াহ্নের এই প্রবন্ধটিতে তিনি স্পষ্টতই সিংহাবলোকনে একটি সামগ্রিক ছবি আঁকিতে চাহিয়াছিলেন। সঙ্গত কারণেই এই প্রবন্ধ তাঁহার বিদায়ের প্রায় দুই বছর পরে সঙ্কলিত আত্মপরিচয় গ্রন্থের শেষ লেখা হিসাবে নির্বাচিত হয়। লেখাটি এই মুহূর্তে নূতন করিয়া পড়িবার কারণ আছে। শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী তাঁহার এক বৃহৎ স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সার্থক করিবার পথে ক্ষুদ্র সমাজের বাধাবন্ধ লইয়া আপন আক্ষেপ তিনি এই প্রবন্ধে গোপন রাখেন নাই, গভীর বেদনার সহিত জানাইয়াছেন— অন্তরের উদয়াচলে যে জ্যোতিপ্রবাহ তিনি এক দিন অনুভব করিয়াছিলেন, প্রাত্যহিক জীবনের মলিনতায় তাহা কেমন করিয়া অনতিবিলম্বে বিলীন হইয়া গেল। কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো তাঁহার ধর্মে সহিতে পারে না, সুতরাং তিনি আশা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানের ‘মূলতত্ত্ব’ একেবারে বিলুপ্ত হইবে না। এই আশার পিছনে ছিল তাঁহার নিজের সাধনা ও উদ্যোগের প্রতি এক নির্মল শ্রদ্ধা। সেই অপূর্ব আত্মপ্রত্যয়ের উৎসটিকে প্রবন্ধের উপসংহারে অমোঘ নৈপুণ্যে জানাইয়া দেয় একটিমাত্র বাক্য: ‘‘সকল জাতির সকল সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণে এখানে আমি শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত রাখবার শুভ অবকাশ ব্যর্থ করি নি।’’
এই বাক্যটির তাৎপর্য সম্যক বুঝিতে সাহায্য করে ইহার দুই দশক পূর্বের একটি লেখা। বিশ্বভারতীর সূচনা হইবার পরে রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রিত হইয়া আপন শিক্ষা-চিন্তা ব্যাখ্যা করেন। সেই চিন্তার ‘মর্ম’ স্বরূপ রচিত তাঁহার একটি স্বল্পকায় প্রবন্ধ শান্তিনিকেতন পত্রের ১৩২৬ বৈশাখ সংখ্যায় ‘বিশ্বভারতী’ নামে প্রকাশিত হইয়াছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, ‘‘সেই শিক্ষাই আমাদের দেশের পক্ষে সত্য শিক্ষা যাহাতে করিয়া আমাদের দেশের নিজের মনটিকে সত্য আহরণ করিতে এবং সত্যকে নিজের শক্তির দ্বারা প্রকাশ করিতে সক্ষম করে।’’ এই সত্য শিক্ষার অভাব তাঁহাকে কেবল পীড়া দেয় নাই, তাঁহার সংবেদী মনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করিয়াছে। উদ্বেগ অতি স্বাভাবিক, কারণ এই অভাবের পিছনে সর্বব্যাপী বিচ্ছেদের ও বিভাজনের দুর্গ্রহকে চিনিতে তিনি ভুল করেন নাই। স্বভাবসিদ্ধ প্রজ্ঞার অক্ষরে তাঁহার রোগনির্ণয়: ‘‘অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে এক-চেতনাসূত্রের বিচ্ছেদই সমস্ত দেহের পক্ষে সাংঘাতিক। সেইরূপ, ভারতবর্ষের যে মন আজ হিন্দু বৌদ্ধ জৈন শিখ মুসলমান খৃস্টানের মধ্যে বিভক্ত ও বিশ্লিষ্ট হইয়া আছে সে মন আপনার করিয়া কিছু গ্রহণ করিতে বা আপনার করিয়া কিছু দান করিতে পারিতেছে না।’’ এই পরিপ্রেক্ষিতেই শান্তিনিকেতনে ‘সকল জাতির সকল সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণে... শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত’ করিবার সঙ্কল্প গভীর অর্থ পরিগ্রহ করে, বিশ্বভারতীর ধারণায় মূর্ত হয় এক অনন্য সভ্যতার সন্ধান, যে সভ্যতা বিভক্ত ও বিশ্লিষ্ট ক্ষুদ্রসত্তাগুলিকে বৃহৎ চেতনাসূত্রে গাঁথিয়া ভারততীর্থ রচনা করে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁহার সচেতন কর্মময় জীবনে এই বৃহত্ত্বের সাধনা করিয়া গিয়াছেন। বিশ্বভারতী সেই সাধনার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিসর এবং প্রকরণ। এই প্রতিষ্ঠান ও তাহার সংশ্লিষ্ট বিবিধ কর্মকাণ্ডকে প্রচলিত অর্থে নিছক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখিলে কেবল তাহার স্রষ্টার প্রতি অবিচার হয় না, আরও অনেক বড় অবিচার হয় এক অসামান্য সম্ভাবনার প্রতি। উত্তরণের সম্ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, সেই সম্ভাবনা উত্তরোত্তর দূরবর্তী হইয়াছে, বিশ্বভারতী ক্রমশই স্বধর্ম হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছে। বৃহত্তর বঙ্গসমাজ এবং তাহার সাংস্কৃতিক জগতের মানসিক অবক্ষয়ের সহিত সমান্তরাল ভাবে এই প্রতিষ্ঠানের গৌরবহানির ইতিহাস সুবিদিত। কিন্তু বহু বিচ্যুতি সত্ত্বেও এত দিন একটি বৃহৎ আদর্শের ধারণা তাহাকে ঘিরিয়া বিরাজমান ছিল, ছিল বলিয়াই বিচ্যুতির বোধটিও একেবারে হারাইয়া যায় নাই। আজ সেই শিকড়টিই বিনষ্ট হইতে বসিয়াছে, বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকট হইয়া উঠিতেছে এক অকল্পনীয় সঙ্কীর্ণতা এবং বিদ্বেষের মূর্তি। শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত রাখিবার অবকাশটুকুও বোধ করি এই বার বিলীন হইবে। বিশ্বভারতী হইতে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ বিদায় লইবেন।