সম্পাদকীয় ২

ধোঁকার টাটি

লান্সনায়েক হনমানথাপ্পা কোপ্পড তাঁহার জীবৎকালে সম্ভবত কখনও অনুমান করেন নাই, দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁহার নাম জানিবেন। তাঁহার মৃত্যু প্রধানমন্ত্রীকে ‘বিষণ্ণ ও বিপর্যস্ত’ করিবে। তাঁহার জানিবার কথাও নহে। কারণ, যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন, তত দিন তিনি ছিলেন নিতান্তই এক সাধারণ সৈনিক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০১
Share:

লান্সনায়েক হনমানথাপ্পা কোপ্পড তাঁহার জীবৎকালে সম্ভবত কখনও অনুমান করেন নাই, দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁহার নাম জানিবেন। তাঁহার মৃত্যু প্রধানমন্ত্রীকে ‘বিষণ্ণ ও বিপর্যস্ত’ করিবে। তাঁহার জানিবার কথাও নহে। কারণ, যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন, তত দিন তিনি ছিলেন নিতান্তই এক সাধারণ সৈনিক। মৃত্যু তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রীর চক্ষে ‘ভারতমাতার বীর সেনানী’ করিয়া তুলিয়াছে। ব্যক্তি হিসাবে তিনি দেশের কর্ণধারদের নিকট যতখানি সাধারণ ছিলেন, মৃতদেহ হিসাবে ততখানিই অসাধারণ। কারণ, আবেগ জাগাইয়া তুলিতে মৃত্যুর মার নাই। ফেসবুক-টুইটারেও সেই আবেগের বান ডাকিয়াছে। তিনি অথবা তাঁহার সহকর্মীরা হয়তো সত্যই বীর, কিন্তু সিয়াচেনের মৃত্যু উপত্যকায় তাঁহারা বীরত্বের কারণে যান নাই। সেনাবাহিনীতে তাঁহাদের চাকুরিই তাঁহাদের সেখানে পাঠাইয়াছিল। আবেগ আসিয়া সত্যকে লইয়া গিয়াছে, নচেৎ রাজনীতিকরা বলিতেন, সিয়াচেনের কৌশলগত উচ্চ অবস্থানটি রক্ষা করিতে প্রয়োজনে আরও অনেক হনমানথাপ্পাকে বলি দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের আপত্তি থাকিবে না। কয়েক জন সৈনিকের জীবন অপেক্ষা সেই স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানটির গুরুত্ব রাষ্ট্রের নিকট বেশি। সত্যটি কঠোর, এবং তিক্ত। কিন্তু, তাহাকে ঢাকিতে প্রধানমন্ত্রী মৃত সৈনিকের বীরত্বের মাহাত্ম্য গাহিতে আরম্ভ করিলে তাহা নিতান্ত নাটুকেপনা বই আর কিছু নহে।

Advertisement

উগ্র জাতীয়তাবাদের সওদাগরদের নিকট হনমানথাপ্পার ‘শহিদ’ হওয়া বহু ভাবে লাভজনক। দেশপ্রেম কাহাকে বলে, তাহার একেবারে হাতেগরম উদাহরণ হিসাবে তাঁহাকে ব্যবহার করা চলে। জেএনইউ-এর ‘দেশদ্রোহী’দের শিক্ষা দিতে এমন উদাহরণ যত মিলিবে, ততই ভাল। যে কোনও দেশেই যেহেতু বেশির ভাগ মানুষের স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা নাই, তাহাদের জাতীয়তাবাদের কড়া আরক গিলাইয়া দেওয়া সহজ। কারণ, এই আখ্যানে বিশ্বাস করিতে যুক্তির প্রয়োজন নাই, আবেগই যথেষ্ট। হনমানথাপ্পাদের ‘শহিদ’ আখ্যা দিয়া দেশের স্বার্থে তাঁহাদের ‘বলিদান’কে যথেষ্ট গৌরবান্বিত করিয়া তুলিতে পারিলে আরও একটি সুবিধা— এই মওকায় তাঁহাদের আত্মসাৎ করিয়া ফেলা চলে। সিয়াচেনে হনমানথাপ্পাদের মৃত্যু যদি সত্যই বলিদান হয়ও, তাহাতে যে নরেন্দ্র মোদীর বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব প্রাপ্য নহে, বরং সেই মৃত্যুর দায় কার্যত তাঁহাদের, এই কথাটি অবলীলায় চাপিয়া যাওয়া যায়। কেন তাঁহাদের এই ভাবে মরিতে হয়, মৃত্যুটি উদ্‌যাপিত হইলে আর সেই প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। যে মৃত্যুর এত গুণ, তাহাকে কি হেলায় বহিয়া যাইতে দেওয়া চলে? প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি বোঝেন, অতএব সেই ভুল তিনি করেন নাই।

তবে, তাঁহার তরফেও একটি যুক্তি পেশ করা সম্ভব। সেনাবাহিনীকে যদি ধরিয়া রাখিতে হয়, তবে এই আবেগই ভরসা। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, সেনাবাহিনীর চাকুরি আর পাঁচটি পেশার মতোই। নচেৎ, যোগ্য কর্মী খুঁজিতে বিজ্ঞাপনের এত ঘনঘটার প্রয়োজন পড়িত না। সেই পেশায় যদি কাহাকে সজ্ঞানে মৃত্যুর মুখে দাঁড়াইতে হয়, কোন যুক্তি তাঁহাদের সম্মতি আদায় করিবে? যুক্তি যেখানে ব্যর্থ হয়, সেখানেই আবেগের মাহাত্ম্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন ‘শহিদ’-এর মৃত্যুতে শোকার্ত হন, তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে সেই আবেগ সঞ্চারিত হয় বইকী। এই আবেগটি না থাকিলে সেনাবাহিনী অচল হইত। কাজেই, আবেগের অতিনাটকই ভরসা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement