তবলিগি জামাত আর মুসলমানকে এক করে দেখলে বিরাট ভুল হবে। তবলিগি জামাত দেশের সব মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে না। করোনা প্রতিরোধের বিরোধিতা করে ‘সরকারের, এমনকি ডাক্তারদের পরামর্শ’ অগ্রাহ্য করে তবলিগিরা যে ভাবে মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন, তা মুসলমান সমাজ মেনে নেয়নি।
সুন্নি মুসলমানদের একটি অতীতমুখী সংস্কার আন্দোলনের নাম ‘তবলিগি জামাত’। আরবি ‘তবলিগ’ শব্দের অর্থ প্রচার। জামাত হল সমাবেশ। মুসলমানদের ‘প্রকৃত’ মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কোনও মসজিদকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত স্তরে প্রচার চালায় তবলিগি জামাত। তারা মুসলমানকে এমন একটা ধর্মীয় সমাজ ফিরিয়ে দিতে চায়, যে সমাজ ছিল মদিনায় নবি মুহাম্মদের সময়ে। বিশেষত ধর্মাচরণ, পোশাক এবং ব্যক্তিগত আচরণে তা প্রতীয়মান হবে। ধর্মীয় চর্চার মাধ্যমে একটি শুদ্ধ ইসলামি জীবন গঠনের মধ্যে দিয়ে বর্তমান সমাজকে বদলে ফেলতে চায় তারা।
তবলিগিরা ‘আখেরাত’ অর্থাৎ মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের ওপর বিশেষ জোর দেয়। এমনই বিশুদ্ধ ইসলামি জীবন ইহকালে যাপন করতে হবে যে, আখেরাতে (শেষ বিচারের দিনে) তার যেন জন্নত (স্বর্গ) নিশ্চিত হয়। তবলিগের যে ছয় দফা উসুল বা মূল নীতি রয়েছে সেখানে নমাজ, এলেম (ধর্মীয় জ্ঞান) ও জিকির (নিরন্তর আল্লার নামোচ্চারণ) ছাড়াও দাওয়াত আর তবলিগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ভাবে মানুষকে আল্লার পথে ডাক দেওয়াই হল তবলিগি জামাতের প্রধান কাজ। একেই বলা হয়েছে ‘দাওয়াত’ বা আমন্ত্রণ জানানো। তবলিগিদের এক একটা দল কোনও মসজিদকে কেন্দ্র করে দাওয়াতের কাজ চালায়। দাওয়াতের একটি প্রধান কাজ হল আসরের নমাজের (দুপুরে মধ্যাহ্নভোজনের পরের নমাজ) পরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মসজিদ সংলগ্ন এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমাজ পড়ার জন্য দাওয়াত দেওয়া। মগরিবের (বিকেলের নমাজ) আজান কানে শোনার আগে পর্যন্ত তাঁরা দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। এই অনুশীলনটিকে তবলিগি জামাতের পরিভাষায় বলে ‘গাশ্ত’। তবলিগিরা চায়, একটি নমাজও যেন কারও বাদ না পড়ে। নমাজ পড়ায় বা ধর্মাচরণে আগ্রহী নয় এমন মানুষদের কাছে তাঁদের যাওয়ার তাগিদ থাকে বেশি। তবলিগিদের প্রচারে কিন্তু মূলধারার আধুনিক শিক্ষা বা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রসঙ্গ থাকে না। নাচ-গান-নাট্যাভিনয়-ছবি আঁকার মতো সংস্কৃতি চর্চার বিপরীতে তাদের অবস্থান।
আরও পড়ুন: প্রাতঃস্মরণীয়
তবলিগিদের কোনও একটা দলকে মসজিদ-ভিত্তিক দাওয়াতের কাজ করতে হয় টানা তিন দিন, সাত দিন বা চল্লিশ দিন। চল্লিশ দিনের অভিযানকে বলা হয় এক ‘চিল্লা’। টানা ১২০ দিনের জামাতও হয়ে থাকে। কোনও বিবাহিত মানুষ প্রচারে বেরনোর পরে তাঁর পরিবারের, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখাও নিষেধ, তাতে ইমান টলে যেতে পারে। যত দিনের অভিযানই হোক বা যেখানেই হোক— যাবতীয় খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়।
তবলিগিদের চেষ্টা থাকে চল্লিশ দিনে যত বেশি সম্ভব মসজিদে যাওয়ার। মসজিদেই তাঁরা থাকবেন এবং সেখানেই রান্না করে খাবেন। এক একটি দলে সাধারণ ভাবে দশ থেকে বারো জন সদস্য থাকেন। শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী যে কোনও বয়সের মানুষ তবলিগে যোগ দিতে পারেন। আমাদের রাজ্যেই বহু অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ছাড়াও স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও প্রায়শই তবলিগে যান। তবে তবলিগ স্ত্রী ভূমিকা বর্জিত। ইদানীং ‘মাস্তুরাত জামাত’ (পর্দানশীনদের দল) নামে যে দল গঠন করা হয় সেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থাকেন। কিন্তু স্ত্রীর মসজিদে ঢোকার অধিকার নেই।
সারা বছর দেশের অজস্র মসজিদে তবলিগিদের হাজার হাজার দল অবস্থান করে দাওয়াতের কাজ করার জন্য। কোন দল কোথায় কী ভাবে দাওয়াতের কাজ করবে তা নির্ধারণ করে ‘মারকাজ়’, অর্থাৎ জামাতের প্রধান কেন্দ্র। ১৯২৭ সালে মৌলানা ইলিয়াস আল কান্দলভি দিল্লির নিজামুদ্দিনে বাংলাওয়ালি মসজিদকে কেন্দ্র করে তবলিগি জামাত গড়ে তোলেন। তবলিগি জামাতের বর্তমান আমির (প্রধান) মৌলানা সাদ মৌলানা ইলিয়াসের পৌত্র। ১৬৫টি দেশে সাদের কোটি কোটি অনুগামী। নিজামুদ্দিন বস্তির ওই মসজিদই এখন তবলিগি জামাতের আন্তর্জাতিক প্রধান কার্যালয় বা ‘মারকাজ়’। বিশ্বের যে সব দেশে তবলিগি জামাতের কাজ চলে তার সমন্বয়ের কাজ হয় এই নিজামুদ্দিন মারকাজ় থেকে। প্রত্যেক দেশে এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে রয়েছে ‘মারকাজ়’।
আরও পড়ুন: গরম ভাত অথবা নিছক খাওয়ার গল্প
তবলিগি জামাতের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হল বাৎসরিক ‘ইজতেমা’ বা সম্মিলন। এ রাজ্যে বিভিন্ন জেলায় এখন অনেকগুলো ইজতেমা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ঢাকার কাছে টঙ্গিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইজতেমায় এক দিনে ৫০ লক্ষ মানুষ নামাজ পড়েন। তবে এ বার ১৩ থেকে ১৫ মার্চ নিজামুদ্দিন মারকাজ়ে যেটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেটা ইজতেমা নয়, একটি আন্তর্জাতিক বিশেষ অধিবেশন।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।