প্রয়াত সুভাষ ভৌমিক।
শেষবার দেখা হয়েছিল ইকো পার্কে মুখ্যমন্ত্রীর আহূত বিজয়া সম্মিলনীতে। মুখে মাস্ক। পরণের ট্রাউজার্সে গোঁজা সাদা টি-শার্ট। কৃশকায় শরীরে ট্রাউজার্সটা ঢলঢল করছে। গলাটা একটু ক্ষীণ। কিন্তু তাতেই জোর আনার কী আপ্রাণ চেষ্টা!
গত শনিবার সকালে তিনি যখন ‘ব্রেকিং নিউজ’ হয়ে গেলেন, ওই চেহারাটাই বারবার মনে পড়ছিল। আর সঙ্গে অনুযোগ মেশানো অনুরোধ, ‘‘বুড়োটাকে ভুলো না কিন্তু!’’
সুভাষ ভৌমিকের খেলা কখনও দেখিনি। ১৯৭৯ সালে সুভাষ’দা (এই নামেই ডাকতাম। লিখছিও সেই সম্বোধনেই) যখন ফরোয়ার্ডের বুট তুলে রাখছেন, তখন আমি স্কুলের প্রথম দিককার ক্লাসের ছাত্র। ফুটবল ভালবাসি। কিন্তু যাকে বলে উন্মাদনা, তা নেই। তার জন্ম হবে পরে। নরেন্দ্রপুরে পড়তে গিয়ে। যেখানে আদিগন্ত মাঠ, স্টেডিয়াম, ঘাস আর ঘামের গন্ধ মাখামাখি হয়ে যাবে মিশন টিমের হয়ে প্রতি রবিবার বাইরের ক্লাবের সঙ্গে ম্যাচ খেলায়।
কিন্তু তার আগে কলকাতা ফুটবল নিয়ে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মার্কা আগ্রহ থাকলেও কোনও ফুটবলার সম্পর্কে তেমন আঠা ছিল না। সুভাষ’দার সঙ্গে আমার পরিচয় এক খেলার সাময়িকীর শারদীয়া সংখ্যার তাঁর আত্মজীবনী পড়ে। যেখানে তাঁর ময়দানের অ্যাচিভমেন্টের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণার কথাও বিধৃত ছিল। সত্যি বলতে কী, আমাকে অনেক বেশি টেনেছিল ওই জায়গাটা।
বারবারই মনে হয়েছে, সফল লোকেরা, অ্যাচিভাররা কী ভাবে জীবনের সঙ্কটকালে স্থিতধী থাকেন! না-পারলে তো ওই উচ্চতায় পৌঁছনো যায় না। সুভাষ’দার ক্ষেত্রে মনে হয়েছিল, পুত্রবিয়োগের শোক সামলেও লোকটা ফিরে এসেছিল কী ভাবে! অনেক পরে বুঝেছি, ফুটবলই ছিল সুভাষ’দার প্রথম এবং শেষ আশ্রয়। বন্ধু। সখা। সঙ্গী। নইলে ডায়ালিসিসে জীর্ণ হয়েও বিজয়া সম্মিলনীর সন্ধ্যায় প্রথম থেকে শেষ— ফুটবল নিয়েই কথা বলে যান!
উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ থেকে এসে কোনও তথাকথিত গডফাদার ছাড়াই টানা প্রায় এক যুগ ময়দানে রাজত্ব করেছিলেন সুভাষ ভৌমিক।
দেখা সেই শেষ। কথা নয়। গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্তও ফোন করেছেন। নিজের কথা বলতে নয়। এক স্নেহভাজন তরুণের হয়ে উমেদারি করতে। কিন্তু পাশাপাশিই বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয়, ছেলেটি ভদ্র এবং নম্র। লেখেও ভাল। কিন্তু তুমি নিজে দেখে নিও। আমি বলছি বলে উপরোধে ঢেঁকি গিলো না।’’
সেই শেষ কথা। এই লাইনটা লিখতে লিখতেই ঝপ করে মনে পড়ে গেল প্রথম ফোনের কথা।
১৯৯৪ সাল। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় আমায় ফুরনের খাটুনি খাটতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকার স্পোর্টস ডেস্কে। প্রাথমিক অ্যাসাইনমেন্ট সুভাষ’দার ম্যাচ রিপোর্টের অনুলিখন। তখনও তাঁর সঙ্গে সামান্যতম আলাপও নেই। ভাবছি, লোকটা কেমন। কী ভাবে ডিল করব। লেখার আগে একবার তো কথা বলা দরকার। সেটাই বা কবে বলব। এসবই রোজ ভাবতাম। কিন্তু কথা বলাটা আর হয়ে উঠত না।
বরাবরই সকাল সকাল অফিস পৌঁছে যাওয়া অভ্যেস। তেমনই একদিন গিয়ে ক্রীড়াবিভাগে বসে কাগজপত্র পড়ছি। তখনও অন্যেরা এসে পৌঁছননি। কিড়িং কিড়িং করে এক্সটেনশনটা বাজল।
— হ্যালো।
‘কে বলছেন?’
— আপনি কে বলছেন? ফোনটা তো করেছেন আপনি! আগে তো আপনাকে নিজের পরিচয়টা দিতে হবে।
তিনি যখন বল পায়ে এগোতেন, ধুকপুক করত বিপক্ষ রক্ষণের হৃদযন্ত্র।
‘সুভাষ ভৌমিক!’
— অনিন্দ্য জানা। বলুন।
মুহূর্তে সহজ হয়ে গেলেন সুভাষ’দা, ‘‘আরে! আমায় তো তোমার সঙ্গেই কাজ করতে হবে। আমি একদিন তোমাদের অফিসে যাব। তখন ডিটেল্সে কথা বলে নেব।’’
ঘটনাচক্রে, আমাদের জুড়ি, যাকে বলে, সুপারহিট হয়ে গেল। টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করতেন সুভাষ’দা। নিজের পয়সায় বিদেশি কাগজ আর ম্যাগাজিন আনিয়ে নিজেকে আপডেটেড রাখতেন। ফোনে ম্যাচ রিপোর্ট বলার সময় সেগুলো ফাঁকে ফাঁকে জুড়ে দিতেন। তবে আমি কপিতে খুব বেশি টেকনিক্যাল কচকচি রাখতাম না। বরং চেষ্টা করতাম একটা সহজ চলন রাখার। সম্ভবত সেজন্য পড়তে ভাল লাগত। সুভাষ’দারও পছন্দ হত।
আমাদের ‘টিউনিং’ হয়ে গেল। আর দেখলাম, লোকটা অসম্ভব দিলদরিয়া। একদিন তো বাড়ি থেকে সর্ষেবাটা দিয়ে ইলিশমাছ রেঁধে বিশাল হাঁড়িতে ভরে পাঠিয়ে দিলেন ডিপার্টমেন্টের সকলের জন্য। অনুলেখকের জন্য একটা বিদেশি টি–শার্ট পাঠালেন একদিন। নীতিগত ভাবে পেশাগত ক্ষেত্রে কোনও উপহার নিই না। কিন্তু ওটা ফেরাইনি। কারণ, টি-শার্টটায় একটা নিষ্কাম আন্তরিকতার গন্ধ ছিল।
হইহই করে বিশ্বকাপ চলে গেল। আমারই সহজাত আলস্যে যোগাযোগটাও ক্ষীণ হয়ে গেল। কয়েকমাস পরে সুভাষ’দা ফোন করে তাঁর নিউ আলিপুরের বাড়িতে একটা গেট টুগেদারে ডাকলেন।
সাধারণত কোথাও যাই না। ওটায় গেলাম। গিয়ে দেখি, ক্রীড়াজগতের প্রচুর লোক। ছাদে ম্যারাপ। বিশাল আয়োজন। গমগম করছে চারদিক। আমি তো নেহাতই নাদান। কাউকে খুব একটা চিনিও না। সরু হয়ে এদিক–ওদিক ঘুরঘুর করছি। আমন্ত্রিতরা সকলে আসার পর সুভাষ’দা নীচ থেকে গিয়ে মা’কে নিয়ে এলেন। তারপর গর্ভধারিণীকে জড়িয়ে ধরে অভ্যাগতদের বললেন, ‘‘সকলে শোনো। মা, তুমিও শোনো। তোমরা যে আনন্দবাজারে আমার বিশ্বকাপের লেখা পড়ে ধন্য ধন্য করেছ, তার সবগুলো ওই অনিন্দ্য জানা লিখেছে!’’
হইচই থেমে চারদিক আচমকা নিঝুম হয়ে গেল। আমার তো ‘ধরণী দ্বিধা হও’ অবস্থা। বিড়ম্বনার চূড়ান্ত। সুভাষ’দা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন পালানোর ফাঁক খুঁজছি। সটান এসে খপাত করে ধরলেন। তারপর আমার ডানহাতটা উপরে তুলে ধরে বললেন, ‘‘এটা সোনার হাত। এই হাত না থাকলে লেখক সুভাষ ভৌমিককে কেউ চিনত না!’’
আঠাশ বছর কেটে গিয়েছে। ঘটনাটা ভুলতে পারিনি। তারপরেও বহু সেলিব্রিটির অনুলিখন করেছি। আমার সামনেই তাঁরা দিব্যি নিজেদের লেখার প্রশংসা গিলে নিয়েছেন। সর্বসমক্ষে তো দূরস্থান, ব্যক্তিগত স্তরেও কখনও স্বীকৃতি দেননি। সুভাষ ভৌমিক কঠোর ব্যতিক্রম হয়ে রয়ে গিয়েছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম।
কারণ, সুভাষ ভৌমিক হলেন সেই বিরল ক্রীড়াব্যক্তিত্ব যাঁর বুকের পাটা আছে। যা খুব বেশি স্পোর্টস সেলিব্রিটির দেখিনি।
কারণ, সুভাষ ভৌমিকের হৃদয়টাও শরীরের মতোই বিশাল ছিল। নইলে ভরা হাটে কখনও ওই কথা স্বীকার করেন! গলা ভাঙা এবং হেঁড়ে হতে পারে। ব্যক্তিত্বে একটা হুমহুমে অস্তিত্ব থাকতে পারে। কিন্তু আন্তরিকতায় কোনও খাদ ছিল না। কিংসাইজ সিগারেট খেতেন। মেজাজে গাড়ি চালাতেন। সুভাষ’দার মধ্যে কোনও মিনমিনে ব্যাপার ছিল না। বরাবর একটা রোয়াবে চলেছেন। সে তিনি অসুস্থ থাকুন, সঙ্কটে থাকুন বা সাফল্যে।
শান্তিনিকেতন যাচ্ছি। রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা। বোলপুরে নামার পর প্রায় টেনেই নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রান্তিকের বাড়িতে। বললাম, সন্ধ্যায় যাব। গেলাম। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন, কী অত্যাশ্চর্য এবং আনোখা সব সামগ্রী দিয়ে বাড়ি সাজিয়েছেন। ভিতরের অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক কূট প্রশ্ন করে বসল, এত টাকা কোথায় পেলেন বলুন তো!
কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে সুভাষ’দা বললেন, ‘‘আসলে আমরা রেইড করে কিছু বাজেয়াপ্ত করলে একটা ভাল পার্সেন্টেজ পাই। সেই টাকাগুলোই এখানে খরচ করেছি।’’
কিছুদিন পর যখন উৎকোচ গ্রহণের সময় হাতেনাতে ধরা পড়লেন, তখন সেই দাবিটার কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু পাশাপাশিই মনে হয়েছিল, সমস্ত মানুষেরই তো বিচলন থাকে। বৈকল্য থাকে। মাহূর্তিক দুর্বলতা থাকে। লখিন্দরের লৌহবাসরের সেই ছিদ্র দিয়েই তো কালনাগিনী প্রবেশ করে। আর সততার নিরুপায় বেহুলা সত্যের কলার ভেলায় সামাজিক সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। যদি শাপমোচন হয়!
সম্ভবত সে কারণেই পরে যখন দেখা হয়েছে, অন্তরের কচালে সাংবাদিকের মুখ চেপে ধরেছি। সুভাষ’দার কোচিং জীবনের সাফল্যে, আশিয়ান কাপ জয়ের কৃতিত্বে উল্লসিত হয়েছি। এই যেমন তাঁর চলে যাওয়ায় ব্যথিত হচ্ছি। কারণ, এখনও আলো ঝলমলে চাঁদের হাটের এক কোণে সরু হয়ে-থাকা অপ্রতিভ তরুণের চোখে ভাসছে গর্ভধারিণীকে জড়িয়ে ধরা ভোম্বল চেহারা। কানে বাজছে, ‘‘সকলে শোনো। মা, তুমিও শোনো...।’’