ছবি: সংগৃহীত
ধরে নিচ্ছি ‘ক’ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সেখানে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জনসাধারণের আচরণবিধি ও অধিকার সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছে দেশের সংবিধান। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এই ‘ক’ রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রপ্রধানরা সংসদ, এমনকি স্থানীয় পৌর-পঞ্চায়েত স্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে স্বাধীন ভাবে বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করবে। যে হেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে একটি রাজনৈতিক দল বা দলসমূহ ক্ষমতায় আসে, এটা মনে করা যাবে যে, সরকার প্রণীত নীতিসমূহে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন রয়েছে।
পঞ্চায়েত স্তর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ লোকসভা পর্যন্ত নির্বাচন— কেমন উৎসব উৎসব ব্যাপার। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নির্বাচিত সরকার স্বাধীন ভাবে কাজ করছে। গণমাধ্যমও স্বাধীন ভাবে সরকারের নীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছে। জনগণ মত প্রকাশ করছে, চায়ের দোকান থেকে ভার্চুয়াল আড্ডায়। তার মানে কি ধরে নেব, স্বাধীন ‘ক’ দেশের স্বাধীন বাসিন্দারা সকলেই স্বাধীন, অন্তত তাদের জীবনযাপনের স্বাধীনতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার মানে হয় না?
অথচ মাঝেমাঝে চারপাশে হাওয়ায় একটা কেমনতরো আঁশটে গন্ধ। খাতায়-কলমে তথ্য জানার আইনে যে কোনও সরকারি তথ্য দিনকয়েকের মধ্যে খামবন্দি হয়ে বাড়ির ডাকবাক্সে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ‘অথরিটি’কে প্রশ্ন করেছেন কি মরেছেন। স্তাবকতা ও প্রশ্নহীনতার স্রোতে গা ভাসানোটাই তাই বাঞ্ছিত।
একটা সহজ অঙ্ক কষি। ধরে নেওয়া যাক, সরকার একটা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিল। স্বাধীন এই অর্থে যে, কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, সাধারণ মানুষের কথা ভেবে সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা হবে, এবং বাজেটে একটা বড় পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হবে এই খাতে। সবাই খুশি। অনেকটা রাজার ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরেও সে ধন আছে গোছের ভাবনা। তোমরা ঝাঁ চকচকে বেসরকারি হাসপাতালে এত দিন চিকিৎসা করিয়েছ। এখন আমরাও বিনি পয়সার বিমার কার্ড দেখিয়ে ওখানে যাব চিকিৎসা করাতে, এ বার। কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের বদলে একটি বা দু’টি নির্দিষ্ট বিমা সংস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিমার সুবিধে পাইয়ে দেওয়া হল সাধারণ মানুষকে। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ, তাই না?
যাঁরা সরকার পরিচালনা করছেন, তাঁরা বিবেচনা করেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংগৃহীত কর ও রাজস্বের সমন্বয়ে গঠিত দেশের কোষাগারের অর্থ কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যয় করা হবে। এই কাজ করতে গিয়ে দলীয় নীতি ও জনগণের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সংঘাত বাধে অবিরত। এর মধ্যে বিষফোঁড়ার মতো হাজির হয় নানা ‘বাদ’-এর দ্বন্দ্ব। কল্যাণকামী রাষ্ট্রতন্ত্রের কাঠামো, না কি আধা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর নীতি মেনে আংশিক বিকেন্দ্রীকরণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস, ব্যাঙ্ক-বিমা-খুচরো ব্যবসায় খোলাবাজারের খোলা হাওয়া— কোন পথে চলবে দেশ?
এই সব হিসেব কষতে কষতে রাষ্ট্র তথা সরকারের নখ-দাঁত বেরিয়ে যায় অনেক সময়ই। তার পথ যাতে অন্যরা প্রশ্নহীন মেনে নেয়, মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার বদলে সে বিরুদ্ধ মতকে গলা টিপে মারতে চায়।
ব্যক্তির ছোট ছোট স্বাধীন চেতনা, ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছেগুলোর ওপর প্রায়শই দুরমুশ চালায় রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই রাষ্ট্রের পিছনে থাকে বৃহত্তর ভাষা কিংবা জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন, অনেকটা অজান্তেই। যে কোনও নাগরিকের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ পাওয়ার কথা বলেছে আমাদের সংবিধান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা নিরপেক্ষ কর্মক্ষেত্র হল ‘সোনার পাথরবাটি’। ধরা যাক আমাদের রাজ্যের কোনও এক ছোট শহরের মনোয়ারা বিবি গৃহকর্মীর কাজ খুঁজতে শহরে এলেন। এই কাজে তিনি বেশ পারদর্শী। কাজ পাওয়ার স্বাধীনতা তাঁর আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বেশির ভাগ বাড়িতেই তাঁর ধর্মপরিচয় কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নিজের নামটাও তখন বদলে নিতে হয় মনোয়ারাদের। আঁশটে গন্ধ!
একটু কর্পোরেট ক্ষেত্রের হালচাল দেখা যাক। ব্যাঙ্ক, বিমা, তথ্যপ্রযুক্তি সবেতেই পুরুষ প্রার্থীরা বাড়তি সুযোগ পান নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। মহিলারা কাজের ক্ষেত্রে কত সময় টেক্কা দেন পুরুষদের, কিন্তু হিসেব বলছে, তাঁদের আবার মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটিছাটা দিতে হয়। এক জন দক্ষ কর্মীর লিঙ্গ পরিচয় এ ক্ষেত্রে তাঁর কর্মসংস্থানের পথ আটকে দেয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবস্থা তো আরও করুণ। তবুও এ দেশের শ্রমের বাজারের সিংভাগ দখল করে আছে অদক্ষ শ্রমিকেরা।
এই পরিস্থিতিতে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, স্বাধীনতা কী? উত্তরে আমি-আপনি যা বলব, সেটা অনেকের কাছেই বোধগম্য হবে না। মোটের ওপর স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়া— এর মানে শহুরে মধ্যবিত্তের মতো করে কি বুঝবে প্রান্তিক মানুষজন?
প্রান্তিক শ্রেণি যাকে স্বাধীনতা ভাববে, তা এখনও অনেক দূরে। দু’বেলা অন্ন সংস্থানই যে স্বাধীন রাষ্ট্র এত দিনে করে দিতে পারেনি,
প্রাথমিক বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ন্যূনতম চিকিৎসার স্বাধীনতা দিতে পারেনি, বিদ্যালয়ে ন্যূনতম পাঠেরও স্বাধীনতা এনে দিতে পারেনি। এর পরে আছে কৃষিপণ্যের ন্যূনতম মূল্য পাওয়ার স্বাধীনতা, সুলভ মূল্যে বীজ বা সার কেনার স্বাধীনতা, গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে বছরের দিনকয়েক কাজ পাওয়ার স্বাধীনতা, গণবণ্টন ব্যবস্থার পরিষেবা পাওয়ার স্বাধীনতা— এই সমস্ত বিষয়, যা রাষ্ট্রের কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর, মানুষের কাছে তা শেষ আশ্রয়ের মতো দামি।
তাই স্বাধীনতা বলতে যে কী বুঝবে স্বাধীন দেশের মানুষ, সে এক কঠিন ধাঁধা। সমাজের উপরিতলের, কিংবা সংখ্যাগুরুর (শুধুমাত্র ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়) ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর নির্ভর করে আমাদের দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের স্বাধীনতা। গ্রাম থেকে পড়তে আসা ছেলেটির কথাবার্তায় ‘মাদার টাং ইনফ্লুয়েন্স’ আছে? ব্যস, তার ‘স্বাধীনতা’র বারোটা বাজল। কোনও এক শৈলশহর থেকে মঙ্গোলয়েড শোণিত শরীরে বহন করে রাজধানী শহরে বড় সংস্থায় চাকরি করতে এল তরুণী, তার স্বাধীনতা শেষ হল। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও ‘আমাদের মতো’ নন যাঁরা, তাঁদের স্বাধীনতা আজকাল দেওয়া মুশকিল। এই ভাবেই ছোট হতে থাকে বৃত্তটা। ছোট হতে হতে এক সময় নিশ্চয়ই বিন্দুতে গিয়ে শেষ হবে স্বাধীনতা বস্তুটা।
আসলে, নিজের মতো পোশাক পরার স্বাধীনতা, নিজের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা, চিন্তা করার স্বাধীনতা, গান গাওয়ার স্বাধীনতা, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা— এ সব কিছু যত দুর্মূল্য হবে, ততই একমাত্রিক হয়ে যাব আমরা। যতই আমরা ভুলে যাব সকলে মিলে বাঁচার নিয়ম, ততই আসলে আলাদা আলাদা ভাবে স্বাধীনতা হারাতে থাকব আমরা— এ এক আশ্চর্য ধাঁধা।
এই যেমন, সবাই মিলে একসঙ্গে গান শোনার বদলে যখন একা একা হেডফোনে নিজের পছন্দমতো গান শোনার ‘স্বাধীনতা’ চাই আমরা, ভাবি সবাই আলাদা আলাদা গান শুনছি, কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে সবাই একই সুরে মাথা দোলাচ্ছি।
এই ভাবেই স্বাধীন হতে গিয়ে ক্রমশই সবার মতো হওয়ার ভান করতে থাকি আমরা। ভান করতে করতে সব মুখগুলোই মুখোশ হয়ে যায়। শহর-গ্রাম, নগর-মফস্সল সব কেমন একই রকম হয়ে ওঠে, বা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে।
রাষ্ট্রেরও খুব বেশি রকম সুবিধে হয় তাতে। উন্নয়নের সূচক নির্ধারিত হয় মাপা পণ্যে। মানুষকে আর মানুষ ভাবতে হয় না, মুখোশ পরা মানুষকে মুখোশের পরিচয়ে চিনলেই কাজ চলে যায়।
পড়ে থাকে একটা আঁশটে গন্ধ। ‘স্বাধীনতা’ বলে একটা অর্থহীন শব্দ।