Gaston Roberge

থেকে গেল ‘রূপকথা’র সৌরভ

১৯৬১ সালের অক্টোবরে মাদার টেরিজ়ার পথ অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানের কাজে ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নেন একুশ বছর বয়সি রোবের্জ।

Advertisement

সোমেশ্বর ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

সে  দিন ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ-এর গল্প শোনাচ্ছিলেন এক বন্ধু। গল্পটা সেই সময়ের, যখন অশক্ত শরীর নিয়ে মানুষটি ঘরবন্দি। তাঁদের পত্রিকায় মৃণাল সেন বিষয়ে কিছু লেখার জন্য বন্ধু অনুরোধ করেছিলেন ফাদারকে। লেখার অনুরোধে রোবের্জ ‘না’ বলতেন না সাধারণত। নির্দিষ্ট দিনে লেখা নিয়েই তৈরি থাকতেন তিনি। অভ্যাসমতো বন্ধুটিকেও দিনক্ষণ বলে রেখেছিলেন রোবের্জ। বন্ধুও হাজির হয়েছিলেন সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজে। তিনি জানতেন, সময় নিয়ে কথার খেলাপ পছন্দ করেন না মানুষটি। বন্ধু ভেবেছিলেন, রোবের্জ তাঁকে ডাকবেন নিজের ঘরে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে রোবের্জ অশক্ত শরীরেই নীচে নেমে এসে বন্ধুকে বললেন, চলুন কোথায় যেতে হবে। উনি ভেবেছিলেন, মৃণাল সেনকে নিয়ে কোনও সেমিনারে বলতে হবে তাঁকে।

Advertisement

এমনই ছিল সদ্যপ্রয়াত মানুষটির কাজের প্রতি ভালোবাসা, যা ছাপিয়ে যেত শরীরের প্রতিকূলতাকেও। কয়েক বছর ধরে তাঁর দিন কাটছিল ডাক্তার আর সেবিকাদের পরিচর্যায়। স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছিল, পরিচিত মানুষদেরও চিনতে পারছিলেন না। কিন্তু সিনেমা বা গণমাধ্যম নিয়ে কথা বললেই অনেকখানি ফিরে পেতেন নিজেকে।

১৯৬১ সালের অক্টোবরে মাদার টেরিজ়ার পথ অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানের কাজে ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নেন একুশ বছর বয়সি রোবের্জ। নিউ ইয়র্ক থেকে জাহাজে ওঠার আগের সন্ধেয় সত্যজিৎ রায়ের অপু-ত্রয়ী দেখার অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছিল এক সমান্তরাল কাজের দিশা। জাহাজে বসে রোবের্জ সিদ্ধান্ত নিলেন, ভারতের মানুষজনের সঙ্গে সংযোগ তৈরির কাজেই উৎসর্গ করবেন জীবন। আশ্চর্য, রোবের্জ-এর প্রিয় মানিকদাও (সত্যজিৎ রায়) চলচ্চিত্র-জীবন শুরু করার কথা ভেবেছিলেন জাহাজে বসেই, ১৯৫০ সালে।

Advertisement

কলকাতায় পৌঁছে নয় বছর ধরে তৈরি হয়েছেন রোবের্জ, নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরার জন্য। সেই প্রস্তুতির প্রথম ধাপ খুঁটিয়ে পথের পাঁচালী ‘পড়া’— বিভূতিভূষণের উপন্যাস নয়, সত্যজিৎ রায়ের ছবি। তার থেকে তৈরি হল ছবির শট ধরে ধরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের এক অনবদ্য পাঠ। তার প্রথম পাঠক সেন্ট জ়েভিয়ার্স স্কুলের উঁচু ক্লাসের কিছু ছাত্র, যারা সপ্তাহান্তে জড়ো হত চলচ্চিত্র আলোচনার এই কর্মকাণ্ডে। অর্থাৎ, শুধু নিজেই বিশ্লেষণে মগ্ন থাকছেন না রোবের্জ, সে সব ভাগ করে নিচ্ছেন কিছু অনুসন্ধিৎসু তাজা মনের সঙ্গে। তৈরি হচ্ছে সংযোগের প্রাথমিক রূপরেখা।

পরের পর্ব, ‘চিত্রবাণী’। তাঁর বিখ্যাত বইয়ের কথা বলছি না, বলছি এই নামের প্রতিষ্ঠানটির কথা, যেটি ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর সংযোগ-মাধ্যম গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ ছিল যন্ত্রনির্ভর তিনটি গণমাধ্যম, ফটোগ্রাফি, রেডিয়ো আর সিনেমা, নিয়ে শিক্ষা, গবেষণা আর হাতে-কলমে-কাজ। আস্তে আস্তে আরও নানা ক্ষেত্রে শাখা বিস্তার করেছে এই প্রতিষ্ঠান— গ্রাফিক্স নিয়ে চর্চা হয়েছে, হয়েছে লোক সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা। টেলিভিশন নিয়েও চর্চা শুরু হয়েছে আশির দশকে, যেখান থেকে ১৯৮৮ সালে জন্ম নিল টেলিভিশনে সম্প্রচারযোগ্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তৈরির প্রতিষ্ঠান ইএমআরসি। সংযোগের কোনও ক্ষেত্রই অচ্ছুত ছিল না ‘চিত্রবাণী’-তে, স্বাধীনতা ছিল যে-কোনও ক্ষেত্র নিয়ে নিজের মতো কাজ করার। পথ দেখানোর জন্য আসতেন দীপক মজুমদার, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, বা জয়ন্ত চৌধুরী প্রমুখরা। ছিল ঈর্ষা করার মতো এক গ্রন্থাগার। মাধ্যম আর সংযোগ বিষয়ে সাম্প্রতিকতম বইপত্র খুঁজে নিয়ে আসতেন রোবের্জ, যোগ্য সঙ্গত করতেন সুনেত্রা ঘটক। ছিল অসম্ভব ভাল রেকর্ডিং স্টুডিয়ো। ছিল গ্রাফিক ডিজ়াইনের স্টুডিয়ো। আর ছিল আর্কাইভ— মূলত ফটোগ্রাফির, কিন্তু ছিল উল্লেখযোগ্য কিছু চলচ্চিত্রও, বিশেষ করে তথ্যচিত্র। ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এক দল মানুষ, যাঁদের রোবের্জ লালন করতেন পরিবারের কর্তার মতো। এঁদেরই কল্যাণে ১৯৯০-এর আগে এই শহরে মিডিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার একমাত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ‘চিত্রবাণী’। তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারা ছিল আমাদের কাছে গর্বের ব্যাপার।

তবে রোবের্জ-এর কাজের তাৎপর্য বুঝতে হলে শুধু তাঁর গবেষণা বা লেখালিখির ব্যাপ্তি, চিন্তার গভীরতা আর ‘চিত্রবাণী’-র সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের অবদান আর খ্যাতি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলেই চলবে না। বুঝতে হবে তাঁর ভাবনার ধ্রুবপদটিকে। ‘চিত্রবাণী’-র লক্ষ্য হিসেবে লেখা হত পাঁচটি ইংরেজি শব্দ— ‘আ হিউম্যান টাচ ইন কমিউনিকেশন’। এই বাক্য ব্যবহার করে রোবের্জ বলতে চেয়েছিলেন, সংযোগ হোক মানবিক, গণসংযোগমাধ্যমের ব্যবহার হোক মানুষের কল্যাণে। বলতেন, ‘গণমাধ্যম’ থেকে যেন ‘মানুষ’-এর বহুধাবিস্তৃত পরিচিতি আর সেই সব পরিচিতির সঙ্গে মানানসই স্বর হারিয়ে না যায়। চেয়েছিলেন ব্যক্তিমানুষ, গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ, সামাজিক মানুষ, আন্তর্জাতিক মানুষ— সবার স্বরই মর্যাদা পাক যন্ত্রনির্ভর ‘গণমাধ্যম’-এর জগতে। এখানে মানুষ আসুক সজীব, সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারী হিসেবে।

গণমাধ্যমের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সুলুক-সন্ধান জানতে আগ্রহের অন্ত ছিল না তাঁর। কিন্তু গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর খ্যাতির প্রধান উৎস অগণিত বক্তৃতা, প্রায় পঁয়ত্রিশটি বই আর বেশ কিছু অগ্রন্থিত লেখা। সে সবের হদিশ নিলে বোঝা যাবে, শুধু সিনেমার আলোচনাতেই নিজেকে আটকে রাখেননি রোবের্জ। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের পাশাপাশি গণমাধ্যমের বিবর্তন, বিস্তার আর বিস্ফোরণের বিভিন্ন পর্যায় খুব মন দিয়ে লক্ষ করেছেন। লেখা আর বলার ক্ষেত্রে তাঁর নির্বাচিত বিষয়ের আপাত ‘বৈচিত্র’ আসলে এক অন্তর্লীন ‘ঐক্য’-কেই ধারণ করে আছে। গণমাধ্যমের ব্যাপক সংযোগক্ষমতার ভালমন্দ নিয়ে নিরলস আলোচনা জারি রেখে মানুষের কাছেই পৌঁছতে চেয়েছিলেন তিনি— নিজের মতো করে।

পঞ্চাশ বছর ধরে প্রায় একটা রূপকথার নায়ক হয়ে উঠেছিলেন ফাদার রোবের্জ। ১৯৭০ থেকে ১৯৯৬, এই ছাব্বিশ বছরে সেই রূপকথা তৈরি হয়েছিল মূলত ‘চিত্রবাণী’ আর কিছুটা ইএমআরসি-কে ঘিরে। পরের চব্বিশ বছর এদের কোনওটির সঙ্গেই তাঁর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। তাতেও নায়কের আসন এতটুকু টাল খায়নি। ২৬ অগস্ট রূপকথার নটেগাছটি হয়তো মুড়লো, কিন্তু থেকে গেল, থেকে যাবে, রূপকথার সৌরভ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement