অরাজনৈতিক

অরাজনৈতিক সাক্ষাৎকারেও তিনি সম্পূর্ণ অকারণেই টানিয়া আনিয়াছেন বারাক ওবামার প্রসঙ্গ। ঘনিষ্ঠতার উল্লেখ করিয়াছেন। এই হিসাবেও সাক্ষাৎকারটি তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের পাঁচ বৎসরের ছবিটি ধরিতে সক্ষম। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ০০:৫৯
Share:

নরেন্দ্র মোদী।

প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ লগ্নে একটি ‘অরাজনৈতিক সাক্ষাৎকার’। এই মুহূর্তটির গোষ্পদেই ধরা পড়িল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাঁচ বৎসর। অবিকল। গোটা মেয়াদে তিনি দেশের মাটিতে একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করিয়া উঠিতে পারেন নাই। যে কয়টি সাক্ষাৎকার দিয়াছেন, দুর্জনের মতে প্রতিটির চিত্রনাট্য পূর্বে প্রস্তুত করা ছিল। মেয়াদটি শেষ করিলেন ঠিক তেমনই একটি সাক্ষাৎকারে, যেখানে অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। বারাক ওবামার সহিত ইংরাজিতে তিনি ‘তুই-তোকারি’ করেন কী ভাবে, প্রশ্নকর্তা সেটুকুও জিজ্ঞাসা করিতে পারেন নাই। হয়তো সৌজন্যবশে। হয়তো ভয়ে। হয়তো প্রশ্নটি চিত্রনাট্যে ছিল না বলিয়াই। অনুমান: সাক্ষাৎকারটিতে প্রশ্ন করিবার পরিসরও ছিল না। ছিল মোদীর বিজ্ঞাপনী প্রতিভার আরও একটি উদাহরণমাত্র। হরেক মাধ্যমকে ব্যবহার করিয়া পাঁচ বৎসর যে ভঙ্গিতে তিনি আত্মপ্রচার করিয়াছেন, কানাডার নাগরিক ‘দেশভক্ত’ অভিনেতাকে খাড়া করিয়া তিনি তাহারই আরও একটি অধ্যায় রচনা করিলেন। বিজ্ঞাপন পণ্যের মাহাত্ম্য প্রচার করে। গত পাঁচ বৎসরে মোদী ব্র্যান্ডের বাড়া পণ্য ভারতীয় বাজারে আসিয়াছে কি?

Advertisement

সংসদে রাহুল গাঁধীর আলিঙ্গনে তিনি বিরক্ত হইয়াছিলেন। গত পাঁচ বৎসর সাক্ষ্য দিবে, দেশের মানুষের স্পর্শ তিনি পারিলে এড়াইয়াই চলেন— ব্যতিক্রম, বাবা রামদেব। বিদেশি রাষ্ট্রনেতারা অবশ্য তাঁহার আলিঙ্গনধন্য। বারাক ওবামা হইতে ভ্লাদিমির পুতিন, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হইতে শিনজো আবে, মোদীর সহিত সাক্ষাৎমাত্রেই তাঁহার আলিঙ্গনপাশে বদ্ধ হইয়াছেন। কেন? কেহ বলিতে পারেন, বিশ্বনেতাদের সহিত ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করিয়া নরেন্দ্র মোদী তাঁহাদের ‘ব্যক্তি’গুলিকে আত্মসাৎ করিতে চাহেন। বারাক ওবামাকে তিনি আলিঙ্গন করেন, ‘বারাক’ নামে ডাকেন— অতএব, তিনি ওবামার সমকক্ষ ও বিশ্বমঞ্চে ওবামার যে সম্মান প্রাপ্য, তিনিও সেই একই সম্মানের অধিকারী বলিয়া ঘোষণা করিতে চাহেন মোদী। দুর্জনে বলিবে, এই প্রবণতাটির কারণ সম্ভবত গূঢ় হীনম্মন্যতা। সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের শীর্ষ আসনে অধিষ্ঠিত হইবার যথেষ্ট যোগ্যতা তাঁহার ছিল না। ব্যাখ্যাটি যথার্থ কি না, সেই তর্ক অন্যত্র— আপাতত লক্ষণীয়, এই অরাজনৈতিক সাক্ষাৎকারেও তিনি সম্পূর্ণ অকারণেই টানিয়া আনিয়াছেন বারাক ওবামার প্রসঙ্গ। ঘনিষ্ঠতার উল্লেখ করিয়াছেন। এই হিসাবেও সাক্ষাৎকারটি তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের পাঁচ বৎসরের ছবিটি ধরিতে সক্ষম।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

Advertisement

তবে, সর্বাপেক্ষা মিল যেখানে, তাহা একটি শব্দ— ‘অরাজনৈতিক’। সাক্ষাৎকারটি ‘অরাজনৈতিক’ কেন, সেই প্রশ্নের বহুবিধ উত্তর সম্ভব। বৃহত্তম কারণটি হইল, নরেন্দ্র মোদীর পাঁচ বৎসর অ-রাজনীতির সাধনাতেই কাটিয়াছে। কথাটিকে ভাঙিয়া বলা প্রয়োজন। অরাজনীতির অর্থ হইল, শুধুমাত্র নিজেরটুকু বাদে আর কোনও প্রশ্নে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হওয়া। নিজের চাকুরি অক্ষত থাকিলে অর্ধশতকের সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার লইয়া চিন্তা না করা; নিজের ঘরে আগুন না লাগিলে দেশব্যাপী মুসলমান-নিধন দেখিয়াও নিরুদ্বেগ থাকা; ‘ভারত’ নামক ধারণাটির সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হইলেও মুখ ফিরাইয়া লওয়া। দেশ এমন অরাজনৈতিক হইয়া উঠিয়াছে বলিয়াই নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হইল, না কি নরেন্দ্র মোদীই ভারতকে এমন অরাজনৈতিক করিয়া তুলিতে পারিলেন, তাহা জটিল তর্ক, কিন্তু এই রাজনীতিহীনতার সহিত তাঁহার একাত্মতা গত পাঁচ বৎসরের অভিজ্ঞান। রাজনীতিকে তাঁহার ভয়, কারণ প্রকৃত রাজনীতি তাঁহার দিকে বিপজ্জনক সব প্রশ্ন ছুড়িয়া দেয়। মেয়াদের শেষ সাক্ষাৎকারেও মোদী জানাইয়া দিলেন, তিনি এই ভয়কে অতিক্রম করিতে পারেন নাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement