বিকেন্দ্রীকরণ এবং মানব উন্নয়নে সব রাজ্যের মধ্যে এগিয়ে কেরল। সেই কেরলে পঞ্চায়েত নির্বাচন হল সম্প্রতি। বামেরা এগিয়ে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ দ্বিতীয় স্থানে, তৃতীয় স্থানে বিজেপি-প্রধান এনডিএ, সবই প্রত্যাশিত খবর। তবে একটা অপ্রত্যাশিত খবরও আছে। ‘আনা-কাইটেক্স’ নামে এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত একটি সমাজকল্যাণ সংস্থা চারটি পঞ্চায়েতে অধিকাংশ আসন পেয়ে বোর্ড গড়েছে। তার মধ্যে একটিতে ২০১৫ সাল থেকেই তারা ক্ষমতাসীন। ১৯ আসনের মধ্যে ১৭টি জিতেছিল সে বার। এ বার ১৮টি।
কারা এরা? ১৯৬৮ সালে এর্নাকুলাম জেলার কিল্লহাকাম্বালাম গ্রাম পঞ্চায়েতে আন্না অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন এমসি জেকব। ক্রমে যুক্ত হল মশলা, জামাকাপড়, ছাতা, ব্যাগ ইত্যাদির ব্যবসা। প্রতিষ্ঠাতার পুত্র সাবু জেকব ১৯৯১-৯২ সালে শুরু করলেন জামাকাপড়ের ব্যবসা। ব্যবসায় সমস্যা থাকবেই। ২০০০ সালে চারশো দিনের ধর্মঘটের মুখোমুখি হয়েছিল এই গোষ্ঠী। পরের দশকে কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের জন্য অনুমতি দিল না পঞ্চায়েত, দূষণের আশঙ্কায়। ২০১৩ সালে কাইটেক্স সরকারি নিয়ম অনুসারে ‘কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা’ পালনের উদ্দেশ্যে গড়ে তুলল সমাজসেবামূলক সংস্থা টোয়েন্টি২০। ২০১৫-র পঞ্চায়েত ভোটে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে। কংগ্রেস এবং বামকে অবাক করে ১৭টি আসনে জিতে এর প্রার্থীরা বোর্ড গঠন করলেন। কংগ্রেস এবং বাম দু’পক্ষই তখন বলেছিল, মানুষ ভুল করলেন।
২০১৩-য় টোয়েন্টি২০ কাজ শুরু করার সময়েই সমীক্ষা করে দেখেছিল, পঞ্চায়েতের আট হাজার পরিবারের মধ্যে দু’শোর বেশি পরিবারের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে, নেই শৌচাগারও। সেগুলি নির্মাণ করে দিয়েছিল তারা। ক্ষমতায় আসার পর গৃহহীনদের জন্য সরকার-নির্দিষ্ট মানের চেয়েও উন্নত বাসস্থান তৈরি করেছেন সদস্যরা, বাড়ি পিছু ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে। এলাকায় তৈরি হয়েছে সুপারমার্কেট, যেখানে টোয়েন্টি২০ প্রদত্ত কার্ডের ভিত্তিতে দরিদ্র পরিবাররা আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী ৬০ শতাংশ ছাড় থেকে শুরু করে প্রায় বিনামূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাচ্ছেন। এ ছাড়াও পাওয়া যাচ্ছে বিনামূল্যে ওয়াই-ফাই, উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবা, গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবার।
পঞ্চায়েতবাসীরা বলেছেন, টোয়েন্টি২০-র আমলে রাস্তাঘাটের অনেক উন্নতি হয়েছে, মদের দোকান উঠিয়ে দিয়েছে এরা; ২০১৫-র তুলনায় মাতলামি, সমাজবিরোধীদের উৎপাত, অপরাধ অর্ধেক হয়েছে। সরকারি তথ্যও মানছে সে দাবি। কাইটেক্সের দাবি, সরকারি বরাদ্দের বাইরে পঞ্চায়েতের কাজে তারা নিজেদের তহবিল থেকে ১৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে পাঁচ বছরে।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে টোয়েন্টি২০ ৭৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত ওয়ার্ডে, ১১টি ব্লক পঞ্চায়েতের আসনে এবং ২টি জেলা পরিষদ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। ক্ষমতাসীন পঞ্চায়েতে ফের জয় তো বটেই, তার পাশাপাশি তিনটি পঞ্চায়েতে তাদের জয়ের বহর এই রকম— ১৯টি আসনের ১৩টি; ১৮টির মধ্যে ১১টি; এবং ১৪টির মধ্যে ১৪টি।
২০১৫-র নির্বাচনের আগে সিপিআই সদস্য কেভি জেকব যোগ দিয়েছিলেন টোয়েন্টি২০-তে। তাঁর মনে হয়েছিল, রাজনৈতিক দল করে খুব কিছু করা যাবে না এলাকার জন্যে। কিন্তু ২০২০-র ভোটের আগেই তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ হয় কাইটেক্স গোষ্ঠীর। তিনি পদত্যাগ করেন এবং সংবাদমাধ্যমকে জানান যে, পঞ্চায়েতের সব প্রকল্পেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কাইটেক্স গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে। পূর্ববর্তী পঞ্চায়েত বোর্ড কাইটেক্সের বিরুদ্ধে দূষণের অভিযোগ আগেই তুলেছিল। এটাও সত্যি যে, গ্রাম পঞ্চায়েতের যে দু’টি ওয়ার্ডে কাইটেক্সের কারখানা, ২০১৫-য় সে দু’টি আসনেই হেরেছিল টোয়েন্টি২০।
ঠিক, কর্পোরেট-লালিত স্থানীয় সরকারের একটা মডেল ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কেরলে। স্থানীয় মানুষ আর কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে পরিকাঠামো, দেওয়া হচ্ছে পরিষেবা। কিন্তু একে কি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলা যায়?
ব্যবসায়ী সংস্থা পরিচালিত পঞ্চায়েতে সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করা কি সম্ভব হবে? হয়তো কিছু স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি হচ্ছে কর্পোরেট আনুকূল্যে, কিন্তু সেটার জন্য স্বাধিকার হারানোটা কি ঠিক হবে? বড় কারখানা ঘিরে শিল্পনগরী বসানো নতুন কিছু নয়, কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শিল্প সংস্থা দখল নিচ্ছে একাধিক স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, এমনটি আগে কখনও হয়নি। ‘কোম্পানি’ আমলে যেমন বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইন প্রণয়নকর্তা এবং ব্যবসায়ী একই অঙ্গে লীন থাকত, সে রকমই দাঁড়াচ্ছে না কি ব্যাপারটা? এলাকায় বিনিয়োগ টানার জন্যেও কি এটা খুব ভাল মডেল? ইচ্ছুক বিনিয়োগকারীদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে কি তাঁদের উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না নিয়ন্ত্রক কর্পোরেট সংস্থা? উত্তর জানা নেই!
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস