Trailokyanath Chakravarty

বিস্মৃত বিপ্লবী ও তাঁর দেশ

ত্রৈলোক্য মহারাজ বিশ্বাস করতেন ‘বাংলাদেশ’-এর সাফল্যে। ১৯৭০ সালে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরের বছর এই লেখাটি লিখেছিলেন কৃষ্ণা বসু। প্রয়াত লেখিকার স্মৃতিচারণটি অদ্যাবধি অপ্রকাশিত।ত্রৈলোক্য মহারাজ বিশ্বাস করতেন ‘বাংলাদেশ’-এর সাফল্যে। ১৯৭০ সালে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরের বছর এই লেখাটি লিখেছিলেন কৃষ্ণা বসু। প্রয়াত লেখিকার স্মৃতিচারণটি অদ্যাবধি অপ্রকাশিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০৪
Share:

সহযোদ্ধা: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, কলকাতা

মাত্র এক বছর আগে ত্রৈলোক্য মহারাজ যখন আমাদের কাছে এক নবীন পূর্ব বাংলার বার্তা বহন করে নিয়ে এলেন, তখন কি আমরা আজকের ‘বাংলাদেশ’-এর কথা কল্পনাও করতে পেরেছিলাম? বোধ হয় পারিনি। কিন্তু লৌহ-যবনিকার আড়ালে এক নতুন দেশ, নতুন জাতি জন্মগ্রহণ করেছে, সে খবর এপার বাংলার সাধারণ মানুষের সামনে ত্রৈলোক্য মহারাজই প্রথম তুলে ধরেছিলেন। এর আগে আমরা ওঁদের বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠার কথা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি অনুরাগের খবর কিছু কিছু পেতাম। কিন্তু তার উপর ভিত্তি করে যে নবীন জাতীয়তাবাদ ওখানে দেখা দিয়েছে, ওখানকার তরুণ সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নলেশহীন যে উদার স্বদেশপ্রেম জেগে উঠেছে, সে খবর কিন্তু মহারাজের মুখেই প্রথম পাই। আর সেই নবীন বাংলার অবিসংবাদী নেতা মুজিবুর রহমান, তাঁর নামটা শোনা ছিল বইকি। বিলেতি কাগজে ছবিও দেখা ছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কাহিনিও অজানা ছিল না। কিন্তু মহারাজের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর এখনও কানে বাজছে: ‘এ বারের নির্বাচনে মুজিবুর দেখাবে।’ এই ‘দেখাবে’ কথাটার পরিণতি কোথায় হবে, সে দিন কি আমরা একটুও বুঝেছিলাম!

Advertisement

গত বছর এমনই এক বর্ষণমুখর সকালবেলা মহারাজকে প্রথম দেখি। যাদবপুরের রাস্তাঘাট জলেকাদায় থৈ থৈ। টিপটিপ বৃষ্টিতে পিছল সরু পথের উপর ইটপাতা। সন্তর্পণে ইটে পা দিয়ে এক পা-এক পা করে মহারাজের কাছে উপস্থিত হলাম। ঘরে আরও দর্শনার্থী ছিল। আমাদের দলটিকে দেখে মহারাজ কিন্তু বেশ খুশি হলেন মনে হল। দলে এমন দু’এক জন ছিলেন, যাঁদের দিকে যত বারই তাকান, দূর অতীতের স্মৃতি তত বারই তাঁর মনে পড়ে যায়।

বেশ অতীতের গল্প করার মুড-এ ছিলেন। বললেন, তোমরা একটু দোতলায় বসো, আমি আসছি। ঘরে কত লোকের ভিড়, কত গণ্যমান্য লোক, কত তুচ্ছ, সাধারণ মানুষ। আমরা ঢুকছি ত্রিদিব চৌধুরী মশাই বেরোলেন, আমরা চলে আসছি সাহিত্যিক মনোজ বসু ইটপাতা পথে পা বাড়ালেন। এরই মধ্যে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন, উঠে হাতজোড় করে বললেন, মহারাজ, আপনি আর পাকিস্তানে ফিরে যাবেন না, আমরা আপনাকে বাবা ডাকব।

Advertisement

কৌতুকে মহারাজের চোখ চিকচিক করে উঠল। বললেন, আমি কারও বাবা-টাবা না, তার জন্য অন্য লোক আছে (দু’এক জন তথাকথিত জনপ্রিয় নেতার নাম উল্লেখ করেছিলেন)। তবুও ভদ্রলোক আর্তনাদ করে বললেন, আপনি এ দেশে থেকে প্রাক্তন বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দিন। খুব শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় মহারাজ বললেন, আমি যে দেশের নাগরিক সে দেশেই ফিরে যাব।

প্রাক্তন বিপ্লবী! কথাটা আমার কানে কেমন যেন ঠেকল। বিপ্লবী যে, সে চিরবিপ্লবী। বিপ্লবী কখনও প্রাক্তন হতে পারেন? অন্তত ত্রৈলোক্য মহারাজ নিশ্চয় হননি। তিনি বিরাশি বছর বয়সেও প্রচণ্ড আশাবাদী। ভবিষ্যতের উপর অসম্ভব আস্থা। তিনি অতীতের ‘অবশেষ’মাত্র নন, অথচ অতীতের ঐতিহ্যকে স্বীকার করেও ভবিষ্যতের দিকে ওঁর দৃষ্টি প্রসারিত ছিল। তিনি ফুরিয়ে যাননি, পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে অক্লান্ত কর্ম করে চলেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে এইটি ছিল।

দোতলায় উঠে এসে অল্প হাঁপাচ্ছিলেন। বললেন, না, না, ও কিছু নয়। কথা বলতে কষ্ট হয় না। কথা বললে, আগেকার বন্ধুদের দেখলে শরীরটা বরঞ্চ চাঙ্গাই বোধ হয়। দোতলায় উঠে এসে নিভৃতে ওঁর জেলের দিনগুলির নানান গল্প করছিলেন। আলিপুর জেলে এক বার নেতাজির সঙ্গে একসঙ্গে বন্দিজীবন। দেশবন্ধুর কী সেবাযত্নটাই না সুভাষ সে সময় করতেন। এমনকি রেঁধে-বেড়ে খাওয়ানো পর্যন্ত সব। তার পর আবার একসঙ্গে হলেন সুদূর বর্মাদেশে মান্দালয় জেলে। সুভাষচন্দ্র আগেই বললেন, মহারাজের সিট আমার পাশে থাকবে। সেই ব্যবস্থাই হল। জেলখানায় টেনিস খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে হাঁটু কেটে গেল মহারাজের। সুভাষচন্দ্র মহাব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নিজের হাতে হাঁটুতে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন।

তার আরও অনেক দিন পর, কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত সুভাষচন্দ্র। তাঁকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে বাংলাদেশের বিপ্লবী সংস্থাগুলি প্রস্তুত। তিনি যে দিন ডাক দেবেন সমস্ত ভারতবর্ষে বিদ্রোহ ঘটাতে হবে তারই প্রস্তুতি চলছে। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে পঞ্জাব সফরে গিয়েছিলেন সেই সময়। দিল্লিতে সে বার শঙ্করলালের বাড়িতে উঠেছিলেন। খুব গর্বের সঙ্গে স্মরণ করলেন— “মিঁয়া আকবর শা-র সঙ্গে এক কোঠাতেই ছিলাম।” আকবর শা সীমান্ত প্রদেশে সুভাষচন্দ্রের বিশ্বস্ত সহকর্মী।

দেশবন্ধুর প্রসঙ্গে বহু যুগ আগে তাঁর বিপ্লবীজীবনের গোড়ার দিনগুলির কথায় চলে এলেন। ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের সমর্থনে এলেন ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন। সেই প্রথম দেশবন্ধুর সঙ্গে মহারাজের যোগাযোগ। এই ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি হিসেবে মহারাজ বহু দিন পলাতক ছিলেন। সেই পলাতক জীবনেও কত অ্যাডভেঞ্চার।

বিপ্লবীজীবনের সেই গোড়াকার দিনগুলির কথায় ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি ললিত রায়ের গল্প করলেন। ললিত রায় বাংলাদেশের ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই এক আশ্চর্য জেনারেশনের লোক, যাঁরা আর ফিরে আসবেন না। পূর্ব বাংলার উদারহৃদয় জমিদার, সমাজসংস্কারক, স্বদেশিওয়ালা, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোয় পরম উৎসাহী। ঠিক হল বিদেশি কোম্পানির স্টিমারে কেউ চড়বে না। ললিত রায়ের স্বদেশি স্টিমার পাসা পারাপার শুরু করল। কিন্তু কম ভাড়া, বিনা পয়সায় চা-বিস্কুট খাওয়ানো ইত্যাদি প্রলোভনেও কোম্পানি ফেল পড়ল। অকৃতজ্ঞ স্বদেশবাসী সাহেবি কোম্পানির জাহাজে চড়তেই পছন্দ করে দেখা গেল। এতে করে জমিদারির কয়েকটা মহল লাটে উঠল বটে, কিন্তু মহারাজের পক্ষে একটা মস্ত সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল এই যে, বেশ কিছু দিন তিনি খালাসি সেজে জাহাজে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পেরেছিলেন।

ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময় এক বাঙালি পুলিশ ইনস্পেক্টর, যাকে বলে বেশ ‘ড্যামেজিং’ সব সাক্ষ্য দিয়ে চলে গেলেন। কোর্ট থেকে ফিরে এলেন দেশবন্ধু। বেশ বিরক্ত ভাবে বললেন, এই ভাবে সবাই যদি এসে সাক্ষী দিয়ে যায়, তবে তোমরা আমাকে ডেকেছ কী করতে? কথাটার কী অর্থ, কে বুঝেছিল, কে জানে। পর দিন ঢাকা স্টেশনের কাছে সেই ইনস্পেক্টরের মৃতদেহ পাওয়া যায়। “আমি করি না, আর একজনে করছিল”— আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন মহারাজ।

শুধু অতীতের স্মৃতিচারণই নয়, ভবিষ্যৎ আলোচনাও হল। দুই বাংলা কোন পথে? বললেন, জানো পূর্ব বাংলার মানুষ আজ আবার ১৯৪৭-এর সেই শরৎ বসু-সুরাবর্দী ফর্মুলার কথা স্মরণ করছে। যে স্বাধীন বাংলার আবেদন শরৎবাবু তাঁর মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগেও করে গিয়েছিলেন, আজ সেই স্বাধীনতার (অটোনমি) দাবিতেই পূর্ব বাংলার মানুষ নির্বাচনে নামছে। ইতিহাসের চাকা এ ভাবেই ঘোরে।

কোনও একসময় হঠাৎই আমার দিকে ফিরে বললেন, পূর্ব বাংলার মেয়েরা কেমন জানো? একেবারে এই ঠিক তোমার মতো। একটুও তফাত ধরতে পারবে না। আর নাম, ইলা, বেলা, বকুল, পারুল— এমনই সব খাঁটি বাংলা নাম।

একটা গল্প বললেন, “কাজের সূত্রে এক মস্ত অফিসারের বাড়িতে গিয়েছি। তা অফিশিয়াল কথাবার্তা শেষ হলে পর অফিসারটি বললেন, আমার স্ত্রী এক বার আপনাকে দেখবে। আপনার বই পড়েছে কিনা— জেলে ত্রিশ বছর। তার পর এই তোমার মতোই একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। বললে, না খেয়ে যেতে পারবেন না। অতএব খেতে বসলাম। মাছ ভাজা, ইলিশমাছের ঝোল, মাছই তিন পদ। বলল, সব আমার নিজের হাতের রান্না, খেতেই হবে। খুব তৃপ্তি করে খেলাম।”

চলে আসবার সময় বলছিলেন— পাকিস্তানে ফিরে যেতে হবে তাড়াতাড়ি, নির্বাচন আসছে, অনেক কাজ। পূর্ব বাংলার তরুণ ছাত্রদের প্রতি অগাধ আস্থা ওঁর। ওদের দেশপ্রেম কখনওই ব্যর্থ হবে না।

এপারের তরুণ সমাজকে দেখে একটু নিরুৎসাহ হয়েছিলেন। এখানকার তরুণ সমাজের চিত্ত যেন বড় বেশি বিক্ষিপ্ত, ওঁর তাই ধারণা হয়েছিল! কেন এমন হল? উনি দুঃখিত হয়েছিলেন— আদর্শের অভাব? নেতৃত্বের অভাব?

গত বছর ৯ অগস্ট ছিল রবিবার। সকালে গৃহকর্মে ছিলাম, দরজায় দাঁড়িয়ে গৃহকর্তা বললেন, খবর শুনেছ? মহারাজ ইজ় ডেড।

মহারাজ? এক মুহূর্তের বিভ্রান্তি। পরমুহূর্তেই এই নিদারুণ কয়েকটি শব্দের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করলাম। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে নেতাজি ভবনে তাঁকে শেষ বার দেখি। সে দিন মিউজ়িয়ামের ভিজ়িটরস বুক-এ এই বিরাশি বছরের তরুণ বিপ্লবী যে কথা ক’টি লিখে রেখে গিয়েছিলেন ভারতবর্ষের তরুণ সমাজের উদ্দেশে তাই রয়ে গেল তাঁর অন্তিম বাণী।

“নেতাজি সুভাষচন্দ্র ভারতের যুবকদের আদর্শ। ভারতের যুবকেরা নেতাজির আদর্শে শক্তিশালী ভারত গড়িয়া তুলিবে ইহাই আশা করি।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement