‘আসা যাওয়ার মাঝে’ ছবির একটি মুহূর্ত।
নি র্বাক। মন্থর। রাজনীতি। নির্জনতা। অবাধ বাচালতায় রাজা-উজির মারা যখন দস্তুর, তখন চুপ করে যাওয়া একটি রাজনৈতিক উচ্চারণ।
হাউইয়ের ছুট যখন খেলার নিয়ম, তখন জানলার ধারে বসে থাকা একটি রাজনৈতিক অবস্থান।
এতে সংগঠন লাগে না। মোমবাতি মিছিল লাগে না। এ রাজনীতি সংগোপনের, নির্জনতার। তার প্রকাশ বড় অস্ফুট। ‘আমাকে দেখুন’ বলে হাঁকাহাঁকি তার ধর্ম নয়। বহু কাল বাদে বাংলা ছবিতে এমন একটি রাজনীতির পদচারণা দেখা গেল। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ ছবিটি যেন স্থির করেছে, সময়কে সে তার নিজের নিয়মে গড়িয়ে যেতে দেবে। ক্যামেরার ছটফটানি বা সম্পাদনার কাঁচি দিয়ে অযথা কাটাছেঁড়া করবে না। সূর্য ডুববে নিজের লয়ে। সাইকেল রাস্তার বাঁক পেরোবে নিজের মর্জিতে। কড়াইয়ের জল আগুনে শুকোবে যত ক্ষণ তার শুকোতে লাগে। ছবি শুধু এক ধারে দাঁড়িয়ে লক্ষ করে যাবে সব। তার বিষয়ান্তরে যাওয়ার তাড়া নেই, মনোযোগের অভাব নেই, মগ্নতায় খামতি নেই।
আর এই নিবিষ্টতার জন্য বিরাট আয়োজনের প্রয়োজন নেই। অতি ছোটখাটো তুচ্ছ সব জিনিসের দিকে তার নজর। চাল-ডাল-তেল-সাবান, কাপড় শুকনোর ক্লিপ, বাসে টিকিটের দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। পর্দা জুড়ে সর্ষে দানা, বড়ির শিশি। স্মল ইজ বিউটিফুল। সেই সৌন্দর্যের নেশা এক বার পেয়ে বসলে বাক্স্ফূর্তি না হওয়ারই কথা। বকবক করলে মন দিয়ে দেখবে কী করে? ছবিতে সংলাপ নিজেকে রবাহূত বলে বুঝতে পেরে সরে যায়। সময়ের প্রতিটি পল তার বদলে কথা কয়ে ওঠে, স্তব্ধতার প্রতিটি শব্দ শ্রবণে ধরা দেয়।
চার পাশের এই বিকট হলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবিটা যেন বলে ফেলে, থাকতে দে না আপন মনে।
এই আপন মনে থাকতে চাওয়ার মধ্যেই গতানুগতিকতার আধিপত্যকে অস্বীকার করার পরিসরটি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিকতার সংলাপ শুরু হচ্ছে। কারণ এমনিতে বাজারি হাওয়া সদা সর্বদা কানের কাছে বলে চলেছে, আপনি ছুটতে থাকুন এবং সেই ছোটাটা যাতে সবাই টের পায়, তার দিকেও নজর রাখুন। যা করবেন দ্রুত করবেন, কারণ আপনার হাতে সময় নেই। পাঁচ মিনিটের বেশি কোনও কিছুতে মনোনিবেশ করার অভ্যাসও নেই। আপনার কানে হেডফোন, আঙুলে হোয়াটসঅ্যাপ। একসঙ্গে অনেক কাজ সারতে হচ্ছে। চার দিকে ইনফর্মেশনের বিস্ফোরণ। টিভিতে অজস্র চ্যানেল, ইউটিউবে অগুন্তি ক্লিপ, ফেসবুকে হাজারো পোস্ট— আপডেটেড না থাকলেই আপনি হেরো। চায়ে চিনি বেশি পড়ে গেল? মুখ বেঁকিয়ে সেলফি পোস্ট করে দিন। লাইকের বন্যায় নিজেকে একদম নায়ক-নায়ক মনে হবে! আর এমনতর আপনার মন জয় করতে যে ছবি তৈরি হবে, তার স্বভাব-চরিত্রই বা অন্য রকম দাঁড়ায় কী করে? প্রতি মুহূর্তে সেখানে তাই কিছু না কিছু অ্যাকশনের ঘনঘটা। নতুবা একটাই অ্যাকশন চার বার ক্যামেরার চার রকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো। দম ফেলার সু্যোগ দিলেই দর্শক অন্য দিকে মন দেবে যে! সম্পাদক তাই মুহুর্মুহু কাট করে গল্পটাকে দৌড় করাবেন। সংলাপ এমন, যেন প্রত্যেকটা বাক্যই বলছে ‘কেমন দিলাম!’ এর পরেও যদি ফাঁকফোকর থাকে? আবহসঙ্গীত এমনিতেই টেনশন বাড়ানোর কাজটা করছিল, শূন্যস্থান পূরণের দায়িত্বও সামলে দেবে। এই হল টোটাল প্যাকেজ। বাজার গাঁক গাঁক করে বলছে, এইটেই আমার সংবিধান।
সংবিধান অমান্য করার সাহস যাঁরা দেখান, তাঁরা নিজেদের ভাষা নিজেরা তৈরি করেন। তাইওয়ানে ৎসাই মিং লিয়াং, তুরস্কে নুরি বিল্গে চেলান, ফিলিপিন্সে লাভ দিয়াজ যেমন বেশ কিছু দিন ধরে খুব সচেতন ভাবে স্লো ছবি করে চলেছেন। ওঁদের ছবির ভাষা যার যার নিজের মতো। কিন্তু অভিন্নতার জায়গাটা একটাই: বিলম্বিত লয়। সিনেমার মহান কলাকারদের মধ্যে অনেকেই মন্থরতার পূজাির ছিলেন আগেও। তারকভস্কি বা বেলা টার-এর নাম তার মধ্যে আগে। কিন্তু তাই মিং-চেলানরা আজকাল মন্থরতাকে একটা রাজনৈতিক বিবৃতির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জীবনযাত্রায় আকস্মিক ভাবে উন্মত্ত গতি-সঞ্চারের বিরুদ্ধে প্রায় একটা বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন। ওঁরা যেন ঠিকই করে নিয়েছেন, ওঁরা আস্তে হাঁটবেন। কম কথা বলবেন। ওঁদের ছবি থমকে যায়, জিরিয়ে নেয়, উদাস হয়ে যায়! প্রায়শই যে কাজে যতটা সময় লাগার কথা, সে কাজে ততটাই সময় নেয়। মানে একটা লোক দরজার চৌকাঠে পা রাখল আর পরের শটেই বাসস্টপে পৌঁছে গেল, এমনটা নয়। বাড়ি থেকে বাসস্টপ যেতে যতটা সময় লাগে, ততটাই নিল। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ অনেকটা যেন অজান্তেই নিজের মতো করে তাল-লয় ঠিক করে নিয়ে এই আন্তর্জাতিকের সুরে গলা মেলায়।
গত বছর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে উপচে পড়া প্রেক্ষাগৃহ দেখে ৎসাই মিং লিয়াং হেসে বলেছিলেন, আমি জানি একটু পর থেকেই আপনারা বেরোতে শুরু করবেন। বলবেন, এত স্লো ছবি বসে দেখা যায় না। কিন্তু আমি মনে করি, এক একটা অঞ্চলের জীবন যাপনের এক একটা ছন্দ আছে। প্রতিটি মানুষের একটা নিজস্ব ছন্দ আছে। আমি আমার ছন্দে ছবি করি। আমি চাইব, কলকাতার পরিচালকরাও তাঁদের নিজের ছন্দে ছবি করুন।
কথাগুলো শোনার পরের দিন ওই উৎসবেই ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ দেখার সু্যোগ হয়। মনে হয়েছিল, ৎসাই মিং-এর কথাগুলোর একটা অনুরণন পাওয়া গেল। নইলে ইদানীং স্মার্টনেসের আরাধনায় বাংলা ছবি নিজেকে কখন কোটেশন-কণ্টকিত ছাত্রবন্ধু বানিয়ে তুলেছে, তা বোধ করি সে নিজেও জানে না। ‘পথের পাঁচালী’র নির্মাণ পর্বে ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকে হাসাহাসি করতেন, ‘জলফড়িংয়ের নাচ দেখানো কী আজগুবি সব কাণ্ড’ ইত্যাদি বলে। সেটা ছিল চোখ তৈরি না থাকার সমস্যা। আজ মাঝে মাঝে শঙ্কা হয়, তৈরি চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না তো? না হলে এতোলবেতোল উদ্ধৃতির সম্ভারকেও সহজেই মহতী সৃষ্টি বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে কেন? মুড়িমিছরি ভেদ ভুলে সবেতেই ‘অ-সাম’ বলে হামলে পড়া হবে কেন? দালি-বুনুয়েলের শরণ নিয়ে চোখের মণিতে আর এক বার ক্ষুর চালিয়ে নেওয়া দরকার। নইলে তাড়াতাড়ি দৌড়নোর উদগ্র বাসনাতেই না আখেরে পিছিয়ে পড়তে হয়!