ক ঙ্কালের সঙ্গে এক ঘরে থাকছি, কঙ্কালকে খেতে দিচ্ছি, কঙ্কালের সঙ্গে কথা বলছি, তাই নিয়ে রাজ্যি তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে! লোকটা এমন আচাভুয়া কেন? জীবন্ত লোকে পৃথিবী গিজগিজ করছে, তাইলে এ কেন মৃতদেহের সঙ্গে সময় কাটায়? কেন জিতা-জাগতা বিশ্বে বেরিয়ে এক বার দেখে না, আজ কেমন হাওয়া দিচ্ছে? তা বাওয়া বাঙালি, তোমরা কি যুগ যুগ ধরে প্রিসাইসলি এই কাণ্ডটিই করে চলেছ নে? তোমরা আমার চেয়ে আলাদা? আক্ষরিক অর্থে কেউ ফি ইভনিং কঙ্কাল জড়াচ্ছ না ঠিকই, কিন্তু মরে পচে হেজে যাওয়া অতীতকে নিয়ে লেপ্টেজুপ্টে বাস করাটাই কি তোমার ট্রেডমার্ক নয়? যে মুহূর্তগুলো চোখের সামনে দিয়ে ঝুরঝুর বয়ে যাচ্ছে, আর যে মুহূর্তগুলো আসব-আসব করে ওয়ার্ম-আপ বাগাচ্ছে, সেগুলোর প্রতি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত থেকে, তুমি কি নাগাড়ে প্রাচীন অয়েল পেন্টিং-এর পানে তাকিয়ে গলার ডিম ফাঁপিয়ে গাইছ না, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! সেই দিনগুলো ধুলোয় মিশে গেছে, তা থেকে উঁচিয়ে আছে স্রেফ দু-তিনটি খ্যাসটা-মারা মিথ-এর রোঁয়া। তাই গিলতে গিলতে, তুমি দরজাটা এ-ইটুকুনি ফাঁক করে ডেলিভারি নিচ্ছ থ্রিজি, তাপ্পর বিজি আছ কী দেখতে? ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট লাবণ্য-ক্লিপিংস!
যৌবনে পা দিয়েই, কোথায় রগরগে আনেওয়ালা দিনরাত্রিকে ইনভাইট করবে, বাঙালির শুরু হয়ে যায় ছোটবেলার জন্যে মন-কেমন। ইস, কেমন লাল পড়লে মা মুছিয়ে দিত। তার পর, তিরিশে পৌঁছেই, সে হাঁউমাউ শুরু করে, অ্যাই অ্যাই, কুড়ি-বাইশ-পঁচিশ চলে গেল রে, আমার উপভোগ করা হল না তো? রোকো রোকো, কন্ডাক্টর! আর রোকো! যখন কুড়ি-বাইশ এসে জামার হাতায় টান মেরে সাধছিল, তখন হাঁ করে নিজ হামাগুড়ির পানে ফোঁপাচ্ছিলে কেন? তার ওপর বাঙালি কুড়ি থেকে ছাব্বিশের মধ্যে মিহি করে প্রথম লেঙ্গিটিও খেয়ে যায়। এখন নয়া অ্যাডভেঞ্চারের দিকে জাম্প দেবে কি, সে বালিশকে টানা শুধোয়, ও কেন আমায় নিলে না? আরে বাপ, নিলে না তো নিলে না, তুই পেছন ফিরে বিলীয়মান পিকনিকটিকে না নেত্রিয়ে, বারেক আঁখি ফাড়কে দেখ না, দুয়ারে দাঁড়ায়ে দিওয়ানা। উঁহু, তোরা ফুচকা-মৃগয়ায় যা, আমি ওয়াক-ওভার দেব। ফেলে আসা স্কোপগুলি আমায় যে পিছু ডাকে। ওকে কেন বলিনি, তাকে কেন ধরিনি, নোটস নিতে গিয়ে কেন ডাকিনি ‘ও হরিণী!’ তার পর, ক্যাবলামির এই ঐকিক আলেয়াবাজি মেনে, চল্লিশে পৌঁছেই, আঁ, বি-ফ্ল্যাটে বিলাপ করতে তিরিশ গেল যে, এবে কোত্থেকে ফিরে পাই?
কলচর? হা সিক্সটিজ জো সিক্সটিজ। তখন কফি হাউসে ওমলেটে ছিল অলৌকিক পেঁয়াজ, ডবকা মেয়েদের মধ্যে ছিল কবি-প্রেমের রেয়াজ। শ্যামলা ঝোপে টানা বাজত ‘পথের পাঁচালী’ থিম, মাঝরাত্রে মাঠে ডাকত হাট্টিমাটিম! সেই একখান ডোভার লেনের পাস পেয়ে সারা রাত ঢুললাম, আর রবিশঙ্কর কী সব যেন বাজালেন, আহা! আঁকাআঁকির ফিল্ডে ইয়ে উঠছেন, নাটকের ফিল্ডে উয়ো, কান-বার্লিনে সুয়ো যাচ্ছেন, সঙ্গে যাচ্ছেন দুয়ো। যা হওয়ার, সঅব তখন হয়ে গেছে।
ওগো সেই উত্তমকুমার কোথা গেল গো, ওগো দেবদুলালের মতো খবর কে পড়বে গো! ফিউশন ফুড জিভে দিয়েই বাঙালি বলে, ‘ওঃ, মা-র সেই থ্যাবলা লুচি আর বাঁধাকপির ঘ্যাঁট, অমৃত!’ ই-মেলে বিদ্যুৎবেগে কথা চালতে চালতে রোদন জাগে: আহা, চিঠি কী রোম্যান্টিক! কী সু-শামুক! পারলে সে পাড়ার বেকার কাকুকে এখুনি রানার করে নেয়! কচি ছেলেপুলে নতুন সিনেমা সম্পর্কে লেখে, স্নিগ্ধ মাইরি, এমন পিরিয়ড দেখিয়েছে, যখন ফেসবুক ছিল না! স্বর্গ! লিখেই ফেসবুকে পোস্ট। আটশো লাইক।
কবীর সুমন যখন ’৯২-তে বিস্ফোরণ ঘটালেন, বাঙালি বলল ‘ধুস! এ জিনিস টিকবে না কি? গানের মধ্যে আনসান কথা, স্টেজে খিস্তি!’ এখন সুমন বৃদ্ধ হলেন, শোনা যাচ্ছে, ‘হ্যাঁ, উনি এক পিস ছিলেন বটে, যেমন নলেজ, তেমনি লিরিক, কিন্তু তার পর যা হচ্ছে! ছ্যা ছ্যা!’ ক্রমাগত এই জাত ফ্ল্যাশব্যাকাচ্ছে, রিয়ার ভিউ মিরর-এ তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, সামনে হাতি পড়লেও দেখতে পাচ্ছে না। অবশ্য যারা কলচর রমরমাচ্ছে, তারাও কি রেট্রোবিলাসে নেই? নাটকে এখন আদ্যিকালের লোকের বায়ো-ডেটা ধরে টান, এ শম্ভু মিত্তির সাজছে, ও নিচ্ছে অজিতেশের চরিত্তির। সিনেমা যে সিনেমা, টাটকা-পনার আখড়া, সে অবধি রেগুলার রবীন্দ্রনাথের ন্যাজ ধরে দোল খাচ্ছে। ‘বছরে তিরিশ বার চিত্রাঙ্গদা আর...’— গৎ মেনে: ‘এ বছরে in vogue... কাদম্বরী, যোগাযোগ’! হায়, সৌরভ আইকন থেকে কুইজ মাস্টার হয়ে গেলেন, বাঙালি আর যায় কোথায়। অতএব লাগাও সেই ১৮৬১।
রাজনীতিও নাকি এখন অনেক ইতর হয়ে গেছে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা জ্যোতি বসুর জন্যে গলা চোক হয়ে আসে। বিলেতের ব্যারিস্টার বলে কথা! কী সুন্দর ইনকমপ্লিট সেনটেন্স, ‘তদন্ত হচ্ছে’ বলে উদ্ধত বেরিয়ে যাওয়া। রাজ্যটাকে পানাপুকুর করে স্থবিরতায় দীক্ষাদান, প্ল্যান করে মেরুদণ্ড ভেঙে ‘উন্নয়ন তাড়া, সিপিয়েম আন’! ইংরিজি টু কম্পিউটার, তাবৎ প্রগতি-অস্ত্র বাতিল করে কেমন আমাদের চির-নুলো রাখলেন!
আজ মধ্যবিত্তও লোন নিয়ে বাড়ি করতে পারে। গণতন্ত্র আলট্রা-জাগ্রত থাকে মিডিয়ার ঠোস আগ্রাসনের দৌলতে। টেকনোলজি হাতে-হাতে হাজির করে নতুনতম ফরাসি সিনেমা বা জার্মান গান। চেলসি ঝাঁপিয়ে বলে, ‘দেখ কেমন খেলসি!’ আর বাঙালি ডুকরে ফর্মার পর ফর্মা উগরে বলে, অতীত দাও! লোডশেডিং দাও, ফিরিওলার ডাক দাও! এটা প্ল্যানচেট নয়? এটা মৃতদেহ আঁকড়ে তার মুখে রুটি-তড়কা গুঁজে দেওয়া নয়? তোদের ম্যাপ থেকে চামসে দুর্গন্ধ বেরচ্ছে না? আমি তো তোদেরই এক্সট্রিম চেহারা রে, কঙ্কালবাজ বাঙালি!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়