কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিবারণের আইন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইতে পারে না— সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই সিদ্ধান্ত জানাইয়াছেন। সিদ্ধান্তটি আইনি প্রশ্নের মীমাংসা করিল। কিন্তু যে উদ্বেগ হইতে শীর্ষ আদালতের নিকট এ বিষয়ে আবেদন করিয়াছিলেন এক আইনজীবী, তাহার নিরসন হইল কি না, সে প্রশ্ন থাকিয়াই গেল। আইনজীবীর বক্তব্য ছিল, মন্দির-আশ্রম, ক্যাথলিক গির্জা প্রভৃতি ধর্মস্থান হইতে বারংবার অভিযোগ উঠিতেছে ধর্মগুরু অথবা প্রবীণ পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে। তাঁহারা নিজেদের মহিলা ভক্ত এবং কর্মীদের উপর নিপীড়ন চালাইয়াছেন, এমনকি ধর্ষণ করিয়াছেন, এমন সংবাদ মিলিয়াছে। বিচারে সাজাপ্রাপ্ত হইয়াছেন ধর্মগুরু, এই দৃষ্টান্তও কম নহে। ২০১৭ সালে রাম রহিম বাবা একাধিক ধর্ষণের কারণে দোষী সাব্যস্ত হইয়াছেন। তাঁহার নিগ্রহের শিকার হইয়াছিলেন মহিলা ভক্ত এবং সন্ন্যাসিনীরা। চার শতেরও অধিক আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা আসারাম নাবালিকা নিগ্রহে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাইয়াছেন। কেরলে ক্যাথলিক চার্চে প্রভাবশালী যাজকদের দ্বারা সন্ন্যাসিনীদের ধারাবাহিক যৌন নিগ্রহের ঘটনায় গোটা দেশ তোলপাড় হইয়াছে। ধর্ষণের মামলা রুজু হইয়াছে, সুবিচারের দাবিতে সন্ন্যাসিনীরা মিছিল করিয়াছেন। এই সমস্ত ঘটনা দর্শাইয়া আবেদনকারী আইনজীবী প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কর্মস্থলে যৌন হয়রানি হইতে মেয়েদের সুরক্ষার যে ব্যবস্থা দফতর, কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি কর্মক্ষেত্রের জন্য নির্দিষ্ট করা হইয়াছিল, তাহা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির জন্যও আবশ্যক হউক। ক্ষমতার অসাম্যের জন্যই কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে সহসা প্রতিবাদ করিতে পারে না মেয়েরা। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যদি কর্মস্থলের মতোই চলে, সেই অসাম্য কি সেখানেও থাকে না? হয়তো কিছু অধিক মাত্রাতেই সেখানে এই অসাম্য রহিয়াছে, কারণ ধর্মগুরুর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য, তাঁহাকে ঈশ্বরপ্রতিম বলিয়া দেখিবার অভ্যাসটি এ দেশের মজ্জাগত। তিনি অপরাধী, এই অভিযোগ পরিবার হইতে পুলিশ, কেহই সহজে মানিতে চাহে না।
সুতরাং, প্রায়ই দেখা যায় যে নির্যাতন চলিয়াছে দীর্ঘ দিন, মেয়েরা প্রতিকারের পথ খুঁজিয়া না পাইয়া বিপন্ন। কর্মক্ষেত্রেও ঠিক একই কারণে মহিলাদের নিগ্রহ সহিতে হয়, পুলিশে অভিযোগ করিলে রোজগার হারাইবার ভয় থাকে। এই জন্যই ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট কর্মরত মহিলাদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের বিধি নির্দিষ্ট করিয়াছিল। ২০১৩ সালে সে বিষয়ে আইন পাশ হইয়াছে। আদালত কর্তৃক নির্দিষ্ট নিয়মাবলি সকল নিয়োগকারী সংস্থাকে মানিতে হয়। কোনও অভিযোগকারিণীর কাজের নিরাপত্তা বজায় রাখিয়া, কাজের পরিবেশকে সুরক্ষিত এবং স্বস্তিদায়ক রাখিয়া তাহার অভিযোগের নিষ্পত্তি করিতে হয়। কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতার অসাম্য যাহাতে বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত না করিতে পারে, তাহার জন্য সুরক্ষাকবচও রাখা হইয়াছে আইনে।
কেহ বলিতে পারেন, কর্মক্ষেত্রে নিয়োগকারী এবং নিযুক্ত কর্মীর যে সম্পর্ক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্বেচ্ছাসেবী ও ভক্তদের সহিত প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীদের সেই রূপ সম্পর্ক নহে। বিবিধ ধর্ম ও সম্প্রদায়কে নিজস্ব অনুশাসন মানিবার অধিকার সংবিধান দিয়াছে। আশ্রম-গির্জার পদাধিকারী ও ভক্তেরা সকল কার্যাবলি চালাইবেন, ইহাই অভিপ্রেত। এই সমালোচনা মানিয়া লইলে একটিই আক্ষেপ থাকিয়া যায়। ভারতের বহু ধর্মস্থানে মহিলা, নিম্নবর্ণ, ভিন্নধর্মের মানুষের যে অমর্যাদা ও নিপীড়ন দৃষ্ট হয়, কোনও ধর্মীয় অনুশাসনে কি সে সব অন্যায়কে বৈধতা দেওয়া সম্ভব বা উচিত? সর্বত্র আইনের তর্জনী দেখাইবার প্রয়োজন হয়তো নাই। কিন্তু অন্যায় যে হইতেছে তাহা স্বীকার করিতে হইবে। এবং তাহার প্রতিরোধ প্রয়োজন, তাহাও ভুলিলে চলিবে না।