তিন বছরেও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সুরাহা কোথায়?

হায় রে ভারতের অর্থনীতি! আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নগামী, কর্মসংস্থান নেই। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালহায় রে ভারতের অর্থনীতি! আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নগামী, কর্মসংস্থান নেই। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য দায়িত্ব কার?

Advertisement

রাম-শ্যাম-যদু-মধু-আমরাই কি দায়ী? নাকি দেশের অর্থনীতিবিদরা এই সঙ্কটের জন্য দায়ী? আমার মনে হয়, যাঁরা ক্ষমতার শীর্ষে উপবিষ্ট, যাঁরা উর্ধ্বতন স্তরে নীতি নির্ধারণ করেন, যাঁরা এই সব নীতি রূপায়ণের নির্দেশ দেন, তাঁরাই এই সঙ্কটের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। দলীয় স্বার্থে, নির্বাচনের স্বার্থে তাঁরা দেশের প্রয়োজনের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেন।

অর্থনীতিবিদদের কোনও সম্মিলিত গোষ্ঠী হয় না। অর্থনীতিবিদদের নিজেদের মধ্যেও অনেক মতান্তর থাকে। কিছু অর্থনীতিবিদ নিয়ন্ত্রিত হন তাঁদের রাজনৈতিক মতবাদের দ্বারা। আবার অনেকে স্বাধীন ভাবে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেন। তবে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রায় সব অর্থনীতিবিদ বলে এসেছেন, দরিদ্র জনবহুল দেশে আর্থিক উন্নতিকে দ্রুততর করতে গেলে সঞ্চয় বাড়ানো দরকার। আর সেই কারণে পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রথম দিকে ভোগ্যদ্রব্যের উত্পাদনকেও কিছুটা সংহত করতে হয়েছে। শুধু অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় না, বিদেশি সঞ্চয়ের চেষ্টাও ছিল।

Advertisement

ভবতোষ দত্ত একদা বলেছিলেন, “আমাদের অর্থনীতিবিদরা একটা মস্ত বড় ভুল করেছিলেন। সেটা হল, যোজনা কমিশনও মনে করেছিল ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বছরে এক শতাংশেরও বেশি। তা ছাড়া চিনের ভারত আক্রমণ, চল্লিশ বছরে চার বার পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের সঙ্কট, সরকারের বাজেটে বিরাট ঘাটতি, মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা ভারতের অর্থনীতিকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছে।

১৯৯১ সালে এই সঙ্কটজনক অধ্যায়ে এক যুগান্তকারী মোড় আসে। ১৯৯০-’৯১ সালে রাজস্বখাতে ঘাটতি, বাজেট ঘাটতি, ফিসকাল ডেফিসিট বেড়ে ঋণের ফাঁদও তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রশ্নেও ভারত মুখ থুবড়ে পড়ে। ’৮৯-এর শেষে সাধারণ নির্বাচনে বিশ্বনাথপ্রতাপের সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়ে। পিভি নরসিংহ রাওয়ের যুগে মনমোহন সিংহ অর্থমন্ত্রী হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ভারতকে খাপ খাওয়াতে সমর্থ হন। ’৪৮ সালের শিল্পনীতি থেকে ’৯১ সালের শিল্পনীতিতে এল বিরাট পরিবর্তন। লাইসেন্স-পারমিট যুগের অবসান ঘটিয়ে প্রকৃত আর্থিক সংস্কারের উদ্যোগ শুরু হয়।

তাঁর জমানায় অর্থনীতিকে এই কড়া দাওয়াই দিতে গিয়ে তবে কি ভোটের রাজনীতিকে রাও অবজ্ঞা করেছিলেন? ঠিক তা নয়, তবে রাও-মনমোহন কিছু সংস্কারমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, রাজনৈতিক পপুলিজমের তোয়াক্কা না করেই। আর সে জন্য অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পরাস্ত হয়। তেলুগু বিড্ডা হয়ে নিজের রাজ্যে পরাস্ত হন রাও। আর এন টি রামা রাও ২ টাকা কিলো চাল দেওয়ার কথা বলে ভোটে যেতেন। মনে আছে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে মনমোহন সিংহের আর্থিক সংস্কারের নীতি প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রণব মুখোপাধ্যায় মধ্যপন্থা গ্রহণের কথা বলেন। ঘোষণা করা হয়, ‘রিফর্ম উইথ হিউম্যান ফেস’।

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় অনেকেরই মনে হয়েছিল, ভারত আর্থিক সংস্কারের ঝুঁকি নেবে। ২৮২টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও মোদী তা করলেন না। বরং তিন বছর পর মোদী-অমিত শাহ ভোটের রাজনীতিতে জেতার জন্য ‘রাজনৈতিক পপুলিজম’-এর কথা বলছেন। পেট্রোলিয়াম পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার আপত্তি সত্ত্বেও। প্রথম পর্বে মোদী আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগোতে চান, কিন্তু দিল্লি ও বিহারে পরাজয়ের পর ‘ব্যাক গিয়ার’ দেয় বিজেপি। তা ছাড়া শিল্পপতি মহল-জগদীশ ভগবতীরা যেমন মোদীর বিজেপিকে উন্মুক্ত অর্থনীতির পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তেমন সঙ্ঘ পরিবার-বিএমএস আর্থিক সংস্কারের প্রশ্নে বামপন্থীদের মতোই ধীরে চলো নীতিতে বিশ্বাসী।

ফলে আজ পপুলিজম বনাম পপুলিজম। ইউপিএ-র দশ বছরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মনমোহন সিংহ নিজেও ’৯১ সালে নেওয়া তাঁর আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলেন। সনিয়া নিজে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ গঠন করে বামপন্থী-সমাজতন্ত্রী পথ ধরে এগোতে চান। অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজ-এর মতো অর্থনীতিবিদেরা সে সময় গুরুত্ব পান সনিয়ার কাছে।

আজও অমর্ত্য সেন বলছেন, ভারতে এমন একটা রাজনৈতিক দল হওয়া প্রয়োজন যারা ভোটের কথা ভেবে দেশের আর্থিক নীতি রূপায়ণ করবে না। শুধু সংস্কারের কর্মসূচিতে একটি রাজনৈতিক দল গঠন আবশ্যক। যাঁরা ভাবেন, অর্থনৈতিক সংস্কার মানেই গরিব মানুষের সামাজিক কল্যাণের বিরুদ্ধে, তাঁদের এবং বামপন্থীদের অতীতের গোঁড়া মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। সংস্কার মানেই পুঁজিবাদ আর তার মানেই সেটি জনগণবিরোধী, এ-ও এক অতি সরলীকরণ।

তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মোদীও ভোটের রাজনীতিতেই প্রবল ভাবে নিমজ্জিত। জিএসটি নিয়ে রক্ষণাত্মক। মুদ্রাস্থগিতের কুফলগুলিও টের পাচ্ছেন। কাজেই আবার ভর্তুকি, কৃষক ঋণ, স্টিমুলাস প্যাকেজ জিন্দাবাদ। হায় রে ভারতের অর্থনীতি! আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নগামী, কর্মসংস্থান নেই। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ভয়াবহ। দেশের অর্থনীতির সঙ্কটের মূল সমস্যার কোনও সমাধান হল না।

পল স্যামুয়েলসন বলেছিলেন, অর্থনীতিবিদরা অনেক ভুল করেন, কিন্তু অন্যেরা ভুলটা করে আরও বেশি। এই অন্যরাই দেশের সিংহাসনে উপবিষ্ট। শাসক। আমরা শাসিত। আমরা কি ভুল করছি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement