‘পয়লা বোশেখ, টেক প্লিস টেক, এনেছি নতুন দিনের নতুন খাবার জল ভরা তালশাঁস...’— পয়লা বৈশাখের দিন এই গানটা ছিল আমার জাতীয় সঙ্গীত। গানটা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গলায় শোনা কোনও এক পয়লা বৈশাখের দিন। মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠান থেকে ক্যাসেটে রেকর্ড করা। ‘চেতনা’-র ‘জগন্নাথ’ নাটক আছে, তার আগে রামকুমারের গান। পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গার বিখ্যাত মিষ্টি নিয়ে বাঁধা এই গান। বর্ধমানের মিহিদানা থেকে মোল্লার চকের দই পর্যন্ত মিঠাই শুমারি। সুতরাং এটাকে ভোজনপ্রিয় বা আরও নির্দিষ্ট করে মিষ্টি প্রিয় বাঙালির অন্তরের গান বলা যেতে পারে। তবে সে বাঙালি আর সে বাঙালি নেই। সে মিষ্টিও ভালবাসে না, তর্কও ভালবাসে না। ‘তুমি আর নেই সে তুমি।’ আমিও আর নেই সেই আমি। যৌবনের এই সময়টায় এই গানে মেতে ছিলাম, বা তারও আগে কৈশোরে যখন পয়লা বৈশাখের দিন মায়ের সঙ্গে শিবপুর বাজারে সুধালাল শঙ্করলালের দোকান থেকে নতুন ক্যালেন্ডার আর মিষ্টি-নোনতার প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরতাম, বাড়ির সামনে ধোপার মাঠে শুরু হত এক সপ্তাহব্যাপী রামযাত্রা। এবং তার অনেক পরে কলেজ পড়ুয়া তরুণ কোনও একদিন রামকুমারের গানটা পাল্টে দিয়ে ধরল ‘হাল ছেড়ো না’র গান। তখনও বৈশাখের সেই প্রথম দিনটাতে গা থেকে গজগজিয়ে উঠে আসত দর্জির দোকান থেকে সদ্য আসা নতুন জামার বিটকেল গন্ধ বা প্যান্টের খাঁজে খাঁজে লেগে থাকা ঘাড়ে মাপের ফিতে ঝোলানো মাস্টারের নীল খড়ির দাগ। তখন আর রেডিমেডের যুগ কোথায়, ব্র্যান্ডই বা কি? প্রিওয়াশড ফ্যাব্রিকই বা কোথায়?
তখনের পয়লা বৈশাখের সেই সময়টার থেকে আজকের সময়ের একটা বিপুল পটবদল হয়ে গেছে। কিন্তু সেটাই তো স্বাভাবিক সরণ। এ রকমটাই তো হওয়ার কথা। সময়টা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলে কি ভাল হত? ওই সব স্মৃতির রোমান্টিক আবিলতায় থমকে থাকলে সভ্যতার চলবে? স্মৃতি রোমন্থন তার অতীতের অনড়তায় স্থাণু থাকুক, দেওয়ালে টাঙানো মৃত মানুষের ছবির মতো, মাঝে মাঝে না হয় তাক থেকে পেড়ে ধুলোটুলো মুছে একটু ধূপ দেখালেই হবে। তাকে নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর হবে না। আধুনিকতার পরিভাষায় যাকে বলে ‘মুভ অন’। স্মৃতি এবং বর্তমানের এই দূরত্ব এমন তীব্র গতিতে বেড়েছে যে মাত্র বিশ বছরেই মনে হচ্ছে ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ আমাকে বিপন্ন করছে। তা সত্ত্বেও আমাকে তো আধুনিক, সমসাময়িক, জঙ্গম সময়টার মধ্যেই উজান বাইতে হবে। কারণ সময় আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। তার স্রোত ঠেলেই আমাদের এগোতে হয়। সেই জন্যই স্রোতে গা ভাসানো পিছু হাঁটার নামান্তর। আমাদের আদিমন্ত্র এবং জীবনদীক্ষা হল এগিয়ে চলা, চরৈবেতি...চরৈবেতি ‘হে আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না’।
অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র
কিন্তু যে পটবদল ঘটেছে এবং ঘটমান, যে প্রগতি এবং উন্নয়নের মানদণ্ডে আমরা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি সেখানে পয়লা বৈশাখ বা বাঙালিদের এই স্বতন্ত্র দিনগুলো ক্রমাগত অবান্তর হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোনও প্রাদেশিকতা বা শিকড়ের ফেরার ডাক শুনবেন না। পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণও আমাদের ক্যালেন্ডারে বিশেষ দুটো দিন। আশঙ্কা হয়, এই দিনগুলোও না আমাদের সময়ে ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে যায়। আসলে কথাটা হল আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে পার্বণের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তা এখন অগুনতি ধামাকাতে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন ধামাকা-হাঙ্গামায় মুখ ঢেকেছে পাব্বণের। ছিয়াশি সালের ‘হোপ 86’ থেকে এই প্রবাহের শুরু বলা যেতে পারে। এমন আশার আলো জ্বেলেছিল বামপন্থী সরকার, সে দিক থেকে আমাদের আর অন্য দিকে মুখ ফেরানো গেল না। তার শেষ দেখে তাঁরা গদি ছাড়লেন। বাকিটা ‘আর এক শেষের’ অধ্যায়। যেমন ধরা যাক সন্ত ভ্যালেন্টাইনের দিন বলে যেটা জানা গেল। এই দিনটা আগামী প্রজন্মের কাছে পয়লা বৈশাখের থেকে অনেক বেশি মান্যতা পায়— ভ্যালেন্টাইন্স ডে। নন্দন চত্বরে পান্তাভাত, পুঁইচচ্চড়ি, সুক্তো, শুঁটকি মাছ, মালপোয়া দিয়ে যে বাঙালির চড়ুইভাতি আয়োজন করা হয় এই সর্বগ্রাসী বিদেশি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তার সামাজিক অভিঘাত ওই চত্বরেই বাঁধা পড়ে থাকে। যে জেনারেশন ম্যাকডোনাল্ডসের বার্গার বা পিৎজা হাটের পাস্তা বা কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন খেয়ে বড় হচ্ছে তাদের লাউচিংড়ি বা সজনেডাঁটা দিয়ে প্রলোভিত করা যাবে না। তাদের হাত থেকে ব্যাটম্যান কেড়ে নিয়ে ঠাকুমার ঝুলি ধরিয়ে দিলেও হবে না। টিভিতে নিনজা হাত্তরি পাল্টে ঈশপের গল্প শোনালে তারা মানবে না। হ্যারি পটারের বদলে ক্ষীরের পুতুলে কি তাদের মন উঠবে? কারণ আমরা যে সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে অবস্থান করছি তাতে এগুলোকে আর পরিপন্থী না ভেবে পরিপূরক হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে। আমার দশ বছরের ছেলেকে যদি এই সব থেকে সরিয়ে রাখি তা হলে সে স্কুলে গিয়ে একাকীত্বে ভুগবে, বিষণ্ণতায় আলাদা হয়ে পড়বে।
আসলে বৈপরীত্যের নিরিখেই সব কিছুর সহজ সমাধান হয়ে যায়। তাই জটিল কূটকচালে না গেলেই ভাল। আরও বড় বড় কেউটে বেরিয়ে পড়তে পারে। এক দিকে রামের নামে মসজিদ ভাঙে, অন্য দিকে রামধনুতে রামনাম আছে বলে একদল ভূত ওকে রঙধনু বলে। এ সব তর্কবিতর্কে গেলে আবার যদি বদলি হয়ে যায়, বিশেষ পদটা চলে যায়, কেউ এসে পিটিয়ে যায়, একঘরে করে দেয়। তর্কপ্রিয় বাঙালি আজ একটা মিথ। তর্ক দূরে থাক, দেখা যাচ্ছে তারা বেশিরভাগই কর্তাভজা হয়ে গেছে। বিশেষত চিন্তাবিদ বা শিল্পীদের মধ্যে বা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সং’দের সংখ্যাধিক্য। রক্তকরবী-র যক্ষপুরীর মতোই এখানে সবাই কেমন যেন ভয়ে ভয়ে আছে। যে মহাজাতি সদনে রামকুমারের পুরাতনী শুনেছিলাম, সেই সদন ‘মহাজাতির’ উদ্দেশে নির্মিত হয়েছিল। যে ইমারতের ভিত্তিপ্রস্তরে খোদাই করা আছে রবীন্দ্রনাথ এবং সুভাষচন্দ্রের নাম, ভাবা হয়েছিল এটা হবে বাঙালির মননচর্চার এবং মেধার অনুশীলন কেন্দ্র, সেটা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াল ইন্দ্রজালের আখড়া। আমি ওই যাদুকরের দক্ষতা বা ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। তিনি মহান মাপের যাদুকর। কিন্তু আমি আমাদের মহাজাতির মহা অবনমনের কথা বলছি। যেখানে যেটা হবার নয়, সেখানে সেটা হয়। এই আমাদের ভবিতব্য।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, গত দুবছর কলকাতার বাইরে থাকার ফলে কলকাতাকে একটু দূর থেকে দেখার বা বাঙালিদের সম্পর্কে অবাঙালিদের কী মনোভাব সেটা কাছ থেকে দেখার অবকাশ হয়েছে। যেমন এখন যখন লেখাটা শেষ করছি, বসে আছি মার্কিন দেশে, ট্রাম্পের রাজত্বে। এসেছি লস এঞ্জেলেসে ‘অসমাপ্ত’ দেখাতে। কথা হচ্ছিল প্রবাদপুরুষ চলচ্চিত্রকার আদুর গোপালকৃষ্ণণের সঙ্গে। উনি বলছিলেন এক সাহেব চলচ্চিত্রকারকে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালের কথা, রবীন্দ্রনাথের কথা। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওরা’ হল ভারতের মাথা, ওরা সব কিছুতেই একটু এগিয়ে আছে। আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, এখনও কি আর সে কথা বলা যায়? তাতে উনি একমত হলেন বটে, বাঙালি যে ‘তৃপ্তির মুমূর্ষু টানে’ খানিকটা আটকে গেছে, সেটাও বললেন। তারপরে একটু থেমে বললেন, ‘জান সুমন, তবুও...’।
পয়লা বৈশাখের দিনে এ কথা যেন একটু স্মরণে থাকে!