শিল্পী: রামকিঙ্কর।
রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ১৯৩০-এর দশকে যে ক’জন শিল্পীকে বিশ্বের সামনে মেলে ধরেছিল রামকিঙ্কর তাঁদের অন্যতম। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রায় সমসাময়িক এবং সতীর্থ। নন্দলাল বসু তাঁদের দু’জনেরই শিক্ষক। নন্দলালের শিল্পীজীবনের সূচনা যদিও বিংশ শতকের প্রথম দশকে, তবু ১৯১৯-এ কলাভবন প্রতিষ্ঠার পর শান্তিনিকেতনে এসেই তাঁর প্রতিভা নতুন আলোয় বিকশিত হতে থাকে। এবং ১৯৩০-এর দশকেই এর সর্বশ্রেষ্ঠ উন্মীলন ঘটে। এই তিনজনকেই প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে উদ্দীপিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নিজের ছবিরও শ্রেষ্ঠ ফসল নির্ঝরিত হয়েছিল ১৯৩০-এর দশক জুড়ে। এই চারজন শিল্পীকে কি আমরা শান্তিনিকেতন ঘরানার অন্তর্গত বলে ভাবতে পারি? এই চারজনের প্রতিভা এবং প্রকাশে ব্যবধান প্রচুর। কিন্তু একটা জায়গায় তাঁদের মিল। তাঁরা সকলেই দৃশ্যকলার ক্ষেত্রে শান্তিনিকেতন শুধু নয়, সামগ্রিক স্বদেশের আদর্শকেই বিশ্বের সামনে মেলে ধরেছিলেন। বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর তিরিশের দশকে শুরু করলেও তাঁরা ছিলেন চল্লিশের আধুনিকতাবাদী বিস্তারের অগ্রদূত। বিনোদবিহারী যখন সমগ্র প্রাচ্য-ঐতিহ্যকেই ধ্রুবতারার মতো অনুসরণ ও উন্মীলিত করেছেন, তখন রামকিঙ্কর সচেষ্ট হয়েছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটাতে, আদিম ও আধুনিককে মিলিয়ে নিতে। একাধারে ভাস্কর ও চিত্রকর রামকিঙ্কর মননে, দর্শনে, জীবন-যাপনে এমনই এক স্বকীয় অবস্থানে থেকেছেন চিরদিন যে শান্তিনিকেতনও তাঁকে সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। আঘাত করেছে নানা ভাবে। প্রজ্বলিত হয়েছে তাঁর শিল্পী-সত্তা।
২০০৬-এ রামকিঙ্করের জন্মশতবর্ষ গেছে। তাঁকে স্মরণের কোনও অনুষ্ঠান কলকাতায় তখন হয়নি। দিল্লিতে খুব বড় মাপের পূর্বাপর প্রদর্শনী হয়েছে পরে। কলকাতায় সে অভাব পূর্ণ হওয়ার সুযোগ এল সাত বছর পরে। আকার প্রকার গ্যালারির উদ্যোগে সেখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল রামকিঙ্করের চিত্র, ছাপচিত্র ও ভাস্কর্য নিয়ে প্রদর্শনী। প্রদশর্নীটি পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন দেবদত্ত গুপ্ত। ৮০টিরও বেশি কাজ নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর একটি বৈশিষ্ট্য হল এখানে রামকিঙ্করের সুপরিচিত শ্রেষ্ঠ কাজের সংখ্যা কম হলেও আগে খুব একটা দেখা যায়নি। অন্তত একটি কাজের জন্য এই প্রদর্শনী স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেটি হল ‘কংকালীতলার পথে’ শিরোনামের ভাস্কর্য। এটি অল্প পরিচিত হলেও রামকিঙ্করের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য। ১৯৭৫ সালে এটি তিনি শুরু করেছিলেন। বড় আকারের ম্যাকেট তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার সুযোগ হয়নি। কংকালীতলা শান্তিনিকেতন থেকে কিছু দূরে একটি ধর্মীয় পীঠস্থান। সেখানে দেবীর আরাধনায় প্রচুর ছাগবলি দেওয়া হয়। এই ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে হাড়িকাঠ ও পূজা-উপচার নিয়ে যাচ্ছে কয়েক জন। সঙ্গে দড়িতে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটি ছাগল। ছাগলটি মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাচ্ছে। তার মাথাটি মানুষের। বিশ্বভারতী কলাবিভাগের ভবনের সামনে এই মূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। শিক্ষাব্যবস্থার অমানবিকতা ছিল এর মূল ভাবনা। সুতরাং পরিকল্পিত ভাবেই বাতিল হয়ে যায় অসামান্য এই ভাস্কর্যটির স্থাপনা। রামকিঙ্করকে সারা জীবনই এরকম নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। তাঁর ১৯৪৩-এর ‘ধান-ঝাড়াই’ মূর্তিটিও অশ্লীলতার দায়ে নির্বাসিত হয়েছে। আর একটি তেলরঙের ক্যানভাসও মনে রাখার মতো। শিরোনাম ‘লাঞ্চ’ বা মধ্যাহ্নভোজ। মাঠে কর্মরত এক কৃষক পরিবারের আলেখ্য। বলদটি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে বসে টোকা মাথায় কৃষকটি বাটি থেকে খাবার তুলছে। পিছনে বসে তার স্ত্রী। কিউবিজমের সূক্ষ্ম সারাৎসার নিয়ে জ্যামিতিক গাঠনিকতায় গড়ে উঠেছে ছবিটি। চল্লিশের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য-আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের মেলবন্ধন এই ছবিটিতে রামকিঙ্করের সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টিকে মেলে ধরেছে। পূর্বে উল্লিখিত শান্তিনিকেতনের অন্য তিনজন শিল্পীর থেকে রামকিঙ্কর কত স্বতন্ত্র, কত বাস্তববাদী, দারিদ্রের ভিতর, জীবনসংগ্রামের ভিতর কেমন করে অস্তিত্বের আলোটুকু ফুটিয়ে তোলেন, এই ছবি তার অনবদ্য দৃষ্টান্ত। কী বিষয়ে, কী আঙ্গিকে রামকিঙ্কর কখনও এক জায়গায় থেমে থাকেননি। নিজেকে পুনরাবৃত্ত করেননি। কিন্তু প্রতিটি রচনাতেই তাঁর অমোঘ ব্যক্তিত্বকে অনুভব করা যায়।