ভারতের আকাশে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ!
দিকে দিকে ‘পিকিং ডেইলি’-র সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে!
চিনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) মুখপত্রে প্রকাশিত হল সেই ঐতিহাসিক নিবন্ধ: ‘স্প্রিং থান্ডার ওভার দ্য ইন্ডিয়ান স্কাই’। দিনটা ১৯৬৭-র ৫ জুলাই। এর মাত্র কয়েক দিন আগেই ঘটে গিয়েছে উত্তরবঙ্গের অখ্যাত জনপদ নকশালবাড়িতে কৃষিজীবী, খেতমজুর ও চা বাগানের শ্রমিকদের উপরে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ। ভূস্বামী ও জোতদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন হাজার হাজার প্রান্তিক মানুষ। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জঙ্গল সাঁওতাল নামে এক বৃষস্কন্ধ যুবক। জঙ্গলের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় বামপন্থী কৃষক নেতা কদম ও খুদান মল্লিক, কামাখ্যা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবুলাল বিশ্বকর্মা। এই কৃষক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সিপিএমের এক সময়ের সর্বক্ষণের কর্মী কানু সান্যাল এবং খোকন মজুমদার। নকশালবাড়ির সেই প্রাঙ্গণ থেকে বেশ খানিকটা দূরে শিলিগুড়ি শহরে থাকতেন যে শীর্ণকায় বামপন্থী, পরের চার-চারটি দশক জুড়ে তাঁকে মানুষ চিনবেন ‘সি এম’ বলে!
চারু মজুমদারের সেই ভিনধারার চিন্তা কী ভাবে জারিত হবে মালদহের ইংরেজবাজারের এক যুবকের মননে, আমরা তা-ও দেখব! দেখব, অধুনা ‘হোক কলরব’-এর মাধ্যমে বার বার আলোচিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে হয়ে উঠেছিল উত্তাল ষাট আর সত্তরের দশকের অতি বাম ছাত্র আন্দোলনের আঁতুর। এ তথ্য অবশ্য নতুন নয়, যেমন নতুন নয় তার পরিপ্রেক্ষিতও। কিন্তু, সেই পর্বের ধারাভাষ্য যদি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে আলোচিত হয় আন্দোলনে ওতপ্রোত জড়িত কারও কলমে, তা নজর টানে বইকী। বসন্তের সেই বজ্রনির্ঘোষ নিয়ে জন্ম হয়েছে লক্ষ লক্ষ শব্দের। আবেগ-অতি আবেগ-অনাবেগে মোড়া সেই অজস্র শব্দবন্ধনী আমাদের কাছে ফিরে ফিরে এসেছে নানা রূপে-অনুভূতিতে-ব্যাখ্যায়।
কিন্তু, অভিজিত্ দাসের ফুটপ্রিন্টস অফ ফুট সোলজার্স পড়তে পড়তে খুলে যেতে থাকে বিদ্রোহ আর বিদ্রোহ দমনের সেই ইতিহাসের বহু-আলোচিত অধ্যায়েরও অজানা পাতা। প্রথম সারির নকশালপন্থী নেতাদের সঙ্গে অভিজিত্ দাসের নাম আলোচিত হয় না। তিনি সুপরিচিত লেখকও নন। বরং তাঁর ছদ্মনাম জয়ন্ত জোয়ারদার বাঙালি পাঠকের কাছে বেশি পরিচিত। এর আগে বাংলায় তাঁর একাধিক উপন্যাস ও গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য বইটি ইংরেজিতে তাঁর প্রথম গ্রন্থ।
বন্ধুদের সঙ্গে মহানন্দায় সাঁতরাতে সাঁতরাতে বড় হতে থাকা, নানা অ্যাডভেঞ্চারে মেতে থাকা এক কিশোর ধীরে ধীরে যুবকে পরিণত হবে, হায়ার সেকেন্ডারিতে জেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া, নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবারের সেই ছেলে মফস্সল শহর ছেড়ে পড়াশোনার জন্য ঠাঁই নেবে মহানগরীতে। এবং এক দিন কোন অমোঘ টানে যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে বিহারের পূর্ণিয়ায় কৃষকদের সংগঠিত করতে চলে যাবে— এ কথা কি তিনি নিজেও কখনও ভেবেছিলেন?
সত্যিই সে এক অস্থির সময়! ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে আমেরিকা-বিরোধী সুর সে সময় বিশ্ব জুড়ে। গোটা ফ্রান্সে বিদ্রোহ-বিক্ষোভ। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে আমেরিকায় চলছে মানবাধিকার আন্দোলন। এসে গিয়েছেন বব ডিলান। মাও জে দং-এর নেতৃত্বে চিনে চলছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডোর স্টেডিয়ামের ক্যান্টিনও উত্তপ্ত। প্রেসিডেন্সিতে প্রথম ছাত্র ইউনিয়ন দখল করেছে বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশন। প্রেসিডেন্সি কলেজ কর্তৃপক্ষ আট জন ছাত্রকে বহিষ্কার করেছে। সেই আন্দোলনের সমর্থনে যাদবপুরের ছাত্রেরা মিছিল করে প্রেসিডেন্সিতে আসছেন। সে দলে অভিজিত্ও আছেন। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে বামপন্থী ছাত্রদের তুমুল বিতর্ক! কাছাকাছি টেবিলে আড্ডা দিচ্ছেন শৈবাল মিত্র আর নির্মল ব্রহ্মচারী!
কলকাতা বড় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী, সংশোধনবাদী, বুর্জোয়া— নানা শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে এ দিক ও দিক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছে অতি বাম ছাত্রদের সংগঠন প্রগ্রেসিভ স্টুডেন্টস কোঅর্ডিনেশন কমিটি (পিএসসিসি)। এই সংগঠন মাও জে দং-এর ভাবনায় অনুপ্রাণিত। শুধু ছাত্র আন্দোলনেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ নয়। দক্ষিণ কলকাতার যুবক ও শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার কাজ চালাচ্ছে তারা। দক্ষিণ কলকাতার কাঁকুলিয়া, মনোহরপুকুর, পোদ্দার নগর, বন্ডেল রোডের বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে সংগঠন বাড়াচ্ছে তারা। কলকারখানার শ্রমিকদের নিয়ে রাজনৈতিক ক্লাসও করাচ্ছে। পিএসসিসি-র মিটিংয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন নাট্যব্যক্তিত্ব উত্পল দত্ত। আর নিজে এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে থেকেও চমত্কার ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছেন অভিজিত্।
এই সময়েই, ১৯৬৭-র ১৪ জুন কলকাতায় এক সম্মেলনে তৈরি হল ‘নকশালবাড়ি ও কৃষক সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’। সভাপতি হলেন প্রমোদ সেনগুপ্ত, যুগ্ম সহ-সভাপতি হলেন সত্যানন্দ ভট্টাচার্য এবং সুশীতল রায়চৌধুরী (এসআরসি)। সুশীতলবাবু সে সময়ে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য। কিছু দিন পরে এই সুশীতলবাবুর চিঠি হাতে নিয়ে শিলিগুড়ি শহরে ‘সি এম’-এর মুখোমুখি হবেন তরুণ অভিজিত্। তাঁর কাছে জানতে চাইবেন কৃষক ও ভূমিহীনদের নিয়ে আন্দোলনের পরবর্তী রূপরেখার কথা। জানাবেন, তিনি পূর্ণিয়ায় গিয়ে কাজ করতে চান। তৈরি করতে চান সশস্ত্র স্কোয়াড।
চারুবাবু মনে করতেন, নকশালবাড়ির আন্দোলন দমন করা হলেও তা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে। যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র অভিজিত্ প্রশ্ন করেছিলেন, মাত্র কয়েকশো উপজাতি ও তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত চাষির তির-ধনুক নিয়ে সরকারের অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াটা কি অ্যাডভেঞ্চার নয়? চারুবাবু বলেছিলেন, অস্ত্র নয়, বিদ্রোহের সময় মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব হত না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে চারুবাবু বলেছিলেন, এমনকী, আমেরিকার অত্যাধুনিক অস্ত্রও ভিয়েতনামের মানুষের প্রতিরোধ শক্তির কাছে হার মেনেছে।
বিপ্লবের পথ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, প্রশ্ন থাকতে পারে সে পথের প্রয়োগ নিয়েও। সিপিআই (এমএল) পলিটব্যুরোর সদস্য সুশীতল রায়চৌধুরীর সঙ্গে লেখকের শেষ সাক্ষাতের একটি বিবরণ আছে এই গ্রন্থের আলাদা একটি অধ্যায়ে। অভিজিত্ও তখন কিছুটা যেন দিশাহারা। পুলিশ, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, এমনকী, নিজের দলের সহকর্মীদের একাংশের রোষ থেকে পালিয়ে বাঁচা কোনও ‘কমরেড’ তাঁর দলের সর্বোচ্চ স্তরের এক নেতার কাছে তাঁর নানা ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। পরম ধৈর্যের সঙ্গে সে সব কথা শুনে যাচ্ছেন সুশীতল। এর কয়েক মাসের মধ্যেই ’৭১-এর ১৩ মার্চ সুশীতল মারা যান। বিপ্লবের পথ নিয়ে চারুবাবুর সঙ্গে তাঁর সংঘাতও ছিল। তা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেল সে সময়ে নকশালপন্থীদের একটা বড় ঘাঁটি। সেখানেই সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাতভর পুলিশি অভিযান ও তার বিরুদ্ধে হস্টেলের ছাত্রদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন অভিজিত্। জানাচ্ছেন, ২৪ পরগনার তত্কালীন জেলাশাসক রথীন সেনগুপ্ত কী ভাবে মাইকে ছাত্রদের উদ্দেশে বার বার ঘোষণা করছেন তাঁরা যেন হস্টেল থেকে বেরিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ছাত্রেরা ততক্ষণে হস্টেলকে কার্যত বাঙ্কারে পরিণত করছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা ’৭০-’৭১-এর নকশাল আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন এ গ্রন্থের শেষে তাঁদের একটি তালিকাও আছে।
নানা টুকরো ছবি... জেলখানায় হত্যালীলা... যাদবপুর থানায় বন্দিদের উপরে পুলিশি অত্যাচার চলার সময় তাঁদের আর্তনাদে পড়শিদের রাত জাগা... নানা চরিত্রের আনাগোনা... তাদের বয়ানে এ গ্রন্থের এক একটি অধ্যায়ে বিচরণ করাটা এক চমত্কার অভিজ্ঞতা।
সত্তরের সেই চালচিত্রে চমত্কার তুলি বুলিয়েছেন অভিজিত্। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে স্মৃতির ধূলিধূসরিত তোরঙ্গ থেকে যেন বার করে এনেছেন ডায়েরির হলদেটে পাতা।
হলদেটে হোক, ইতিহাস তো!