পুস্তক পরিচয় ১

বিষণ্ণ, একাকী এক কণ্ঠস্বর

যতই নিন্দে করি, নোবেল পুরস্কার কমিটি মাঝে মাঝে চমকে দিতে পারে। পুরস্কার ঘোষণার দিন সকালে প্যারিসে বিশিষ্ট ফরাসি সাহিত্যবোদ্ধা ও ঔপন্যাসিক মার্ক লাব্রঁ-র সঙ্গে কথা হচ্ছিল, পুরস্কারদাতারা কেন নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার না করে সাহিত্যগুণকে আলাদা করে সম্মানিত করতে পারে না। একটু পরে রেডিয়ো-ফ্রান্স মার্ককে জানাল যে এ বার পুরস্কার পেয়েছেন পাত্রিক মদিয়ানো!

Advertisement

চিন্ময় গুহ

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share:

যতই নিন্দে করি, নোবেল পুরস্কার কমিটি মাঝে মাঝে চমকে দিতে পারে। পুরস্কার ঘোষণার দিন সকালে প্যারিসে বিশিষ্ট ফরাসি সাহিত্যবোদ্ধা ও ঔপন্যাসিক মার্ক লাব্রঁ-র সঙ্গে কথা হচ্ছিল, পুরস্কারদাতারা কেন নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার না করে সাহিত্যগুণকে আলাদা করে সম্মানিত করতে পারে না। একটু পরে রেডিয়ো-ফ্রান্স মার্ককে জানাল যে এ বার পুরস্কার পেয়েছেন পাত্রিক মদিয়ানো!

Advertisement

মদিয়ানো কাম্যুর চেয়ে কিছুমাত্র কম নন, কিন্তু এই গোলোকায়িত পৃথিবীতে ফরাসি পাঠকের শ্রদ্ধাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট। ইংরেজি সাহিত্যবাজার— যা দালালদের হাতে চলে গেছে— তা নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। বিষণ্ণ, একাকী এই কণ্ঠস্বর যেন এক নির্জন কম্বুরেখা।

তাঁকে প্রেস কনফারেন্সের সময় বড় উদভ্রান্তও ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। বিশ্বাস হয়নি, তাই হাঁটছিলেন। কোথায় হাঁটছিলেন? রাস্তায়, না ঘরে? না নিভৃত স্মৃতিজালের মধ্যে? তাঁর রচনা তো ‘স্মৃতির শিল্প’ (l’art de la me´moire)। তিনি সমকালের প্রুস্ত, জানিয়েছে নোবেল কমিটি।

Advertisement

ঘামছেন, বললেন, কেন পুরস্কার পেয়েছেন জানেন না।

প্যারিসের বইয়ের দোকানদার থেকে প্রকাশক, সকলের মুখে একই কথা। উনি বেরোবেন কী করে? কথা বলবেন কী করে?

কিন্তু বেরোলেন। হাত কাঁপছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন আর এক প্যারিসবাসী স্যামুয়েল বেকেট-এর হয়েছিল এক দিন।

সুইডেন যাবেন? বিড়বিড় করে বললেন, যাবেন।

মদিয়ানো মানে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি, কথা, না-কথা। ফিসফিসানি। তাঁর উপন্যাসের নাম যাতে তুমি এ-পাড়ায় না হারিয়ে যাও, অন্ধকার দোকানের পথ, বিষণ্ণ ভিলা, রাত্রির ঘাস, দিগন্ত, অচেনারা। শেষ না হওয়া ঘটনা, নামহীন মানুষ, ভেঙে যাওয়া হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়ানো। নিঃশব্দ, শব্দ সেখানে পা টিপে টিপে হাঁটে। যেন জেরার দ্য নেরভাল-এর রচনা পড়ছি। অশরীরীরা ঘোরে, টেবিলের ওপর, বাথরুমে, রাস্তায়। ছায়াকে তুমি বলে সম্বোধন করেন। স্মৃতির পাতালজলে দাঁড়িয়ে মানুষের রহস্যমেদুর ভবিতব্যকে বুঝতে চান।

আমাদের বিরাট বিস্মৃতি, আমাদের ছোট ছোট আশা। কোনও মঞ্চে মদিয়ানোকে দেখা যায়নি। কোনও স্বীকৃতি তাঁর অভিপ্রায় নয়। তাঁর শুধু প্রয়োজন পাঠকের ‘ডিসক্রিট অ্যাডিকশন’।

গভীর, কিন্তু হালকা। যেন একটি ডানা-ভাঙা পাখির বুকের ধুকপুকুনিকে হাত দিয়ে অনুভব করছি। অতীতচারী দুঃখবিলাস নয়, এই লিখনের পিছনে কাজ করছে সুশিক্ষিত ফরাসি মনের অপূর্ব নিয়ন্ত্রণ। সুইডিশ অ্যাকাডেমি যে মার্সেল প্রুস্তের কথা বলেছে, তা অসত্য নয়। ষোলো বছর বয়সে পড়তে শুরু করে প্রুস্তের হারিয়ে যাওয়া সময়ের সন্ধানে নামক মহা-উপন্যাস কুড়ি বছর বয়সে শেষ করেন মদিয়ানো। কিন্তু তাঁর স্মৃতি অন্য রকম স্মৃতি।

মদিয়ানোর জন্ম ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে প্যারিসের পশ্চিমপ্রান্তে বুলন-বিয়াঁকুরে। মা ফ্লেমিশভাষী বেলজিয়ান অভিনেত্রী। বাবা ইতালীয়। ফ্রান্সে নাতসি অবস্থানের সময় তাঁদের দেখা হয়েছিল। মা পাত্রিককে দেখেননি। আত্মকথা য়্যঁ পেদিগ্রে-তে মদিয়ানো লিখেছেন, তাঁর মাকে একটি কুকুরছানা উপহার দিয়েছিলেন তাঁর প্রেমিক। মা সেটিকে দেখেননি, সে জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মা পাত্রিককেও দেখেননি। কোথায় যেন হারিয়ে যান। আর বাবা? পাত্রিক আবিষ্কার করেন, ফ্রান্সে নাতসি অবস্থানের সময় তাঁর বাবা ছিলেন ‘কোলাবো’, অর্থাত্‌ কোলাবোরেটর।

ফরাসি দেশে কোনও বড় শিল্পী-সাহিত্যিক ‘কোলাবো’ হবেন না, এমনই আশা করা হয়। সরকারের দালাল শিল্পী হবেন কী করে? কিংবা শিল্পী কী করে দালাল হবে? যে নগণ্য লেখকরা নাতসি অবস্থানের সময় ‘কোলাবো’ হয়েছিলেন (যেমন দ্রিয় লা রশেল ও সেলিন) তাঁদের জন্তুছাপ আজও ঘোচেনি।

মদিয়ানোর অতীত এক সামগ্রিক সমাজেতিহাসের অতীত। অতীত যা আঠার মতো সারা শরীরে, স্নায়ুর নীচে, হাড়ের কোটরে, পায়ুদ্বারে লুকিয়ে রয়েছে, যাকে ছাড়ালেও ছাড়ে না।

মদিয়ানো যেন এক গোয়েন্দা, যিনি বিস্মৃতির আয়নার ঘরে একটি মোমবাতি নিয়ে খোঁজেন। কী খোঁজেন? নিজেকে, ইতিহাসকে, মানুষকে? কথাকে, যা নতুন করে জেগে উঠবে আবার না-কথার হারানো সুতো ধরে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (যা জন্ম দিয়েছিল কাম্যু আর সার্ত্র-এর) এক বছর পর মদিয়ানোর জন্ম, অথচ তাঁর সারা গায়ে ক্ষতচিহ্ন। কোথাও কোনও জ্ঞানদান করেন না। সাধারণ পাঠক থেকে বিশেষজ্ঞ সকলকে এক ছায়া, আলো, শূন্যতার বলয়ে ডেকে নেন তিনি।

অন্ধকার দোকানের রাস্তা উপন্যাসে গি রলাঁ নামে এক গোয়েন্দার কথা আছে, যে বুঝেছে তার পরিচয় ভুল। সে অতীতে গিয়ে তার আসল পরিচয় খোঁজে। এই বইয়ের জন্য ১৯৭৮ সালে গঁকুুর পুরস্কার পাবেন তিনি। ডোরা ব্রুডার (১৯৯৭) উপন্যাসে পনেরো বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া একটি ইহুদি মেয়েকে কয়েক দশক পেরিয়ে খুঁজতে চান লেখক। হারানো যৌবনের কাফে-তে লুকি নামে একটি মেয়ে প্যারিসের ওদেয়ঁ-র কাছে হারিয়ে যায়। যারা তাকে দেখেছিল, এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ, এক ছাত্র, এক ঔপন্যাসিক, এবং মেয়েটির স্বামী, তাদের কথামুখ থেকে মেয়েটির ছেঁড়াখোঁড়া অতীতকে ধরতে চান মদিয়ানো। বসন্তের কুকুর উপন্যাসে ১৯৬৮ সালে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া এক ফোটোগ্রাফারের ছবিগুলি ১৯৯২ সালে হঠাত্‌ প্রাণ পেয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাতসি অবস্থানকালীন বিপন্নতা তাঁর রচনার ফাঁকফোকর, গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে, বারবার ঢুকে পড়ে।

আমরা যারা বিশ্বায়নের দমবন্ধ করা বুকজলে ডুবে আছি, মদিয়ানোর অনুসন্ধান আত্ম-অবলোকনের একটা দিশা দেখাতে পারে আমাদের।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement