ভারতবর্ষের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহু বিতর্কিত অধ্যায়। এই শতকের প্রথম দিকেই মোগল সাম্রাজ্যের বিশাল মহীরুহ প্রায় ধরাশায়ী, আর সেই সুযোগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীন কয়েকটি রাজ্যের উত্থান। আবার এই শতকেরই মাঝামাঝি, পলাশির পরে, ইংরেজরা বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। একটি শতকে এত সব ঘটনাক্রম বিরল। তাই এই শতক নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ইরফান হাবিব, আতহার আলি, সতীশচন্দ্র প্রমুখের কাছে অষ্টাদশ শতক অবক্ষয়ের প্রতীক। তাঁরা বার বার এই শতককে চিহ্নিত করেছেন ‘অন্ধকারের যুগ’ হিসেবে— চারদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনীতিতে অচলাবস্থা, শিল্প-সংস্কৃতির অবক্ষয়। অন্য দিকে, পিটার মার্শাল, ক্রিস বেলি, মুজাফফর আলম, বার্টন স্টাইন, ফ্র্যাঙ্ক পারলিন, আন্দ্রে ভিঙ্ক প্রমুখের বক্তব্য, কোনও কোনও অঞ্চলে অবনতি দেখা গেলেও, অনেক জায়গায় কিন্তু বেশ অগ্রগতি হয়েছিল। এই বিতর্ক যে এখনও সজীব, তার প্রমাণ বর্তমান শতকের শুরুতেই সীমা আলাভি, পিটার মার্শাল ও রিচার্ড বার্নেটের সম্পাদনায় পরপর তিনটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
ইকনমি ইন এইটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল,
তিলোত্তমা মুখার্জি।
ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ৮২৫.০০
এ সব বাকবিতণ্ডার মধ্যে বর্তমান প্রজন্মের কাউকে সহজে বিষয়টিতে ঢুকতে দেখা যায় না। তাই আলোচ্য গ্রন্থ নিয়ে তিলোত্তমার প্রবেশ অভিনন্দনযোগ্য— ইতিহাস গবেষণায় একটি সাহসী পদক্ষেপ। তিনি অবশ্য মূলত অষ্টাদশ শতকের বাংলাতেই দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেছেন, যদিও প্রসঙ্গত মাঝে মাঝে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের কথাও কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ভূমিকা ও উপসংহার ছাড়া সাতটি সুবিন্যস্ত ও সুচিন্তিত অধ্যায়ে তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ ভাবে অষ্টাদশ শতকে যে অবক্ষয়ের কথা বলা হয়, তিনি তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পথের দিশারী। অবক্ষয়ের কথা পুরোপুরি অস্বীকার না করেও তিনি বলছেন, এক দিকে বাংলার যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা, আর অন্য দিকে বাজার-হাটের সুসংগঠিত অবস্থা ছিল বলে অবক্ষয় অনেকটাই প্রতিহত হয়। তাই দেখাতে গিয়ে তিনি বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাজার-হাটের সংগঠন বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। সঙ্গে আছে শহরাঞ্চলে শাসকগোষ্ঠী, অভিজাত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির ভোগবিলাসের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চাহিদা বর্ণনা এবং তার ফলে আর্থিক উন্নয়নের কাহিনি। তা ছাড়া আছে কী ভাবে তীর্থযাত্রা ও আনুষঙ্গিক ভ্রমণ অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। বাংলার নবাবরা সুনির্দিষ্ট পথে কী ভাবে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিকে উন্নত করায় প্রয়াসী হয়েছিলেন, তার আখ্যানও আছে। পরিশেষে কোম্পানি শাসনের প্রথম পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতিতে কতটা সচেষ্ট ছিল তার আলোচনা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কোম্পানি কী ভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা ও পরিবেশ সংরক্ষণে কী কী চেষ্টা করেছিল, তার বিবরণ।
লেখকের বক্তব্য নিয়ে অবধারিত ভাবেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন— বাংলার ইতিহাসে অষ্টাদশ শতকের পুরোটা একই ক্যানভাসে একক এবং অখণ্ড পরিসরে আলোচনা করাটা কতটা সমীচীন (তিনি এখানে যা করেছেন)। ওই শতকে বাংলার ইতিহাসে দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা পরিচ্ছেদ। নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ থেকে ওম প্রকাশ, বর্তমান লেখক পর্যন্ত অনেকের গবেষণাতেই শতকের প্রথমার্ধে বাংলার শ্রীবৃদ্ধি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। ঠিক তেমনই সুবিদিত ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার অবক্ষয়ের কাহিনি। এখানে বিশেষ ভাবে স্মর্তব্য— এ বক্তব্য শুধু এখনকার ঐতিহাসিকদের নয়, তদানীন্তন বাংলায় অবস্থিত কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস, হ্যারি ভেরেলস্ট, লিউক স্ক্র্যাফটন প্রমুখেরও। এঁরা স্পষ্ট ভাবে এবং নির্দ্বিধায় লিখে গেছেন যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ছিল খুবই সমৃদ্ধ, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে, কোম্পানির আমলে, বাংলার দুর্দশার শুরু। এ প্রসঙ্গে উঠে আসে কোম্পানির রাজত্বে বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয়ের কথা। বাংলার তাঁতি ও অন্য কারিগরদের ওপর কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের অমানুষিক অত্যাচারের কথা এক অজ্ঞাতনামা (আসলে, হ্যারি ভেরেলস্ট, ১৭৬০-এর দশকে বাংলার গভর্নর) ইংরেজ লেখকের পাণ্ডুলিপিতে বিশদ ভাবে বলা আছে। তিনি একেবারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, কোম্পানির শাসনে বাংলার তাঁতিরা ক্রীতদাসে পরিণত হয়। তাদের অবস্থা ক্রীতদাসেরও অধম। এই অত্যাচার যে বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
শিল্পী: বালথাজার সলভিনস
তিলোত্তমা অবশ্য এ সব তথ্যের (যেগুলি ‘রক-সলিড’ এভিডেন্স হিসেবে পরিগণিত) বিশেষ কোনও গুরুত্ব না দিয়ে সাম্প্রতিক কালের কিছু লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, বাংলায় সামগ্রিক ভাবে কোনও অবক্ষয় হয়নি। দেখা যাক তাঁর লেখকরা কী বলছেন। এঁদের মধ্যে এক জনের বক্তব্য, বাংলার বস্ত্রশিল্পের দুর্গতির অন্যতম কারণ বাংলা থেকে বিদেশে কাপড় রফতানি হ্রাস পাওয়া। তার জন্য যে ইংরেজরাই দায়ী, সেটা কিন্তু তাঁর অজ্ঞাত। বস্তুত শুধু ইংল্যান্ডে নয়, ইউরোপের সর্বত্র বস্ত্র রফতানি অনেকটাই কমে যাওয়ার প্রকৃত কারণ বাংলার কাপড় রফতানির ওপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অত্যধিক শুল্ক চাপিয়ে দেওয়া। উক্ত লেখকদের দু-এক জন অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, বাংলায় বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয়ের ফলে অন্তত ৬০ লক্ষ লোক কর্মহীন হয়ে পড়ে। সেটা কি বাংলার অগ্রগতির লক্ষণ? উক্ত লেখকদের মধ্যে আবার কয়েকজন তাত্ত্বিক আলোচনার মোড়কে অমোঘ তথ্যগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যাতে তাঁদের বিব্রত হতে না হয়।
বছর পাঁচেক আগে ইকনমিক হিস্ট্রি রিভিউ-তে এক উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধে ইন্দ্রজিৎ রায় বিশেষ ভাবে দেখিয়েছেন যে, বাংলার বস্ত্রশিল্পে অবক্ষয়ের জন্য ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শুল্কনীতি যেমন দায়ী, তেমনই দায়ী তাঁতি-কারিগরদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার। তিনিও বলেছেন যে, বস্ত্রশিল্পে দুর্দশার জন্য বাংলায় কম করে ৬০ লক্ষ লোক কর্মচ্যুত হয়। তিলোত্তমা এ সম্বন্ধে কিন্তু নিরুত্তর। তাঁর বক্তব্য, বাংলায় বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয় প্রশ্নাতীত নয় কারণ বাংলায় কাপড়ের যে বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার (কোলব্রুকের মতে ১৭৯০-এর দশকে ৬ কোটি টাকা মূল্যের) ছাড়াও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি, আর্মানি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, ভারত ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বাংলা থেকে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিপুল পরিমাণ কাপড় রফতানির ফলে কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায় এবং তাতে বস্ত্রশিল্পের উন্নতিই হয়েছিল। কিন্তু তিনি যদি একটু ভাল করে অনুধাবন করতেন, তা হলে জানতে পারতেন সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইংরেজ কোম্পানি বাংলায় ক্ষমতা দখলের পরে পরিকল্পিত ভাবে আস্তে আস্তে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয়দের, আর্মানিদের এবং এশীয়-ভারতীয় বড় বড় ব্যবসায়ীদের বাংলার বাজার থেকে একেবারে হটিয়ে দেয়।
তা ছাড়া, লেখক বাংলায় কাপড়ের যে বিশাল বাজারের কথা বলেছেন, তা কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে অনেক সংকুচিত হয়ে যায়। তাঁর হয়তো খেয়াল নেই, ১৭৭০-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে বাংলার লোকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়। তাই কোলব্রুকের সময় শতকের শেষ দিকে বাংলার লোকসংখ্যা অনেক কমে যায়, আর স্বাভাবিক ভাবেই কাপড়ের অভ্যন্তরীণ বাজার/ চাহিদাও সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাই অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে কাপড়ের সুবিশাল বাজারের প্রশ্নই ওঠে না। এগুলি ছাড়াও অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা থেকে যে বিপুল ধননিষ্ক্রমণ হয়েছিল, সে সম্বন্ধে লেখক কেন নীরব সে কথাও উঠে আসে।
এহ বাহ্য। এ সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলতে বাধা নেই যে, আলোচ্য গ্রন্থটি অষ্টাদশ শতকের বাংলার ইতিহাস চর্চায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তথ্যঋদ্ধ এই গ্রন্থে লেখক প্রদর্শিত পথ ছেড়ে নতুন পথের সন্ধান করেছেন, সে প্রচেষ্টা স্বাগত। গ্রন্থটি কেবল ইতিহাস ও অর্থনীতির ছাত্র, গবেষক, শিক্ষকদের কাছে নয়, সাধারণ পাঠকদের কাছেও সমাদৃত হবে বলে আশা। পাঠক বইটির বৃহৎ কলেবর দেখে ঘাবড়াবেন না ৪২৬ পৃষ্ঠার মধ্যে গ্রন্থপঞ্জির তালিকা ও নির্দেশিকা মিলে ৮৫ পৃষ্ঠা, আর প্রত্যেক অধ্যায় শেষের টীকা মিলে ৬০ পৃষ্ঠা পাঠকের ভার অনেকটা লাঘব করবে।