প্রবন্ধ সংগ্রহ ৩ ও ৪, সুকুমারী ভট্টাচার্য। গাঙচিল, প্রতি খণ্ড ৬৫০.০০
ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘...অন্ধত্ব আরও অনেক গভীর,... এর মধ্যে ভ্রান্তি বোধ নেই, আছে আত্মপ্রতারণা’। আমাদের যেন একটু ধন্দ জাগে, কথাগুলো বুঝি নব্য-মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কেই বলছেন। নইলে আজ এতকাল পরেও তাঁকে ‘বৈদিক সাহিত্যের রূপরেখা’ আঁকতে হয় কেন, ‘নিয়তিবাদের স্বরূপ’ নতুন করে চিনিয়ে দিতে হয় কেন, আর কেনই বা বাল্মীকির রাম নিয়ে ‘পুনরাবলোকন’? তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহের তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডের সমীক্ষণে বারবার মনে হয়, সমসময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক স্খলন আর পতন তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছে, আমাদের পরিশীলিত ভণ্ডামি দেখতে দেখতে জারিত হয়েছে তাঁর বিশুদ্ধ, পরম ক্রোধ। তা থেকে তাঁর অসামান্য মনীষার গর্ভে জন্ম নিয়েছে এক মানবতাবাদী, যুক্তিনিষ্ঠ, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। এমনই তার অভিঘাত যে এই একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা এক সুপ্রাচীন সমাজ সংস্কৃতির সাবলীল, নিপুণ ব্যবচ্ছেদ দেখতে বাধ্য হই, আর ভাবতেও বাধ্য হই যে আমরা আধুনিক হলাম কীসে?
বেদের আধ্যাত্মিক মহিমার ছলনা তো সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতেই খণ্ডিত হয়েছে। ১৮৭৭ সালেই ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন, ‘বেদের নাম শুনিলেই আমাদের... সকলের মনে ভয়ভক্তি সমন্বিত প্রকাণ্ড ভাবের উদয় হয়।... ‘বেদের বচন’ বলিলেই আর তাহার উপর দ্বিরুক্তি নাই।... উহা দুর্বোধ্য, দুষ্পাঠ্য, দুষ্প্রবেশ্য... কিন্তু বাস্তবিক বেদ কী জিনিস?... ভিন্ন ভিন্ন কালের... ভিন্ন ভিন্ন মহাকবিপ্রণীত কতকগুলি কবিতা ও গান আদি সংগ্রহ মাত্র... পৃথিবীর প্রাচীনতম কাব্য।’ মহাপণ্ডিত হরপ্রসাদও বুঝেছিলেন যে এই কাব্য কালক্রমে কী ভাবে শুদ্ধতার, পবিত্রতার পৈতে পরে একটা ধর্মগ্রন্থে পরিণত হল তার ব্যাখ্যা করা দরকার। কারণ, দয়ানন্দ সরস্বতী তখন আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়ে বলছেন, ‘বৈদিককালে জাতিভেদ ছিল না, স্ত্রী-স্বাধীনতা ছিল’ এবং ‘বেদ একেশ্বরবাদী’।
এমন অন্তঃসারশূন্য ধারণাগুলো নস্যাৎ করা-ই আধুনিকতা। হরপ্রসাদ সেই পথ খনন শুরু করেছিলেন। তাকে সর্বাঙ্গসুন্দর, সার্থক করে দিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। ঋগ্বেদ থেকে বেদাঙ্গ সূত্র পর্যন্ত প্রায় দেড় থেকে দু’হাজার বছরের সমাজ-সংস্কৃতির অনুপুঙ্খ তত্ত্বতালাশ করে, প্রাঞ্জল বিশ্লেষণ আর তীক্ষ্ন যুক্তি দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন, বৈদিক সমাজের শাশ্বত মধুরিমা একটি কল্পকথা মাত্র, বিশেষত বর্ণহিন্দুদেরই সযত্নলালিত। তাঁর বিশ্লেষণ আমাদের মতো অদীক্ষিত পাঠকের কাছে হয়তো দুরূহ, কিন্তু দুর্জ্ঞেয় না। বরং এখানেই আমরা পেয়ে যাই রৌদ্রছায়ার আনন্দ। পাণ্ডিত্যের সম্ভ্রম আর দূরত্ব ঘুচিয়ে খুব কম বিদুষীই এমন করে, স্বতঃস্ফূর্ত স্নিগ্ধতায় আমাদের কাছে টেনে রাখতে পারেন।
এক দিকে তিনি জটিল তত্ত্ব আর তথ্য নিয়ে অনুসন্ধিৎসা রচনা করেন, আবার অন্য দিকে সহজ, সাবলীল ভাষায় উপহার দেন ‘গৌতম বুদ্ধ’, ‘আচরণের যুক্তিবাদ’, আর ‘অনন্যা দ্রৌপদী’র মতো প্রবন্ধ। নিষ্প্রশ্ন পাঠকের মনেও তিনি কৌতূহল জাগিয়ে তোলেন, অথচ কোথাও কোথাও নিজের সংশয়ও গোপন করেন না। তীর্থস্থানের গরিমার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘নিশ্চিতভাবে বলা যায় না তীর্থই কাহিনিগুলি সৃষ্টি করে, না কাহিনি তীর্থস্থানটিকে’। তিনি তথ্যের প্রতি সন্নত, অথচ তথ্য তাঁকে শাসন করে না; তিনিই দেখিয়ে দেন, তথ্য নিরালম্ব বায়ুভূত না। তাই স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন, ‘প্রাচীনকালে নিয়তিবাদ সম্পর্কে কোনও ঐকমত্য ছিল না। ধীরে ধীরে... সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেই নিয়তিবাদকে স্বীকার করে নিল’। যে মনুসংহিতা নিয়ে উচ্চবর্ণের এত ভাবালুতা, তা যে ‘সমাজে নারীর অবনমনের একটি দলিল’ সে কথা তিনি স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারেন।
কথা বলছেন প্রাচীন সমাজ নিয়ে, অথচ তাতেই প্রচ্ছন্ন থাকছে আধুনিক সমাজের প্রতিরূপ। প্রাগার্য জনমানুষের প্রতি আর্যজাতির একটি অংশের তুমুল তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা, তাদের জল জঙ্গল আর মাটির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে প্রান্তবাসী, ‘নামহীন জনতা’য় পরিণত করা এবং এই সব কিছুর পিছনে কুযুক্তি রচনা করা তো আজও চলে আসছে; শুধু প্রকার-প্রকরণের তফাত। ‘...আদিম অধিবাসীরা যদিও কোনও অপরাধই করেনি... তবু তারাই পাপ ও অমঙ্গলের প্রতীক বর্বর জাতিরূপে অকারণে নিন্দিত’। ব্রিটিশ রাজদণ্ড থেকে আধুনিক শ্রেষ্ঠীতন্ত্র, কোথাও তো এই লুণ্ঠনের আজও কোনও বিরাম নেই। গত সাতষট্টি বছরে এ ভাবেই তো অন্তত ছয় কোটি আদিবাসীকে উৎখাত করা হয়েছে। এমনকী, এই উচ্ছেদ অবৈধ হলেও শ্রেষ্ঠী নিরাপদ থেকে যায়, কেননা নিগূঢ় অর্থে তারা তো ব্রাহ্মণ। ‘...শ্রেণিগতভাবে ব্রাহ্মণ পার্থিব রাজার ক্ষমতার সীমার বাইরে রইল, তাদের ওপর রাজার প্রত্যক্ষ আধিপত্য অস্বীকার করা হল’। একই সঙ্গে থাকে বিরোধাভাস,— ‘... কলিতে শূদ্র নিজের হীনত্ব মেনে নেবে না, সে যে শুধু উচ্চবর্ণের বৃত্তি অবলম্বন করবে তাই নয়, উচ্চবর্ণ সম্বন্ধে শ্রদ্ধাপোষণও করবে না’।
তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে থাকে এক অকপট মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি দেখান, সমাজের টানাপড়েনগুলো নিতান্ত মানবীয়, তূরীয় আধ্যাত্মিকতার ভূমিকা সেখানে নেই। তাই ‘বীরধর্মচ্যুত’ (বালীবধ, শম্বুকবধ), বর্ণবৈষম্যের প্রতিভূ (গুহকের কাহিনি) এবং যুক্তিহীন ভাবে নিষ্ঠুর (সীতার পরীক্ষা) রামচন্দ্র কোনও অর্থেই ‘অশেষবিদ্ধ গুণযুক্ত’ নন। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, যে রুগ্ণ গর্ববোধ দিয়ে সময়ে সময়ে জনমানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রামরাজ্যের স্বপ্ন চাগিয়ে তোলা হয়, তা কতটা দুঃস্বপ্নের ইঙ্গিত দেয়। তীক্ষ্ন তিরস্কারে তার আশঙ্কা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘নারী শূদ্রের ওপর অত্যাচার যে তন্ত্রে অপরিহার্যভাবে গৃহীত... আমরা কি সেই রাজতন্ত্রই চাই?’ দ্রৌপদী কেন অনন্যা, তা বলতে গিয়ে তাঁর বুক থেকে যেন বেরিয়ে আসে কান্না,— ‘একনিষ্ঠ প্রেমের আসনে যে নিরন্তর যন্ত্রণা সেইটি দ্রৌপদীকে অনন্য এক বিরহিণীর মাহাত্ম্যে ভূষিত করেছিল, কেই বা তা জানত?’
যে মানবীয় বীক্ষায় তিনি পরলোক, মোক্ষ বা নিয়তি নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন, সেই অমোঘ বীক্ষাই ধরা পড়ে ‘রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ’তে, তাঁর মৃত্যুভাবনার উত্তরণে,— ‘... মৃত্যু অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি নয়, বরং অর্থপূর্ণ অবসান। অন্যথায় সমগ্র সৃষ্টি সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়’। সেই বীক্ষা নিয়েই তিনি আমাদের দেখিয়ে দেন কী ভাবে ‘কবি নিজে বৈষ্ণব ও ঔপনিষদিক মতগুলিকে মানবতাবাদী দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন’। দেখিয়ে দেন, চিন্তার বিবর্তন কী ভাবে ঘটে, কী ভাবে কবির বিশ্বাস ন্যস্ত হয় মানুষের ‘নির্ভীক, প্রাণবন্ত সত্তায়’।
তবে যে-কথা না বললে চলে না,— এই সমীক্ষণ শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানের, বিশেষত চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে। তাই ক্ষণে ক্ষণে চোখ চলে গেছে অথর্ববেদের আলোচনায়। কিন্তু মন ভরেনি। ঋগ্বেদের ভাববৃত্তের তুলনায় অভিনব হয়েও বৈদিক সাহিত্যে অথর্ববেদের কেন এত অপযশ, তা স্পষ্ট হয়নি। অথর্ববেদের ‘সূক্তগুলি প্রধানত গার্হস্থ্য অনুষ্ঠান, নারী, রাজা, সৈন্য, রুগ্ণ ব্যক্তি, কৃষিজীবী এবং গৃহস্বামীর প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত’। তা হলে সে তো যজ্ঞ নামক ‘সছিদ্র নৌকো’র বদলে বরং দৈনন্দিনতা, স্বাভাবিক নিত্যতার কথাই বলে। অথচ তার কপালে অমন অগৌরব কেন? এমনই অগৌরব যে ‘চিকিৎসকদের পক্ষে স্বর্গের দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছে’! ‘চরণবৈদ্য বা ভ্রমমাণ চিকিৎসক’ যে কেন বৈদিক সমাজে সম্মানের আসন থেকে বঞ্চিত থাকলেন, তাও তেমন স্পষ্ট হল না।
তা ছাড়া, তাঁর সমস্ত রচনায় যে নিয়তিবাদ আর তিমিরবিলাসের বিপরীতে মানুষের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র প্রতি ব্যাকুলতা ধরা পড়ে, তা জৈবিক যুক্তিতে কতখানি গ্রাহ্য হবে, তা নিয়েও তো সংশয়। কারণ, আধুনিক জীববিজ্ঞানের নতুন নতুন ধারণাগুলো তো এক হিসেবে জৈবিক নিয়তির কথাও বলে। তাই শোপেনহাওয়ার বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন, ‘মানুষ যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে, কিন্তু সে যা খুশি তাই ইচ্ছে করতে পারে না’। তবে যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সদর দরজাটি তিনি খুলে দিলেন, একদিন সেখান দিয়েই হয়তো আসবে নতুন, মুক্তচিন্তার অনাবিল স্রোত।
আরও একটি কথা। এই খণ্ড দু’টির বিষয়সূচিতে কালানুক্রম থাকলে ভাল হত। এই ধরনের সংকলন নিশ্চয়ই বাহবার দাবি রাখে, তবে মুদ্রণ প্রমাদ কম থাকলে বাহবাটিও অকুণ্ঠ হতে পারত।
আমাদের সারস্বতজগতে শাস্ত্র নিষ্ণাত, সম্ভ্রান্ত পাণ্ডিত্যের অকুলান নেই, কিন্তু পা দু’টি মাটিতে রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো জ্ঞানপীঠ দ্বীপ তো বড় একটা নজরে পড়বে না। সুকুমারী সেই বিরল জ্ঞানপীঠের অনায়াস অধিবাসী,— তর্কপ্রিয়, আধুনিক গার্গী হয়ে আমাদের ঋদ্ধ করে যান।