কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে ১৮১৪-য় যে সংগ্রহের সূত্রপাত, পরে তা পরিণতি পায় ভারতীয় সংগ্রহালয়ে। ১৮৮২-’৮৩ সালে জন অ্যান্ডারসনের ক্যাটালগ প্রণয়ন পর্যন্ত এই সংগ্রহে অবিভক্ত বাংলার ভাস্কর্যের অবস্থান ছিল অকিঞ্চিত্কর। ১৮৯২-এ পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিহার থেকে ‘ব্রডলি সংগ্রহ’ নিয়ে আসার পর পাল-সেন ভাস্কর্যের সম্ভার সমৃদ্ধ হয়। বিশ শতকের সূচনায় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি চাইল আত্মগৌরব প্রতিষ্ঠার উপকরণ সংগ্রহ করতে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় গড়ে উঠল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষত্ সংগ্রহশালা। একই উদ্যোগ দেখা গেল শরত্কুমার রায়ের আনুকূল্যে রাজশাহির বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতিতে, কিংবা ঢাকা সংগ্রহশালায়। এই উদ্যোগের শেষ উদাহরণ বোধহয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালা। সেই ধারাবাহিকতায় রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালা নবীনতম প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস, যেখানে নির্দিষ্ট ভাবে এই রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান-উত্খননে পাওয়া প্রত্নসম্ভার সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত।
যে কোনও সংগ্রহশালাতেই সম্পূর্ণ সংগ্রহের খুব কম অংশ আগ্রহী মানুষ দেখতে পান। গবেষকদের আরও সমস্যা, কারণ সংগ্রহ সংক্রান্ত পুরনো নথিপত্র দেখতে পাওয়া কঠিন। সে জন্য যত বেশি সম্ভব সুমুদ্রিত ছবি সহ ক্যাটালগের জন্য অনুসন্ধিত্সুরা মুখিয়ে থাকেন, একমাত্র তাতেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো সম্ভব। অথচ ভাল মানের ক্যাটালগের সংখ্যা এখানে এখনও নগণ্য। ভারতীয় সংগ্রহশালার পাল-সেন পর্বের ভাস্কর্যের কোনও ক্যাটালগ নেই, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শেষ ক্যাটালগ হয়েছিল ১৯২২-এ, ঢাকার বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ১৯২৯-এ, আর আশুতোষ সংগ্রহশালার ভাস্কর্যের আজও কোনও ক্যাটালগই হয়নি। একমাত্র বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ভাস্কর্যের পূর্ণাঙ্গ ক্যাটালগ প্রকাশ করেছে। এই অবস্থায় রাজ্য সংগ্রহশালার ভাস্কর্যের আনুপূর্বিক বিবরণ ও যাবতীয় নিদর্শনের ছবি সংবলিত ক্যাটালগটি বাংলার শিল্প-ইতিহাস চর্চায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
সম্প্রতি কোনও প্রত্নবিদ প্রশ্ন তুলেছেন, সংগৃহীত সব বস্তুর বিবরণ ক্যাটালগে থাকার কথা নয়, থাকবে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ নিদর্শনের কথা। কিন্তু ক্যাটালগ বলতেই তো পূর্ণাঙ্গ তালিকা বোঝায়, বাছাই করা নিদর্শনের বর্ণনা হলে তা আর ক্যাটালগ থাকে না, ‘হ্যান্ডবুক’ হয়ে দাঁড়ায়, অথবা শুধু প্রদর্শিত বস্তুর বিবরণ হলে ‘গাইড বুক’ও বলা হয়। ভারতের কয়েকটি বিখ্যাত সংগ্রহের প্রকাশিত ক্যাটালগের দিকে তাকালেই এর সত্যতা বোঝা যাবে। ফোগেল-এর মথুরা মিউজিয়ম ক্যাটালগ (১৯১০), দয়ারাম সাহনি-র সারনাথ মিউজিয়ম ক্যাটালগ (১৯১৪), এমনকী রাধাগোবিন্দ বসাক ও দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সংকলিত বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহের শীর্ণকায় ক্যাটালগেও (১৯১৯) ভাঙাচোরা টুকরো সমেত যাবতীয় ভাস্কর্যের বিবরণ আছে। মুখলেসুর রহমান-কৃত বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়মের ভাস্কর্যের নতুন ক্যাটালগেও (১৯৯৮) এই ধারারই অনুবর্তন। হারগ্রিভস পেশোয়ার মিউজিয়ম (১৯৩০) এবং ননীগোপাল মজুমদার ভারতীয় সংগ্রহশালার (১৯৩৭) প্রদর্শিত ভাস্কর্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাই তাঁদের বই দুটি ‘হ্যান্ডবুক’ ও ‘গাইড’ নামাঙ্কিত। আলোচ্য বইটি যে পথভ্রষ্ট হয়নি, সেটাই সৌভাগ্য।
তবে নিছক চেনা পথে হাঁটেননি দুই লেখক, নতুন পথের দিশাও দিয়েছেন। বাংলার ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে, বিভিন্ন সংগ্রহে রক্ষিত হাজার হাজার মূর্তি ঠিক কী পাথরে তৈরি, এত পাথর এলই বা কোথা থেকে? এই খোঁজটা গৌতম সেনগুপ্ত আগেই শুরু করেছিলেন শম্ভু চক্রবর্তীর সঙ্গে। এখানে শম্ভুবাবুর সঙ্গে মৈত্রী রায়মৌলিক ও তরুণ কোলে দেখিয়েছেন, সংগ্রহের কোন মূর্তি কোন পাথরে তৈরি, আর তার সম্ভাব্য উত্সভূমি। এই প্রথম এমন প্রয়াস দেখা গেল। অন্যান্য সংগ্রহের পাথর বিশ্লেষিত হলে ভবিষ্যতে কখনও সামগ্রিক চিত্র স্পষ্ট হবে।
ষষ্ঠ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার প্রস্তরভাস্কর্যের প্রায় সাড়ে চারশো নিদর্শন (মূর্তি ও স্থাপত্যের অংশ সহ) এই ক্যাটালগে আলোচিত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য মূর্তির সংখ্যাই বেশি, তার মধ্যে বিষ্ণু সর্বাধিক (১৭১)। ১৮টি বৌদ্ধ ও ২৯টি জৈন মূর্তিও রয়েছে। পরিশিষ্টে মূর্তিতে খোদিত ২৪টি লেখ নিয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন রজত সান্যাল, বিখ্যাত মহীসন্তোষ সূর্যমূর্তিতে তিনি একটি নতুন লেখ-এর সন্ধানও পেয়েছেন। সংগ্রহশালার নিদর্শনের প্রাপ্তিস্থান নির্ণয় সব সময়েই জটিল সমস্যা, ১০৪টি প্রাপ্তিস্থান নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এই বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ থেকে বেশ কিছু সম্ভাব্য প্রত্নস্থলেরও ইঙ্গিত মেলে। শেষে আছে দাতাদের তালিকা।
১৯৬২-তে স্থাপিত রাজ্য সংগ্রহশালার এই সমৃদ্ধ সংগ্রহ এত দিন অনালোকিত ছিল। নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করে চমত্কার ছবি সহ পরিচ্ছন্ন মুদ্রণে এই সংগ্রহকে বৃহত্তর অনুসন্ধানের উপকরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন দুই লেখক, এটাই আনন্দের।