অপ্রকাশিত শব্দটি বাংলা বইপাড়ার প্রকাশকদের পক্ষে পরম লোভনীয়। বাংলা সাহিত্যে পুরনো চালই এখনও ভাতে বাড়ছে, সুতরাং যদি অসিদ্ধ আনকোরা চাল নতুন করে পাওয়া যায় তবে তা লোভনীয় হবে বই কী! কিন্তু এই লোভের ঠেলায় সাধারণ পাঠকের বিষম দায়। বিখ্যাত কোনও লেখকের অপ্রকাশিত কিংবা অগ্রন্থিত বই কিনে অনেক সময়ই ঠকতে হয়। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে সব লেখা লেখকেরা জীবদ্দশায় অপ্রকাশযোগ্য বলে মনে করেন মৃত্যুর পরে সেগুলিই দ্বিগুণ গুরুত্বে প্রকাশ করেন প্রকাশকেরা।
একটা গুরুত্ব অবশ্য আছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব। লেখকের যথার্থ সমগ্র হয়ে উঠতে পারে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সব মিলেই। কিন্তু যখন জীবনানন্দ দাশের মতো এক জন কবির ১৯৩৮-এর পূর্ববর্তী অপ্রকাশিত কবিতা প্রকাশিত হয় এই ২০১৫-য়, তখন সে বড় সুখের সময়, বলতেই হয়।
অপ্রকাশিত, জীবনানন্দ দাশ।
সম্পাদনা: গৌতম মিত্র।
সপ্তর্ষি, ২০০.০০
আজ প্রকাশিত হচ্ছে যে অপ্রকাশিত, তার গুরুত্ব এইখানেই। ভূমিকায় সম্পাদক জানিয়েছেন, যে খাতা থেকে এই সংকলনের চল্লিশটি কবিতা সংকলিত হয়েছে তার শেষ কবিতাটি বাদে বাকি সব কবিতা খাতায় কপি করা হয়েছে ১৯৩৮-এ, বরিশালে। ৪০ সংখ্যক কবিতাটি অক্টোবর ১৯৩৮-এ কপি করা।
যদি তাই হয়, তা হলে এই কবিতাগুলি জীবনানন্দ দাশের কবিতাজীবনের সুবর্ণপর্বের ফসল। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক (১৯২৭), তার পরে ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), তার পরে ১৯৪২-এ বনলতা সেন। অর্থাত্ এই কাব্যগ্রন্থ এক অর্থে বনলতা সেন-এরও পূর্ববর্তী।
অবশ্য খুব সূক্ষ্ম অর্থে একে কাব্যগ্রন্থ বলা যাবে কি না তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র-তে (সম্পা: ক্ষেত্র গুপ্ত, ভারবি) জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত কবিতা-গ্রন্থগুলিকে অগ্রাহ্য করে তাদের সব কবিতাকেই অগ্রন্থিত বলা হয়েছিল। কারণ কবিতা-সংকলনের বিন্যাস ও গ্রন্থরূপ সম্পর্কেও কবির কিছু অভিপ্রায় থাকে। কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত কবিতা-সংকলনে তা থাকে না। তাই সেগুলিকে আর কবির কাব্যগ্রন্থ বলা যায় না, সে সব নিছক ওই কবির কবিতা-সংকলন। এই অপ্রকাশিত-ও তাই। এর নামকরণ জীবনানন্দ দাশের নয়। জীবনানন্দের বিভিন্ন খাতা থেকে ‘অপ্রকাশিত’ কয়েকটি কবিতার সংকলন এটি। ভূমিকায় সম্পাদক লিখছেন, ‘নিজের হাতে একটি কাব্যগ্রন্থের সূচিপত্র তৈরি করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। নামও ঠিক করেছিলেন। ‘শীত ও সবিতা’। কিন্তু কবিতাগুলি ছিল না খাতায়।’ এর পরে সম্পাদক সূচিপত্র ধরে কবিতাগুলি সংগ্রহ করেছেন তিল তিল করে। সেই তাঁর জীবনানন্দ সন্ধানের শুরু। দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণার সূত্রে জীবনানন্দ দাশের কবিকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সুবাদে সম্পাদক লিখছেন, ‘এক সহৃদয় মহিলা যে মঞ্জুশ্রী দাশের গচ্ছিত রাখা পাণ্ডুলিপির বাণ্ডিল রক্ষা করেছেন এবং তা অশোকানন্দ দাশের পুত্র অমিতানন্দ দাশকে যথাসময়ে ফিরিয়েও দিয়েছেন সেটি জানতাম। কিন্তু মহিলার পরিচয় জানা ছিল না।’ ক্রমে সেই পরিচয় খুঁজে বের করে সম্পাদক রত্না রায় নামে সেই মহিলার কাছ থেকে উদ্ধার করেছিলেন ফিরিয়ে-না-দেওয়া আরও কয়েকটি খাতা। সেখানেই ছিল ‘অপ্রকাশিত’ কবিতাগুলি।
সংকলিত সব কবিতাই অবশ্য অপ্রকাশিত নয়। সম্পাদক সে কথা স্বীকারও করেছেন। চারটি কবিতা লেখকের জীবদ্দশাতেই প্রকাশিত হয়েছে। মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১৫, ২১ ও ৩৮ সংখ্যক কবিতা। ৩৩ সংখ্যক কবিতা কোনও কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত না হলেও ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩৯-এ। এইখানেই প্রশ্ন ওঠে, আরও কোনও পত্রিকায়, কোথাও না কোথাও প্রকাশিত হয়ে নেই তো সংকলিত আরও কোনও কবিতা? সেটা হলে স্বাভাবিক ভাবেই অপ্রকাশিত অভিধাটি খসে যাবে কবিতাটি থেকে।
তাতে অবশ্য বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আপাতত এই সংকলনের অনেকগুলি কবিতাই আমাদের না-পড়া। সেই নতুনের স্বাদ অবিস্মরণীয়। কারণ এই পর্বে জীবনানন্দ তাঁর শেষ পর্বের মতো নিজেই নিজের বৃত্তে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছেন না। তাঁর নিজস্বতা অমিত শক্তিতে এই পর্বের কবিতাগুলিতে ফুটে উঠেছে। যেমন ১৬ নম্বর কবিতাটি,
‘রজনীর অন্ধকার এইরকম।
তবুও আরও অন্য এক অন্ধকার আসে
মোমের প্রদীপ হাতে—কোনোদিন—
কিশা গৌতমীর মতো মূঢ় হয়ে চলে নাক’।
এই সংকলনে কবিতাগুলির বিকল্প পাঠও দেওয়া হয়েছে। আটটি কবিতা মূল খাতার পৃষ্ঠা থেকে জীবনানন্দের হাতের লেখাতেই ছাপা হয়েছে। কিন্তু কেন প্রকাশিত কবিতাগুলিকেও অপ্রকাশিত-র অন্তর্ভুক্ত করা হল? শুধু অপ্রকাশিত থাকলেই বা ক্ষতি কী ছিল? সম্পাদকের মনে হয়েছে, ‘এই চল্লিশটি কবিতা যেন এক মহাকবিতার আদল। এর আত্মা ইতিহাসচেতনা আর শরীর মহাকাশচেতনায় লীন। চারটি কবিতা বাদ দিলে সেই সুর কেটে যেত।’ কবিতার পরে কবিতা গেঁথে জীবনানন্দের আর একটি সুরে বাঁধা কাব্যগ্রন্থ তৈরি করে তোলার দায়িত্ব সম্ভবত সম্পাদকের নয়। কারণ, ওই মনে হওয়াটা তাঁর ব্যক্তিগত। জীবনানন্দের মতো এক জন কবির ‘অপ্রকাশিত’ কবিতার সংকলন করতে গিয়ে যতটা সম্ভব নৈর্ব্যক্তিক থাকাই ভাল সম্পাদকের।