একশ্চৈতন্যচন্দ্রঃ পরমকরুণয়া সর্ব্বমাবিশ্চকার’ কথাটা এত দিন সুবচন রূপেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। তার রচনাগত চলিতরূপ হাতে এল এক বইয়ের আকারে, যার নাম এক জন্মেই জন্মান্তর, লেখক অলখ মুখোপাধ্যায়, যিনি একদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ নিয়েছেন। অলখ ও তাঁর লেখালেখি এত দিন আমার কাছে ছিল অলক্ষ কিন্তু মানতেই হবে তাঁর রচনাপ্রতিভার একাগ্র গভীরতাকে এবং বিষয়গত অনন্যতাকে। বইটি বস্তুত ষোড়শ শতকের প্রথম দশক উপান্তের নবদ্বীপের পরিবর্তমান ধর্মসমাজ ও ভাবসংঘাতের গহন অবলোকন। এই বিশেষ সময়ে নবদ্বীপকে ঘিরে ‘বিদ্যাভাবনা ও পুণ্যচর্চা’, সাহিত্যাদর্শ ও শাস্ত্রচিন্তা, দেবভাষা ও বাংলা ভাষার মধ্যে যে সংঘাত ঘটেছিল, যাতে টলে গিয়েছিল অজরামর ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের সংস্কৃতি, ১৯৯ পৃষ্ঠার ঠাসবুনট এই উপন্যাসে তা অভিব্যক্ত হয়েছে। ৩৯টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই কাহিনি মহাপ্রভুর জীবনযাপনের আদি পাঠ, তাঁর নিমাই-পর্বের নানা দোলাচলে নিবিড় ও মননময়, আমাদের কৌতূহলকে সারাক্ষণ ধরে রাখে। তিনি যে এক জন ব্যক্তিমাত্র নন, তাঁর ছিল এক স্নিগ্ধ পারিবারিক পরিসর শচী আর বিষ্ণুপ্রিয়াকে ঘিরে, তাঁর যে ছিল শ্রীবাস, অদ্বৈত এবং বিদ্যাচর্চার সঙ্গে জড়িত ক’জন মেধাবী পাঠার্থী, সেই দিকটি উপেক্ষিত থাকেনি। উঠে এসেছে সমকালীন নবদ্বীপখণ্ডের প্রতিবেশ-পুরজন, তাঁদের নানা জাগৃতি ও অভিযান প্রসঙ্গ। অলখ মনে করেছেন এক জন্মেই জন্মান্তর শুধু চৈতন্যদেবের কথকতা নয়, তাতে বিধৃত আছে এক জনপদেরও জন্মান্তর বার্তা। এই বিশেষ উপন্যাস প্রান্তরের পথে পথে পাথর ছড়ানো এবং ঔপন্যাসিক চৈতন্যজীবনের আজ পর্যন্ত অনুদ্ঘাটিত এক অলখ পথে যাওয়া আসা করেছেন। তাঁকে স্বাগত জানাই।
বইয়ের কাহিনিগতি সর্বদা চলেছে অভিযান আর পর্যটনের অভিমুখে। মিশ্র পরিবারের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ দুই সন্তান, বিশ্বরূপ আর বিশ্বম্ভরের জীবনে কী ভাবে যেন এসেছিল কোনও পরা আহ্বান। নগরী ও নদী তাঁদের ধরে রাখতে পারেনি কারণ নগরজীবন যাপনের যে মূল শর্ত, অর্থাৎ বৈপরীত্যের সামঞ্জস্যসাধন তা তাঁরা মানেননি। নদী যেমন নানা তরণী ধারণ করতে পারে মানবজীবন কি অতটা ধারণক্ষম? মননজীবী মানুষের জীবন অভিযানে বারে বারে আসে ‘প্রতিপক্ষ, প্রতিপ্রশ্ন, প্রতিগতি এবং প্রতিরূপ’ আর সেই জন্য জীবনভর তাকে গ্রহণ করতে হয় নতুন নতুন একক, নিজেকে গড়ে তুলতে হয় একটি পতাকার মতো, যার আছে সুনির্দিষ্ট প্রতীক ও বার্তা। অলখ তাঁর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী গ্রন্থে বিষয়ের দিকে যে পরিমাণ মনঃসংযোগ করে, ধারালো ভাষাশৈলী আয়ত্ত করে এবং ঐতিহাসিক নানা পুরাণপুরুষের (যেমন অদ্বৈত-নিত্যানন্দ-শ্রীবাস) ও নারীর (শচী-বিষ্ণুপ্রিয়া-মালিনী) অন্তর্জীবনের আততি ও অন্তর্দাহকে সারস্বত ভাবনার উপজীব্য করেছেন তা সম্ভ্রমপূর্ণ ও অভূতপূর্ব।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন উপন্যাসটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, যে হেতু তার কেন্দ্রীয় পুরুষ এক যুগন্ধর বাঙালি, ক্রমিক চেতনার আরোহণী থেকে যাঁর মানস অধিবিদ্যার রহস্যে মশগুল হয়ে থাকে, সমাজ সংসার মিথ্যা হয়ে ওঠে, অচৈতন্য থেকে সচৈতন্য হয়ে ওঠার তাঁর যে যাত্রাপথ তা বেদনা ও সংক্ষোভে নিপীড়িত। বইয়ের আটত্রিশটি অধ্যায়ে যিনি নিমাই নামে আখ্যাত, তাঁকেই চৈতন্য নামে পরিচায়িত করা হল শেষ অধ্যায়ে, কেশবভারতীর কাছে দীক্ষাগ্রহণের অন্তে। কাটোয়ায় দীক্ষাস্নানের পরে নদীপথে চৈতন্যদেব আর নবদ্বীপে ফেরেন না। নারী, নদী, নগরী এড়িয়ে নয়, পেরিয়ে তিনি চলে যান শান্তিপুরে অদ্বৈতাচার্যের সান্নিধ্যে। প্রবল আবেগে তীব্র শারীরিক বলে তিনি অগ্রজ অদ্বৈতকে প্রহার করতে থাকেন। কাঁদতে থাকেন। লুটিয়ে পড়তে থাকেন আর দেশজ বুলিতে ক্রমাগত বলতে থাকেন: ‘কিলাইমু তোরে কিলাইমু তোরে’। তার পরে রক্তাভ ও সজল চোখে বলেন, ‘তোমার সকল ভার আমার আমার।’ এখানেই চৈতন্যের আত্মচরিতার্থতার বাণী। এই চরিতার্থতার ব্রত পালনের শুদ্ধি আসে তাঁর সন্ন্যাসের পথে নতুন অভিযাত্রায়।
তবে সন্ন্যাস গ্রহণের সিদ্ধান্তের আগে নিমাইকে পেরোতে হয় অনেক পারিবেশিক জট। এই প্রথম অলখ তাঁর নিজস্ব পঠনপাঠনের স্বাতন্ত্র্য থেকে উপস্থাপন করেন তৎকালীন নবদ্বীপের তৎপর বিদ্যাসমাজ ও বিদ্যাদানের পরিসর। আসে নানা ধর্মসম্প্রদায়ের সংযোগ। যেখানে ব্রাহ্মণ্য বৈদিকতার পাশে স্থান করে নেয় রঘুনন্দনের স্মৃতিশাস্ত্র, আগমবাগীশের নিজস্ব তন্ত্র সাধনা ও মূর্তিগঠনকলানিপুণ এক সত্তা, এসে পড়ে মনসার সংক্রাম, সুফি সাধকদের উল্লেখ আর বণিক সম্প্রদায়ের রক্তগত সেই আহ্বান: ‘বাণিজ্যেতে যাবই আমি’। সব মিলিয়ে ধর্মচর্চার এক জঙ্গম আলোড়ন পাঠককে সর্বদা সচেতন রাখে। হিন্দু ধর্মে কখনও কখনও উপাস্যের সঙ্গে সঙ্গে উপাসকও যে শ্রদ্ধেয় ও প্রণম্য হয়ে ওঠেন এ তত্ত্ব খেয়াল রাখতে হয়। সংগত কারণে উপন্যাসের কাহিনিভাগে উঠে এসেছে শ্রেণি ও বর্ণবিভাজনের দ্বান্দ্বিকতা। নিমাইকে এ সবের কেন্দ্রে রেখে ঔপন্যাসিক দেখাতে চান কী ভাবে তিনি সব সংস্কার এমনকী বিদ্যাভিমান পর্যন্ত ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। প্রায় সারা জীবন ধরে দৃশ্য থেকে কাহিনি আর কাহিনি থেকে দৃশ্যের পারস্পরিকতার রহস্য তাঁকে স্পর্শ করে। নিমাইয়ের তত্ত্বদর্শী এক মননমূর্তি উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে। কৃষ্ণের ত্রিভঙ্গ মূর্তির ব্যাখ্যান, তাঁর নৃত্যপরতা ও বংশীধ্বনির তাৎপর্য বিশ্লেষণে কথক অভিনব দর্শনের উপস্থাপন করে বলেছেন, বাঁশি ‘বড় আশ্চর্য একটি আয়ুধ। বাঁশি তার সুরে আকর্ষণ করে। কেন আয়ুধ বলছি? কেননা বাঁশি সময়কে আক্রমণ করে।’ আসলে বাঁশির সুরলহরী শ্রোতার কাজকে ভুলিয়ে দেয় এবং পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে। বাঁশি যেন নৌকার প্রতিমা হয়ে তীর থেকে আমাদের টেনে আনে গূঢ় অভিমুখের অভিযানে।
সব মিলিয়ে এটি আসলে এক মেধাবী মনের রচনা। ভাববিহ্বল হরিকথাকাতর যে নিমাইয়ের প্রসঙ্গ গড়পড়তা সর্বত্র দেখি এখানে তার ছাপ পড়েনি। তবে তা যে সুখপাঠ্য তা বলা যাবে না কেন না বইটি তো আম পাঠকের উদ্দেশে নিবেদিত নয়। এর পুরো রস আদায় করতে হলে পাঠকের প্রস্তুতি ও এলেমদারি থাকা চাই। সুন্দর সুমুদ্রিত এই পুষ্পল বইটিতে বেশ ক’টি মুদ্রণপ্রমাদজনিত কীট ব্যথা দেয়।