বাংলার বহুস্তরীয় সমাজজীবনে ইতিহাসের খণ্ডকালীন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতও কালপরম্পরায় তার প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখে। প্রায় দুশো বছর আগে ইছামতী যমুনা ভূ-পরিমণ্ডলের কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনে, স্বদেশি জমিদার-জোতদার আর ইংরেজ শাসকের যৌথতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ প্রকাশ্যে এসেছিল। তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকসাধারণের ইতিহাসের শামিল। কুমারেশ দাশের তিতুমির (বাংলার মুখ, ২০০.০০) রিপোর্ট, তথ্যসূত্র আর বিষয়বিন্যাসে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের কৃষক-আন্দোলন, ধর্মাচরণ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, সামাজিক অন্তঃসূত্র, দেশীয় ভূস্বামীদের ভূমিকা আর ব্রিটিশরাজের সম্পর্কের কথা তুলে আনে। এই পটভূমিতে অসম লড়াইয়ে নারকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লায় ১৮৩১-এর ১৯ নভেম্বর সম্মুখ সংঘর্ষে প্রাণ হারালেন তিতুমির। মুখ্যত আজকের উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাট মহকুমার ভৌগোলিক সীমা সহ সামাজিক পারিপার্শ্বিকতাকে বোধ্য ও পরিশ্রমী আলোচনায় আলোকিত করেছেন লেখক।
ইতিহাসের পথ ধরে পাল্টে যায় প্রশাসনিক চৌহদ্দি— অদলবদল হয় ভৌগোলিক সীমারেখা। দেশ, প্রদেশ, জেলা পেরিয়ে তা আরও ক্ষুদ্র সীমায় নির্দিষ্ট হয়ে নানা ভাবে সম্পর্কের আত্মকথা তৈরি করে। মেদিনীপুর জেলা ভাগের এক দশক পর পূর্ব মেদিনীপুর ভূভাগের কথা গ্রন্থবদ্ধ করেছেন হরপ্রসাদ সাহু তাঁর আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর-এ (বাকপ্রতিমা, ৩০০.০০)। জেলার মহকুমা, ব্লক, পুরসভার তথ্যপঞ্জির সঙ্গে প্রাচীন রাজকাহিনি, মন্দির-মসজিদ, স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার, লেখক, স্বাধীনতা-সংগ্রামে জেলার ভূমিকা, পত্রপত্রিকা ও বইয়ের খোঁজখবর নিয়ে বহু বিচিত্র তথ্যতালিকায় সমৃদ্ধ এই প্রকাশনা। এ ক্ষেত্রে জেলা-পরিচয়ের মূলত এই পঞ্জিকৃত বর্ণনার প্রয়াস প্রশংসনীয়।
জেলা বর্ধমানের আসানসোল মহকুমায় রাঢ়বঙ্গের নিজস্বতার সঙ্গে খনি অঞ্চলের জীবনবৈচিত্র স্বতন্ত্র মাত্রা পেয়েছে। নন্দদুলাল আচার্যের সম্পাদনায় আসানসোলের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (মিত্রম্, ৩০০.০০) এই পটভূমিতে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার অন্যতম প্রয়াস হিসাবে গণ্য হবে। খনিপ্রধান এলাকার প্রাত্যহিক জীবন, পরিবেশ, জনগোষ্ঠী, ভাষা, প্রতিবেশী জেলা ও পশ্চিম সীমানার ভিন্-রাজ্যের অবস্থানগত প্রভাব ও আদানপ্রদানের বহুস্তরীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত এই সংকলনে। ইতিহাস ও বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রানিগঞ্জ-আসানসোলের শহরভিত্তিক তথ্য, খনি অঞ্চলের শ্রমিক আন্দোলন, পত্রপত্রিকা, নাট্য চর্চা, লোকসংস্কৃতি, মেলা-উত্সব ইত্যাদি বিষয় ভিন্ন ভিন্ন লেখকের রচনায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
‘আমরা যারা বাঁচতে চেয়ে বড়ো আকাশের নীচে এসে দাঁড়াই, তারপর আকাশের নীলের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে বিচার-বিশ্লেষণে বসি। তখন নিজের চারপাশ খঁুজে দেখি কেউ নেই। এমন নিঃসঙ্গতা নিয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে গ্রামে যাই।’ আত্ম-উন্মেষের উজ্জ্বলতায় ভরপুর হয়ে বীরভূমের অধিকাংশ গ্রামই ঘুরে ফেলেছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায়। তা থেকে নির্বাচিত দেড়শো গ্রামের বর্ণনা নিয়ে তাঁর রাঙামাটির গ্রাম (বলাকা, ৪৩০.০০)। পথ-প্রান্তর, প্রাচীনত্ব, প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, জীবনবৈচিত্র, ধর্মাচরণ, লোকসংস্কৃতি মিশেছে জেলা-পরিব্রাজনের তথ্য-পরিচয়ে। লেখকেরই লোকসংস্কৃতির স্বরূপ ও সন্ধান (বোনা, ৩০০.০০) জেলা, রাজ্য ছাড়িয়ে দেশ, ভিন্ রাজ্য ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের উত্সব ও মেলা সহ লোকসংগীত, লোকনৃত্য, লোকনাট্য, পট, আলপনা, উল্কি, সাঁওতাল সমাজের নাচগান ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে আলোচনা। এ সব রচনায় ক্ষেত্র-অন্বেষণের ভিত্তিতেই লেখকের সহজাত অভিনিবেশ গড়ে উঠেছে।
বিদ্যা চর্চার বিষয় হিসাবে লোকসংস্কৃতি এখন নানা বিস্তারে পল্লবিত। পঠনপাঠন ও গবেষণার ধারা বিগত কয়েক দশক যাবত্ প্রবাহী হয়ে বর্তমানে অনেকাংশে স্পষ্টতর হয়েছে। পবিত্র চক্রবর্তীর বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস ১ম খণ্ডের (জয়দুর্গা লাইব্রেরী, ৩০০.০০) তথ্য-তালিকা ও সূত্রের প্রাচুর্য দেখলেই তা জানা যায়। বইটির পাঁচটি অধ্যায়ে বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসের সাধারণ আলোচনা, ছড়া, প্রবাদ, লোকসংগীত, ধাঁধা-র বিষয়বস্তু নিয়েই বৃহদায়তন কাঠামো তৈরি হয়েছে। উদ্ধৃতির বিপুল আয়োজনে লেখক দেখিয়েছেন লোকসংস্কৃতি চর্চার গতিপ্রকৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার হাল-হকিকত, যদিও মূলত লোকসাহিত্য-ভিত্তিক শিক্ষণপ্রণালীর প্রভাব আর ধারাবাহিকতায় বিষয় হিসাবে লোকসংস্কৃতি ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির বহুবর্ণী বিষয়-উপাদান ভাষা, ধর্ম, শিল্পকলা, মেলা-উত্সব, লোকাচার ইত্যাদি নিয়ে সার্বিক জীবনসংস্কৃতির ইতিহাস সুসমঞ্জস হয়ে ওঠেনি।
‘আয়মাদের বিটির বিয়ে, পয়সা-পানী এক/ ঘরের কাজ শিকেয় তুলি, মেরাছিন নাচ দেখ্/ লাচন দেখি ভিরমি খাবে, উল্টো পাকের লাচন/ পানের থিকে চুন খসলি, সাত পুরুষের মরণ—’। বিয়ের গানে সমাজ ও জীবনের নানা খঁুটিনাটি পারিপার্শ্বিক বিষয় এনে ছন্দে সুরে আমোদ আর উত্সবের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়। বিয়ের রীতি-আচারের বিষয় ছাপিয়ে চৌহদ্দির অন্য বিষয়ের গানই প্রাধান্য পায়। মহিলারাই এই গীতের রূপকার ও পরিবেশক। বাংলা বিয়ের গান (গাঙচিল, ৩৭৫.০০) শীর্ষক বইয়ে রত্না রশীদ বন্দ্যোপাধ্যায় আঙিনার অন্দরে গিয়ে ঔত্সুক্য আর মমতা দিয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন গীত-সুরে সমাজ-সম্পর্কের অন্তরকথা। মুসলিম বিয়ের গানই এ বইয়ের মুখ্য বিষয়— আচার-অনুষ্ঠান কেন্দ্রিকতার যে কত পর্যায়, তা নাচে-গানে প্রকাশমান হয়ে ওঠে। হিন্দু বিয়ের গানের ধারা তো হারিয়েই গেছে! অন্তঃপুরে টিকে থাকা বাঙালির বিয়ের গানের ধারা বর্তমানে কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রকাশ প্রদর্শনে যেমন দেখা যাচ্ছে— তেমনই চর্চা-আলোচনায় প্রসারলাভের প্রয়াসে লেখকের ভূমিকাও ধন্যবাদার্হ।