শেষ কবে পাঁচ লক্ষ পাউন্ড জেতার খবর নিয়ে ইমেল এসেছে আপনার কাছে? শুধু নিজের সম্বন্ধে কিছু তথ্য আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরটুকু পাঠিয়ে দিয়েই যে টাকা চলে আসবে আপনার হাতে? হ্যাঁ, সঙ্গে প্রসেসিং ফি বাবদ সামান্য কিছু টাকাও পাঠাতে হবে, কিন্তু প্রাপ্তির তুলনায় তা নিতান্তই তুচ্ছ। এখন হয়তো আর পড়েও দেখেন না সেই মেলগুলো। পড়লে দেখবেন, প্রায় সব মেলই আসে নাইজেরিয়ার বাসিন্দার কাছ থেকে— অন্তত মেলে সে রকমই দাবি থাকে। বস্তুত, ‘নাইজেরিয়া’ শব্দটা চোখে পড়লেই বুঝি, ওটা লোক ঠকানোর কল। প্রসেসিং ফি-র টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফিকির।
কিন্তু, একটা কথা ভেবে দেখেছেন কি— যারা প্রতি দিন এমন মেল পাঠিয়ে চলেছে, তারা কি নেহাতই গণ্ডমূর্খ? তারা কি জানে না, নাইজেরিয়া শব্দটা দেখলেই আর কেউ সেই মেলগুলোকে পাত্তাও দেবে না? তা হলে আর মেল পাঠিয়ে লাভ কী? কর্ম্যাক হার্লে নামে এক কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট এই প্রশ্নটা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন। তিনি যে উত্তরে পৌঁছোন, তা চমকপ্রদ। এবং, অসম্ভব যুক্তিগ্রাহ্য। প্রতি দিন অজস্র মানুষকে স্প্যাম মেল পাঠানোর কাজটা কার্যত নিখরচায় করা সম্ভব প্রোগ্রাম তৈরি করে দিলে কম্পিউটার নিজেই কাজটা করে নিতে পারে। কিন্তু, সেটা শুধুমাত্র প্রথম ধাপ। যাঁরা ই-মেলের উত্তর দেবেন, তাঁদের সঙ্গে কথা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁদের থেকে প্রসেসিং ফি-টুকু আদায় করতে পারার কাজটা তেমন ভাবে হবে না। তার জন্য খাটনি আছে। কাজেই, যারা ঠকবে না, তাদের ছেঁটে ফেলতে পারা এই লোক ঠকানোর খেলার একটা মস্ত কাজ। ‘নাইজেরিয়া’ শব্দটা ঠিক সেই কাজটাই করে। হাজার জনের মধ্যে ৯৯৯ জনই ‘নাইজেরিয়া’-র উল্লেখ দেখেই সেই মেলটাকে ডিলিট করে দেন। স্প্যামাররাও সেটাই চায়। নাইজেরিয়ার উল্লেখও যাঁর মনে সন্দেহ তৈরি করে না, তিনি আসলে বলেই দেন, ‘আমি খুব বোকা, এসো আমায় ঠকাও’! এই এক জনের পিছনেই বাকি খাটনিটা খাটে স্প্যামাররা। এবং, বেশ ভাল রকম ঠকাতেও পারে। এতটাই যে আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগে দফতর তৈরি হয়েছে এই চিটিংবাজিতে নজর রাখার জন্য।
স্টিভেন লেভিট আর স্টিফেন ডাবনার তাঁদের নতুন বই থিঙ্ক লাইক আ ফ্রিক-এ উল্লেখ করেছেন এই স্প্যামিং রহস্যের। সাধারণ পাঠকের জন্য অর্থনীতি চর্চার ইতিহাসে এই দু’জনের অবদান প্রায় প্রশ্নাতীত। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁদের প্রথম বই ফ্রিকোনমিকস। ২০০৯-এ সুপার ফ্রিকোনমিকস। দুনিয়া জুড়ে বেস্টসেলার তো বটেই, অর্থনীতি বিষয়টার সংজ্ঞাই প্রায় বদলে দিয়েছিল এই বইদুটো। বস্তুত, তাঁদের প্রথম দুটো বইয়ে ইকনমিকস বা অর্থনীতি যতখানি ছিল, ‘ফ্রিক’ বা ভিন্ন গোত্রের ভাবনাও ছিল ততখানিই। খেয়াল করার, তৃতীয় বইয়ের নাম থেকে অর্থনীতি হারিয়ে গিয়েছে, রয়ে গিয়েছে শুধু ‘ফ্রিক’। কাজেই, এটা একটা অন্য বই। তাকে অন্য, নতুন বইয়ের মতো পড়াই ভাল। না পড়লে, প্রথম দুটির সঙ্গে তুলনা করলে, হতাশ হতে পারেন।
আগের দুটো বই ছিল অর্থনীতির গবেষণার দুনিয়ার খবরকে টক-ঝাল-মিষ্টি মশলা দিয়ে পরিবেশন করা। এই বইটিতে লেখকরা সচেতন ভাবেই সরে এসেছেন অন্য দিকে। এখানে তাঁরা এক অর্থে মাস্টারমশাই। ‘ফ্রিক’-এর মতো ভাবতে হলে কী ভাবে দুনিয়াটাকে দেখতে হবে, শেখাতে চেয়েছেন। ফ্রিক-এর মতো ভাবনা মানে, ওপরে যে স্প্যামারদের গল্প বললাম, তাদের মতো ভাবতে শেখা। অর্থাৎ, চেনা ছকের বাইরে এসে এমন পথ তৈরি করে নেওয়া, যাতে অভীষ্টে পৌঁছনোর কাজটা সহজতর হয়। প্রশ্ন হল, গোটা দুনিয়ার সব বইয়ের দোকানে যখন উপচে পড়ছে ‘সেল্ফ হেল্প’ আর ‘আউট অব দ্য বক্স থিঙ্কিং’-এর বই, তখন লেভিটদের আর প্রয়োজন কী ছিল এমন বই লেখার? সহজ উত্তর: অন্য বইগুলো যাঁরা লিখছেন, দুনিয়াটাকে অর্থনীতির চশমায় দেখার প্রশিক্ষণ তাঁদের অনেকেরই নেই। আর, এই চশমা ছাড়া অনেক জিনিসের মর্মোদ্ধার কঠিন।
যেমন ধরুন, গত দশ-পনেরো বছরে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে ‘ইনসেনটিভ’ বা প্রণোদনাতে অপুত্রের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন! অর্থাৎ, ঠিক মতো লাভের (মতান্তরে, লোভের) ব্যবস্থা করতে পারলে মানুষকে দিয়ে আপনার পছন্দের কাজটি বিলক্ষণ করিয়ে নিতে পারবেন। কথাটার যে উল্টো পিঠও আছে, অর্থনীতিবিদরা সাধারণত তা চেপে যান। লেভিটরাও, তাঁদের আগের দুটো বইয়ে, এই উল্টো দিকের গল্প বলেননি। এই বইয়ে একেবারে ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে এনেছেন লেভিট। তাঁর তিন বছরের কন্যা আর সব কিছুতেই দড়, কিন্তু পটি ট্রেনিং-এ ফেল করাই তার অভীষ্ট। কিছুতেই একা টয়লেটে যেতে রাজি নয় সে। তার জন্য ইনসেনটিভের ব্যবস্থা হল। একা টয়লেটে গেলেই একটি লজেন্স। দিব্যি কাজ করল ইনসেনটিভ। মেয়ে একাই টয়লেটে যেতে আরম্ভ করল। কিন্তু হায়! দু’দিনের মাথায় দেখা গেল, প্রতি পাঁচ মিনিটে এক বার টয়লেটে যাচ্ছে সে, এবং সত্যিই সামান্য পরিমাণ হিসি করে এসে একটা করে লজেন্স বাগাচ্ছে। লেভিট লিখেছেন, তাঁর ইনসেনটিভ একটি শৌচালয়-বিমুখ শিশুকে মাত্র তিন দিনে ইউরিনারি ব্লাডার নিয়ন্ত্রণের চ্যাম্পিয়ন করে তুলল!
শুধু তাঁর মেয়ের ক্ষেত্রেই নয়, ইনসেনটিভ যে আরও অনেক বড় জায়গাতেও গোলমাল পাকিয়ে তুলতে পারে, তার উদাহরণ দিয়েছেন লেভিটরা। সত্যি বলতে, উদাহরণগুলো নতুন নয়। তাঁদের আগের বইয়ের উদাহরণগুলো পড়ে যেমন হতচকিত হয়ে যেতে হত, এগুলো সেই গোত্রেরও নয়। তবু, লেভিটরা যে কথা বলতে চান, তার জন্য উদাহরণগুলো জরুরি। আমেরিকার একটি প্লে স্কুলের উদাহরণ যেমন। বেশ কিছু অভিভাবক স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার অনেক পরে বাচ্চাদের আনতে যেতেন। ফলে, শিক্ষিকাদের আটকে থাকতে হত অনেক বেশি সময়। স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেক ভেবে স্থির করলেন, দেরিতে বাচ্চা নিতে এলে অতঃপর জরিমানা দিতে হবে। এটাও ইনসেনটিভ, তবে উল্টো দিকের— বাচ্চাকে সময় মতো ফিরিয়ে নিলে আর জরিমানা দিতে হবে না (অর্থাৎ, জরিমানার টাকাটা পকেট থেকে বার করতে যতটা খারাপ লাগে, সেটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে)। কিন্তু ফল দাঁড়াল উল্টো। দেখা গেল, আরও অনেক বেশি দেরি করছেন অভিভাবকরা। কেন? শিক্ষিকাদের স্কুলে বসে থাকতে বাধ্য করার ফলে অভিভাবকদের মনে যে অপরাধবোধ কাজ করত, জরিমানা এসে সেই অপরাধবোধকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। অভিভাবকরা জরিমানার অন্তর্নিহিত তিরস্কারটাকে গায়ে মাখলেন না, বরং ভাবলেন, জরিমানার টাকাটা আসলে শিক্ষিকাদের ওভারটাইম। তাঁরা বেশি কাজ করাচ্ছেন বটে, কিন্তু সেই মজুরিও দিয়ে দিচ্ছেন। অতএব, অপরাধবোধের ঠাঁই নেই।
এক প্রথিতযশা দার্শনিক, হার্ভার্ডের অধ্যাপক মাইকেল স্যান্ডেলও তাঁর হোয়াট মানি কান্ট বাই বইয়ে এই উদাহরণটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি যে ভাবে এই ঘটনাটিকে দেখেছিলেন, এবং লেভিটরা যে ভাবে দেখেছেন, তার ফারাক চোখে পড়ার মতো। স্যান্ডেলের মতে, আর্থিক জরিমানা এসে দেরি করে আসার ‘অপরাধ’-এর মূল্য স্থির করে দিল, ফলে এটাও বাজারে বিক্রি হওয়া আর একটা পরিষেবা হয়ে গেল। ফলে, শিক্ষিকা-অভিভাবক সম্পর্কের মর্যাদাও হ্রাস পেল কোথাও। আর লেভিটরা বলবেন, এটা ইনসেনটিভ তৈরি করার ভুল। জরিমানার পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়াতেই এই বিপত্তি। যথেষ্ট জরিমানা দিতে হলেই অভিভাবকরা ঠিক সময়ে পৌঁছোতেন। লেভিটরা সম্পর্কের মর্যাদার প্রশ্নে ঢুকবেনই না কোথাও।
স্যান্ডেল আর লেভিটদের মধ্যে এই যে ফারাক, এটা আসলে অর্থনীতির দুনিয়ার সঙ্গে বাকি পৃথিবীর পার্থক্য। থিঙ্ক লাইক আ ফ্রিক-এ এই পার্থক্য চোখে পড়তে বাধ্য। লেভিটদের কাছে কিছু শেখার না-ই বা থাক, এই পার্থক্যটুকু দেখার জন্যও বইটা পড়া যেতে পারে।