পুস্তক পরিচয় ১

জাতীয়তাবাদের বিভিন্নতা স্বীকৃত ছিল বাংলায়

এখানে অদ্বৈতবাদ শব্দটি প্রয়োগ করছি সেই ধরনের জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে যা দেশের কোনও জনগোষ্ঠীর স্বাধীন সত্তাবোধ ও স্বাতন্ত্রমূলক চিন্তাকে সাম্প্রদায়িকতা অথবা দেশদ্রোহী মনোভাব হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।

Advertisement

সব্যসাচী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share:

স্বাধীনতা-দিবস: কলকাতার রাজপথ, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭

ডিফারেন্ট ন্যাশনালিজমস: বেঙ্গল ১৯০৫-১৯৪৭

Advertisement

লেখক: সেমন্তী ঘোষ

৯৯৫.০০

Advertisement

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

আলোচ্য বইটির চিত্তাকর্ষক বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে নতুন নানা প্রশ্ন রয়েছে, তাই নিয়ে তর্কবিতর্ক হবে আশা করা যায়। বইটি লেখা ইংরেজিতে, আকর বেশির ভাগ বাংলা ভাষায়, অনেক শব্দ বা ধারণা এতে রয়েছে যা ইংরেজিতে চলতি কিন্তু বাংলা প্রতিশব্দ বিরল। সুতরাং বাংলায় গ্রন্থ সমালোচনায় প্রয়োজন যুগপৎ অনুবাদ ও সমীক্ষা। তাই এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় কেবল মৌলিক দু-একটি বিতর্কের বিষয়ে বলা চলতে পারে।

প্রায় চারশো পাতার বিশাল পরিসরে সেমন্তী ঘোষ অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ১৯৯৯ সালে লেখা আমেরিকার টাফ্‌টস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি গবেষণাকর্মটিকে পেশ করেছেন। গবেষকদের প্রটোকল মাফিক যাবতীয় প্রমাণ, মহাফেজখানা থেকে নেওয়া আকর, প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সমকালীন পত্রকার ও লেখকদের মতামত, ইত্যাদি নিখুঁত ভাবে পরিবেশিত হয়েছে। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, দিল্লির জাতীয় অভিলেখাগার, ঢাকায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আর্কাইভস, ইত্যাদি ছাড়াও বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি, রাজশাহির বরেন্দ্র মিউজিয়াম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা, ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরি, কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, এবং সমজাতীয় নানা আকর-সংগ্রহে সেমন্তীর গবেষণা। অপর দিকে পত্রকার হিসেবে সংবাদপত্রে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় লেখকের ঐতিহাসিক গবেষণা এবং বর্তমান রাজনীতিতে জ্ঞান এই দুইয়ের চমৎকার সমাবেশ এই বইয়ে চোখে পড়ে। এই বইয়ের বক্তব্যের বিপক্ষবাদীর সংখ্যা বোধহয় কম হবে না। যদি তাঁরা সমান দক্ষতার সঙ্গে যুক্তি খণ্ডন না করেন তবে তাঁদের মত অগ্রাহ্য হতে হবে। অধিকারভেদ বস্তুটা কেবল আমাদের দেশের শাস্ত্র-আলোচনায় নয়, সর্বকালে সর্বদেশে বিদ্বানদের মানতে হয়। কথাটা বলা দরকার কেননা, আবেগবশত যাঁরা এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য খণ্ডন করতে চাইবেন তাঁদের মনে রাখতে হবে বিষয়ের উপর অধিকার এই লেখক কী ভাবে সাব্যস্ত করেছেন।

সহজ কথায় এই বইটির কয়েকটি প্রতিপাদ্য পেশ করার চেষ্টা করা যাক। প্রথমেই প্রশ্ন এই যে, সাধারণত যে অদ্বৈতবাদী জাতীয়তাবাদ চলতি আছে সেটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? এখানে অদ্বৈতবাদ শব্দটি প্রয়োগ করছি সেই ধরনের জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে যা দেশের কোনও জনগোষ্ঠীর স্বাধীন সত্তাবোধ ও স্বাতন্ত্রমূলক চিন্তাকে সাম্প্রদায়িকতা অথবা দেশদ্রোহী মনোভাব হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। এই মতে একটাই ভারতীয় নেশন ছিল, আছে আর থাকবে। এর বিপরীত মত জাতীয়তাবোধের বহুত্বকে স্বীকার করে নেয়। সেই মতের অনুসরণে এই বইটির শিরোনাম ডিফারেন্ট ন্যাশনালিজমস বিভিন্ন জাতীয়তাবোধ। সাধারণত এই ধারার চিন্তাকে জাতীয় রাজনীতির শীর্ষস্তরে অবস্থিত কর্তারা অবজ্ঞা করেছেন, এবং প্রতিষ্ঠাবান ইতিহাসবিদরা তাঁদের কেতাবের মধ্যে জায়গা দেননি। এই অভিযোগ থেকে লেখক এগিয়েছেন প্রাসঙ্গিক ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের দিকে। যদিও জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদরা কেবল একটি জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করেন, সেই অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে এই বইয়ে প্রস্তাবিত হয়েছে যে জাতীয়তা একাধিক ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। তার বিশেষ অভিনিবেশের বিষয় হল, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দ্বিতীয় বঙ্গবিভাগ এই সময়সীমার মধ্যে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সত্তাবোধের উন্মেষ ও তার সঙ্গে এই সময়ের বাংলায় জাতীয়তার পরিবর্তনশীল ধারণার স্বচ্ছ বিচার।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি লেখা, তার উল্লেখ এই বইটিতে নেই, কিন্তু সমজাতীয় প্রাসঙ্গিক লেখার উল্লেখ আছে। ১৯০২ সালে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ভারতবর্ষ বিসদৃশকেও সম্বন্ধ বন্ধনে বাধিবার চেষ্টা করিয়াছে। যেখানে যথার্থ পার্থক্য আছে সেখানে সেই পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করিয়া, সংযত করিয়া, তবে তাহাকে ঐক্যদান করা সম্ভব। সকলেই এক হইল বলিয়া আইন করিলেই এক হয় না। যাহারা এক হইবার নহে তাহাদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনের উপায়— তাহাদিগকে পৃথক অধিকারের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেওয়া। পৃথককে বলপূর্বক এক করিলে তাহারা একদিন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, সেই বিচ্ছেদের সময় প্রলয় ঘটে।’ (বঙ্গদর্শন, ১৩০৯)। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কথার মধ্যে জাতীয়তাবাদের ঐক্য ও বহুত্বের মূল তত্ত্বটি নিহিত রয়েছে।

জাতীয়তাবোধের এই বহুত্ব যদি আমরা মেনে নিই, অতঃপর প্রশ্ন এই যে রাষ্ট্রতন্ত্র যদি কেন্দ্রাভিমুখী হয় সেখানে বহু জাতীয়তাবোধের জায়গা কোথায়? সোজা উত্তর এই যে— জায়গা নেই। সুতরাং বহুত্বপন্থীরা তন্ত্রটাকে অন্য ভাবে ভেবেছেন, ফেডারেলিজম বা যুক্তরাষ্ট্রবাদের সাহায্যে। সেমন্তী দেখিয়েছেন যে সম্প্রদায় নির্বিশেষে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনা বাংলায় নানা রূপে দেখা গিয়েছিল নানা সময়ে। এবং পাকিস্তানের ধারণাটির পাশাপাশি মুসলমান রাজনৈতিক চিন্তকদের মনে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক স্বশাসনের চিন্তা বড় একটা জায়গা নিয়েছিল। অনেকে হয়তো জানেন যে বাংলার ফজলুল হক প্রথম পাকিস্তান দাবি করে প্রস্তাব আনেন ১৯৪০ সালের মুসলিম লিগের সম্মেলনে। কিন্তু এটা হয়তো সকলে জানেন না যে হক সাহেবের প্রস্তাবিত পাকিস্তান কয়েকটি রাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিল, এবং কয়েক বছর পরে মহম্মদ আলি জিন্না ওই প্রস্তাবে ছাপার ভুল ছিল এই বলে আঞ্চলিক স্বশাসনের দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। অপর দিকে উদাহরণ চিত্তরঞ্জন দাস। জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রাজনৈতিক চিন্তায় কেন্দ্রীকরণ প্রশ্নাতীত রূপে কাম্য— পরে তাঁরা ভারতীয় সংবিধান প্রণয়ন করার সময়ে পাতার পর পাতা টুকেছিলেন ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ভারত শাসন আইন (১৯৩৫) থেকে। তার আগের দশকেই কিন্তু এই কেন্দ্রীকরণের তীব্র বিরোধিতা করে গিয়েছেন চিত্তরঞ্জন দাস। বাংলার স্বকীয়তা ও স্বশাসনের অধিকার বিষয়ে তাঁর চিন্তা বঙ্গীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ১৯১৭ সালে তাঁর প্রথম অভিভাষণ থেকে তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে ১৯২৩ সালের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’, সর্বত্র প্রতীয়মান। সেই সময়ের বিপিনচন্দ্র পাল কিংবা পরবর্তী কালের শরৎচন্দ্র বসুর চিন্তাতেও একই চিন্তা দেখা যায়। এই বইয়ে অনুরূপ বহু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যাতে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রবাদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল বাংলার রাজনৈতিক চিন্তায়।

স্বাধীনতা আন্দোলনের আমলে এই যুক্তরাষ্ট্রবাদের আওতায় আঞ্চলিক সত্তাকে স্বাধীনতা, অন্তত স্বশাসনের অধিকার কায়েম করার চেষ্টা বাংলার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল বলা যেতে পারে। তার পরে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গেও তার প্রভাব ক্রিয়াশীল, এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আর একটি বিষয়ে বাংলার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে লেখক বলেছেন, ‘‘আমার উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদকে একশৈলিকতা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া, কেননা আমার প্রতিপাদ্য এই যে বাংলার জাতীয়তাবাদে কিন্তু সেই সময়ে ‘পার্থক্য’ বিষয়ে বিশেষ সচেতন চিন্তাভাবনা দেখা গিয়েছিল।’’ এখানে ‘পার্থক্য’ ব্যাপারটা কী? ‘ঔপনিবেশিক ভারতের প্রজাকুলের অবধারিত দায়িত্ব ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজ নিজ স্বাধিকার সাব্যস্ত করার লড়াইতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন, অপর দিকে তাদের অবশ্যকরণীয় ছিল তাদের বহুধাবিভক্ত সামাজিক অবস্থার মোকাবিলা করা।’ এক দিকে জাতীয় ‘ঐক্য’র ধারণা। অন্য দিকে নানা ‘পার্থক্য’জনিত জনগোষ্ঠী সমূহের বিভিন্নতা। এই পার্থক্যের চেতনা থেকে উদ্ভূত রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বের দাবিদাওয়া, তার থেকে সংঘর্ষ। এই বইতে দেখা যায় যে পার্থক্যকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিভিন্নতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন বহু বাঙালি চিন্তক। ভারতের রাজনীতির একটি মূল সমস্যা বিষয়ে এই বাঙালি চিন্তকদের অন্তর্দৃষ্টিকে দিশা-স্বরূপ বলা যায়।

অদ্বৈতবাদী জাতীয়তাবাদ, যুক্তরাষ্ট্রবাদ এবং পার্থক্যের ধারণা সম্বন্ধে এই বইটির বক্তব্য সংক্ষেপে বলা গেল। জাতীয়তার ধারণায় যাকে অদ্বৈতবাদ বলেছি তার বিরুদ্ধে আগেও অনেকে লিখেছেন, তবে সেই আলাপের এমন বিস্তার ঘটেছে এই বইটিতে যাতে বিতর্ক প্রবল হতে পারে। সেই বিতর্কে দু-একটি কথা মনে রাখা কর্তব্য। প্রথম কথা এই যে আমাদের সত্তাবোধ নানা ধরণের যেমন— আমি হতে পারি সেন্সাস বা জনগণনার খাতায় হিন্দু, পাসপোর্টে এবং নির্বাচনের সময় ভারতীয় নাগরিক, আয়কর দফতরে মধ্যবিত্ত, বাংলার বাইরে ভারতের অন্যত্র পরিচয় বাঙালি, কলকাতা শহরে একজন বাঙাল, মফস্সলে একজন কলকাতাইয়া, খাওয়ার দোকানে নিরামিশাষী, ইত্যাদি। বিভিন্ন আত্মপরিচয়ের মধ্যে হিন্দু হিসেবে পরিচয়টা ‘একটি’, সেটা ‘একমাত্র’ পরিচয় নয়। এই যে সত্তাবোধের বহুত্ব, এবং অদ্বৈতবাদী জাতীয়তাবোধের বিপক্ষতা, এই দুইয়ের মর্মে একই যুক্তি রয়েছে। এখন প্রয়োজন, অদ্বৈতবাদী জাতীয়তাবোধের প্রেরণায় দেশবিভাগের গল্পের যে বাঁধা ছক, সেটা খুঁটিয়ে দেখে বর্তমান লেখক এবং অন্য কিছু ইতিহাসবিদ যা লিখেছেন, পড়ুয়া মহলের বাইরে সাধারণ সমাজে এনে আলোচনা করা। অপর পক্ষে জাতীয়তার প্রতর্কে অদ্বৈতবাদকে প্রশ্ন করতে গিয়ে মনে রাখতে হবে যে, ‘পার্থক্য’ অনস্বীকার্য কিন্তু ‘ঐক্য’র আদর্শ অপরিহার্য। নয়তো কেবল রাষ্ট্র নয়, সমাজও বিপন্ন হবে। প্রতি ভগ্নাংশ আরও ভেঙে ভাগের হিসেব চলতেই থাকবে রেকারিং ডেসিমেল বা পৌনঃপুনিক দশমিকের অঙ্কের মতো। জাতীয়তার অদ্বৈতবাদ ও বহুত্ব বিষয়ে, ঐক্যের আদর্শ ও পার্থক্যের বাস্তবতা নিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে গিয়ে এই দুইয়ের মধ্যপন্থাও বিবেচ্য। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য হয়তো সেই পথেরই সন্ধান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement