পুস্তক পরিচয় ১

রূপান্তরের ইতিহাসে অপরিহার্য

আসলে প্রতিষ্ঠানের নামকরণের মধ্যেই এক ধরনের অ্যাংলোম্যানিয়ার প্রকাশ ঘটেছে। শঙ্খ ঘোষ ‘সূচনাকথা’য় যাকে বলেছেন ‘পরনির্ভরতা আর পরমুখাপেক্ষিতার ইতিহাস’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩০
Share:

ঐতিহ্য: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ভবন। ১৯৮৩ সালে তোলা ছবি

১৮৭২ সালে সে কালের আইসিএস জন বিম্‌স (১৮৩৭-১৯০২) আ কমপ্রিহেন্সিভ গ্রামার অব দি এরিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস রচনার পর বিশেষ ভাবে বাংলা ভাষা চর্চার জন্য ‘বঙ্গ একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। ‘অনুষ্ঠানপত্র’টি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের অনুমোদন-সহ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজ’ শিরোনামে ছাপা হয়— ‘‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ভাষার স্থিরতা বিধানের জন্য সকল বাঙ্গালীর মিলিত হইয়া সভা স্থাপন করত তদ্দ্বারা ভাষার উন্নতি সাধন করা আবশ্যক।...’’ কিন্তু নানা কারণে তখন বিম্‌সের প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। প্রায় দুই দশক পরে শোভাবাজার রাজবাড়ির কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেবের মনে বেঙ্গল অ্যাকাডেমি স্থাপনের ইচ্ছা জাগে। তাঁর সহযোগী ছিলেন লিয়োটার্ড নামে এক জন সাহেব। সেই ইঙ্গবঙ্গ সমাজে তখনও বাংলা সাহিত্যের চর্চা হত ইংরেজিতে। তাই সদস্যদের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার দিকে জোর দেওয়া হয়েছিল। রাজবাড়িতে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য চর্চার জন্য ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে যে-সভা প্রতিষ্ঠিত হল, তার নাম ‘বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচার’। ইংরেজি নামকরণের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠাতাদের মনোভাব বোঝা যায়। শুধু সভাপতি বিনয়কৃষ্ণ নন, সহ-সভাপতি লিয়োটার্ড ও হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সম্পাদক ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী মনে হয় ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে সভার কার্যবিবরণ ইংরেজিতেই লেখা হত এবং মুখপত্রটিও ইংরেজি নামে প্রকাশিত হয়। তবে প্রথম থেকেই সভাটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল— ইংরেজি ও বাংলা-সংস্কৃত। ইংরেজি বইয়ের আলোচনা হবে ইংরেজিতে এবং বাংলা-সংস্কৃত বইয়ের আলোচনা ইংরেজি বা বাংলায়। তবে সেখানেও ইংরেজিরই প্রাধান্য, বাঙালি লেখকরা ইংরেজিতে লিখে বাহবা পেতে উৎসুক (‘‘ইংরাজিতে না বলিলে ইংরাজে বুঝে না; ইংরেজ না বুঝিলে ইংরাজের নিকট মানমর্যাদা হয় না; ইংরাজের কাছে মান মর্যাদা না থাকিলে কোথাও থাকে না, অথবা থাকা না থাকা সমান। ইংরাজ যাহা না শুনিল, সে অরণ্যে রোদন; ইংরাজ যাহা না দেখিল তাহা ভস্মে ঘৃত।’’— বঙ্কিমচন্দ্র)। সারদাপ্রসাদ দে ভারতচন্দ্র রায়ের ও রামনিধি গুপ্তের জীবন ও কাব্য এবং জগৎচন্দ্র সেনের ‘নীতি-গাথা’, ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী বাঙালির নাট্যচর্চা, নবগোপাল মিত্র বাংলা দেশে সাংবাদিকতা, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘নব্যবঙ্গ’ নামে উপন্যাস ও ‘আহূতি’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনা ইংরেজিতে করেছেন। কিন্তু বাংলা বইয়ের আলোচনা বাঙালি কেন ইংরেজিতে করবেন, তার কারণ বোঝা যায় না।

Advertisement

আসলে প্রতিষ্ঠানের নামকরণের মধ্যেই এক ধরনের অ্যাংলোম্যানিয়ার প্রকাশ ঘটেছে। শঙ্খ ঘোষ ‘সূচনাকথা’য় যাকে বলেছেন ‘পরনির্ভরতা আর পরমুখাপেক্ষিতার ইতিহাস’। এর জন্য একমাত্র লিয়োটার্ডকে দায়ী করা অন্যায় হবে। লিয়োটার্ড সভার কার্যবিবরণী লিখতেন বলে তা ইংরেজিতে লেখা হত। বাঙালি সম্পাদক ইচ্ছা হলে বাংলাতেও লিখতে পারতেন (লিয়োটার্ড তেমন প্রস্তাবও দিয়েছিলেন)। আর সভার নামকরণ নিয়েও বাঙালি সদস্যেরা অনেক দিন পর্যন্ত কোনও আপত্তি তোলেননি। তাঁদের মধ্যে হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া সাহিত্যজগতে তখন আর কারও পরিচিতি ছিল না। বিনয়কৃষ্ণের বয়স তখন সাতাশ বছর। ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী যোগশাস্ত্রী অবশ্য ছাত্রজীবন থেকে লেখালিখি করেছেন কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারেননি। ‘ভারতী’ (পৌষ ১৩০০ বঙ্গাব্দ) পত্রিকায় অ্যাকাডেমির সমালোচনায় সঙ্গত কারণেই মন্তব্য করা হয়, ‘‘যে সকল সভ্য লইয়া এই সাহিত্যসভা গঠিত হইয়াছে তাঁহারা কেহই সাহিত্যজগতে সুপরিচিত নহেন। তাহাতে কোন ক্ষতি হইয়াছে কি না তাহা স্থানান্তরে বিচার করিব, আপাততঃ ইহাই দেখিতেছি তাঁহারা প্রসিদ্ধ সাহিত্যকার না হইলেও তাঁহারা সাহিত্যানুরাগী বটে। ইঁহাদের মধ্যে একজন আছেন তাঁহার নাম উল্লেখযোগ্য— মিঃ লিওটার্ড। যতদূর দেখা যাইতেছে এই বিদেশীয় সভ্য উক্ত সভার মস্তিষ্ক, দেশীয়েরা তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। মিঃ লিওটার্ড সম্ভবত বাঙ্গালা জানেন না [কথাটি অবশ্য সত্য নয়], কিন্তু বাঙ্গালা অ্যাকাডেমি কিরূপে ফলোপধারী হইতে পারে সে বিষয়ে তাঁহার ইয়ুরোপীয় সহজ সাহিত্যবুদ্ধি তাঁহাকে ঠিক উপায় নির্দেশ করিয়া দিয়াছে।’’ অল্প দিনের মধ্যেই অবশ্য ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, নবগোপাল মিত্র, তারাকুমার কবিরত্ন, মনোমোহন বসু, রাজনারায়ণ বসু, উমেশচন্দ্র বটব্যাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, রমেশচন্দ্র দত্ত, বসন্তরঞ্জন রায় প্রমুখ অনেকে সদস্যপদ লাভ করায় বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচারের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় উভয়েরই পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।

‘দ্য বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচার’ নামে সভার মুখপত্র মাসিক পত্রিকাটি ১৮৯৩ সালের অগস্ট মাস থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এগারোটি সংখ্যা প্রকাশ করেন সম্পাদক ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী (শেষ সংখ্যার প্রকাশকাল ৯ জুন ১৮৯৪)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সেই এগারোটি সংখ্যা একত্রে গ্রন্থাকারে ফ্যাকসিমিলি সংস্করণ প্রকাশ করেছেন।

Advertisement

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ: দ্য বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচার/ দুষ্প্রাপ্য পত্রিকামালা ৩

সূচনাকথা: শঙ্খ ঘোষ

৩০০.০০

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ

পরিষদের ইতিহাস লেখার চেষ্টা হয়েছে কয়েক বার, প্রথমে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিষৎ-পরিচয়, পরে মদনমোহন কুমারের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইতিহাস: প্রথম পর্ব এবং শেষে বিজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত শতবর্ষ পরিক্রমা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রকাশিত হয়েছে। পরিষদের সভাপতি জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমান পরিষৎ কর্তৃপক্ষ এই মহতী প্রতিষ্ঠানের একটি ইতিহাস রচনায় উদ্যোগী হয়েছেন।’’ সেই ইতিহাস গ্রন্থের পরিপূরক বলা যায় এগারো সংখ্যার এই পত্রিকার পুনর্মুদ্রণ। এই পত্রিকা থেকে বর্তমান পরিষৎ, যার প্রতিষ্ঠাকাল ২৯ এপ্রিল ১৮৯৪, তার আদি রূপ অর্থাৎ সূচনাকালের কথা আমরা জানতে পারি— বিনয়কৃষ্ণ দেব ও লিয়োটার্ড যার উদ্যোক্তা সেই বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচারের প্রতিষ্ঠাকাল ২৩ জুলাই ১৮৯৩। অ্যাকাডেমির উদ্দেশ্য ছিল ‘‘একদিকে ইংরেজি সাহিত্যের, এবং অন্যদিকে সংস্কৃত সাহিত্যের সাহায্য অবলম্বনপূর্বক বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি ও বিস্তারসাধন।’’ উদ্যোক্তারা একটি সর্বার্থসাধক বাংলা অভিধান সঙ্কলনের কথা ভাবেন। বসন্তরঞ্জন রায় কাজ শুরুও করেছিলেন। যথার্থ বাংলা ব্যাকরণ রচনারও পরিকল্পনা করা হয়। অ্যাকাডেমি সমসাময়িক সাহিত্য (বই ও পত্রিকা) নিয়েও নিয়মিত আলোচনা শুরু করে। পরবর্তী কালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ অ্যাকাডেমির উত্তরাধিকার গ্রহণ করলেও সমসাময়িক সাহিত্য জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়।

তবে অ্যাকাডেমিতে সে কালের বিখ্যাত লেখকদের অনুপস্থিতি বিস্ময়কর ঠেকে। বঙ্কিমচন্দ্র তখনও জীবিত। পত্রিকায় এক বার মাত্র তাঁর নামোল্লেখ দেখি। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন, ‘দলবিরোধের দুর্বার বীজ’, তার পরিচয় মেলে অ্যাকাডেমির প্রথম বছরেই। বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচারের শুধু ইংরেজি নামকরণ নয়, অবস্থানভূমি (রাজবাড়ি) এবং কর্মকর্তাদের নির্বাচন নিয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজের আপত্তিবোধ দেখা দেয়, আর চার মাসের মধ্যে সভার নাম, স্থান (ভাড়াবাড়ি) এবং কর্মসমিতির পরিবর্তন ঘটে। সভাপতি বিনয়কৃষ্ণের পরিবর্তে রমেশচন্দ্র দত্ত, সহ-সভাপতি লিয়োটার্ডের পরিবর্তে নবীনচন্দ্র সেন, সম্পাদক ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তীর পরিবর্তে যুগ্মসম্পাদক শরৎচন্দ্র দাস ও হীরেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কর্মকর্তা নির্বাচিত হলেন। রূপান্তরের এই ইতিহাস, যাকে হয়তো বলা যায় রাজসভার সাহিত্যের জনসভার সাহিত্যে পরিণতি, জানতে হলে এই খণ্ডটি অপরিহার্য ও বহু মূল্যবান বিবেচিত হবে।

অলোক রায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement