Ujantalir Upakotha

দেশ পাল্টায়, পীড়নমুক্তি ঘটে না

দেশভাগ অবিশ্বাস্য লাগে বেশির ভাগ নিচুতলার মানুষের কাছে। একেবারে হাত ধরাধরি করে আসে দেশভাগ, দাঙ্গা। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। হিন্দুরা ভারতের পথে পা বাড়ায়, সামনে অনিশ্চয়তা জেনেও।

Advertisement

সুনন্দা সিকদার

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:১৯
Share:

বইটির প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয়েছে কোনও কবিতা, গান বা প্রচলিত ছড়া দিয়ে। নবম অধ্যায়ের শুরুতে গাজির গান, “নানা বরণ গাভীরে ভাই/ একই বরণ দুধ/ জগৎ ভরমিয়া দেখি/ একই মায়ের পুত।” ধর্ম-বর্ণ যা-ই হোক, মানুষের সুখ-দুঃখ ক্ষুধা-তৃষ্ণা যে একই রকম, এক দল মানুষ যুগ যুগ ধরে সেটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে আসছেন। তাঁদের সেই প্রয়াস এখনও সফল হয়নি। বঞ্চিত মানুষের সাধ বা আকাঙ্ক্ষা পূরণের যে স্বপ্ন, তার জন্য যে সংগ্রাম, সে-ও নিরন্তর চলছে, চলবে। বইটি জুড়ে ‘ছোট জাত’-এর মানুষের সেই সংগ্রামের ইতিহাস। আবার সংগ্রামের পাশাপাশি রয়েছে আনন্দ-বিষাদের, আত্মীয়তাবোধের রসে টইটম্বুর জীবনের চলচ্ছবি। রয়েছে পুব বাংলার নদী আর বিলে ভরা সবুজ মায়াময় লাবণ্যের বর্ণনা, বিরাট যৌথ পরিবারের সম্পর্কের মাধুর্য ও মান-অভিমান। কবিগান, কথকতা, যাত্রাপালার নানা প্রসঙ্গ।

Advertisement

ধান কাটার মরসুমে যে উৎসব তৈরি হল কিসানদের মধ্যে, তাঁরাও নানা বর্ণের মানুষ। ‘ছোট জাত’-এর এই মহল্লায় মর্যাদা পান না মুসলমান কৃষকেরা, যদি পেতেন তবে এই উৎসব হয়ে উঠতে পারত অনাবিল। মুসলমান কিসানরা তাঁদের অমর্যাদাকে নীরবে স্বীকার করে নৌকাগুলোকে বেঁধে রাখেন একটু দূরে। এই দূরত্বই এক দিন বাঙালি জীবনে নিয়ে আসবে মহাবিপর্যয়। তবে সে দিন আসতে তখনও অনেক দেরি।

এই গ্রন্থের কাহিনি শুরু হয়েছে ১৭৭৭ সাল থেকে। সে সময় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে নমঃশূদ্র চাষিদের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল সুন্দরবনের গভীরে, খুলনা-বরিশালের আরও দক্ষিণে, এমনকি দুর্গম দ্বীপেও। লেখক তাঁদের বলেছেন কৃষিশিল্পী। শিল্পীর মর্যাদা কে-ই বা কবে দিয়েছে তাঁদের? কিন্তু শিল্পী না হলে কি বশ মানতে না চাওয়া ওই জমিকে আত্মীয়তায় বেঁধে ফেলা যায়? বসতি গড়ে তোলা যায় এত মমতায়, যেখানে ধু-ধু বিল আর শ্বাপদসঙ্কুল ঘন অরণ্য?

Advertisement

অনেক ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে তাঁরা একটা জনপদ গড়ে কয়েক পুরুষ ধরে বাস করছিলেন। কিন্তু সেখানেও ছিল বর্ণহিন্দুর শাসন। তাঁরা নামমাত্র পারিশ্রমিকে ব্রাহ্মণ কায়স্থকে পরিষেবা দিতে বাধ্য হতেন। লেখাপড়া শেখার কোনও সুযোগই তাঁদের ছিল না।

উচ্চবর্ণের সীমাহীন শোষণের বিরুদ্ধে আমরা জ্বলে উঠতে দেখি নমঃশূদ্র সমাজের প্রতিনিধি উজানতলির মানুষ বিধু মণ্ডলকে। স্বজাতির ছেলেমেয়ের জন্য একটা স্কুল খুলতে উদ্যোগী হন তিনি। কিন্তু ভারতের রাজনীতি তখন উত্তাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা, গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, মুসলিমরা চাইছেন পৃথক বাসভূমি; অস্পৃশ্যরা চাইছেন মানবিক মর্যাদা, চাইছেন জমির অধিকার, শিক্ষা ও চাকরির অধিকার, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশগ্রহণের অধিকার। স্কুল গঠনের কাজেও নানা বাধা আসে। নিচুতলার এই মানুষগুলো বিদেশি শাসনের থেকেও ভয় করেন উচ্চবর্ণের মানুষের শাসনকে। বিধু মণ্ডলেরা জানেন, দেশ স্বাধীন হয়ে উচ্চবর্ণের হাতে ক্ষমতা গেলে নিম্নবর্ণের উপর পীড়ন আরও বাড়বে। গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তাঁরা গলা মেলাতে পারেন না।

প্রতিবাদী চরিত্রের বিধু মণ্ডল শুধু যে স্বজাতির স্বার্থের কথাই ভাবেন, এমন নয়। স্বজাতি যখন অন্যায় করে, তাকেও ছেড়ে দেন না তিনি। ‘নেড়ে’ অর্থাৎ মুসলমানের মাথায় পা ঘষলে পায়ের কড়া সেরে যাবে, এই বিশ্বাস নিয়ে এক জন পা ঘষছিল এক দরিদ্র মুসলমানের মাথায়। ক্রোধে ফেটে পড়েন তিনি তা দেখে। পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন নমঃশূদ্র মানুষটিকে সেই মুসলিম মানুষটির কাছে।

নিচু জাতের মানুষদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে গাঁধী সুভাষ অম্বেডকর যোগেন মণ্ডল শ্যামাপ্রসাদ প্রসঙ্গ, আসে দেশভাগ প্রসঙ্গ। দেশভাগ অবিশ্বাস্য লাগে বেশির ভাগ নিচুতলার মানুষের কাছে।

তবু একেবারে হাত ধরাধরি করে আসে দেশভাগ, দাঙ্গা। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। হিন্দুরা ভারতের পথে পা বাড়ায়, সামনে অনিশ্চয়তা জেনেও।

নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের গৌরবের জায়গা হল উজানতলির কলেজে পড়া ছেলে কাজল। বিধু মণ্ডলকে হতাশ করে সে-ও ভারতে চলে গেল। গ্রাম ছেড়ে যেতে যত কষ্টই হোক, তার কিন্তু মানুষ সম্বন্ধে বিশ্বাস টলেনি। মহাকালের অমোঘ নিয়ম সে মেনে নেয়। ইতিহাসের অনিবার্যতায় এমন করেই দেশ ভাঙে, গড়ে। শাসন-শোষণ বদলে যায়। জন্ম হয় নতুন সভ্যতার। তার কানে বাজে কালু মিয়ার জারি গানের সুর— “হিন্দুমুসলমান এক জাত ভাই একই দ্যাহের দুইডা হাত/ কেউ কারু নয় শত্তুর রে ভাই, দুয়ে দুয়ে মিত্তির হয়।/ ওভাই পরের কথায় পরের ভরসায় ছাইড়ো না দ্যাশ মাথা-খাও।”

কাজল ভারতে এসে যা দেখল, তার খানিকটা বোঝা যাবে ধীরা পরামানিকের কথায়, “কেমন স্বাধীনতাডা পাইলাম, মানুষ গুলান বিলাই কুত্তার মতো মইরা যায়, কিচ্ছু করার নাই আমাগো।” তবে ‘ছোট জাত’-এর অদম্য প্রাণশক্তি। তারা মরতে মরতেও উঠে দাঁড়ায়। জমি দখল করতে গিয়ে মারে, আবার মার খায়। এক চিলতে জমি পেলে ঘর বাঁধে। ঘরের বেড়া আর চাল বেয়ে ওঠে সবুজ শাকপাতা। বেশ বোঝা যায়, ‘ছোট জাত’-রা বাঁচতে চলেছে। গ্রামে থাকতে মেয়েরা থাকতেন অন্তঃপুরে। এখন তাঁরা বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে উপার্জনে অংশগ্রহণ করছেন। মান-সম্মান বাঁচাতে হাতে তুলে নিতে পারেন দাঁ, বঁটি বা জ্বলন্ত চ্যালা কাঠ।

উজানতলির উপকথা
কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর
৫৫০.০০
গাঙচিল

পায়ের তলার মাটি একটু শক্ত হতেই ‘ছোট জাত’-এর এই মানুষরা শুরু করেন দেশে ফেলে আসা কিছু উৎসব। দেশের মতো করেই বারুণী মেলার আয়োজন হয় ঠাকুরনগরে। তাতে যোগ দেন বাস্তুহারা মানুষরা। তাঁদের গানে ঘুরে ঘুরে আসে উনিশ শতকের দু’টি মানুষের নাম, গুরুচাঁদ ও হরিচাঁদ। এঁরা নমঃশূদ্রদের দিয়েছিলেন নতুন পথের দিশা। “আমায় ছুঁস না লো প্রাণ সজনী/ আমার জাত মেরে রেখেছে ঘরে, হরিচাঁদ গুণমণি।।”

নতুন পল্লির শিক্ষক বিরাজ বল উদ্বাস্তুদের জন্য স্কুল তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য স্বদেশহারা নতুন পল্লির বাসিন্দাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন এক চাষি, যিনি নিজে উদ্বাস্তু নন। স্কুলের জন্য এক বিঘে জমি দিতে আগ্রহী আবু মিয়াও বিরাজ বলের স্বপ্নের শরিক।

যাত্রা দেখতে সাত গাঁয়ের মানুষ এক হয়। ‘রূপবাণ’ যাত্রায় ঘটি বাঙাল কাছাকাছি বসতে বাধ্য হয়। বসে কিন্তু ভাব হয়ে যায় ঘটি ও বাঙাল দুই বৃদ্ধার।

এ ভাবেই অনেক হারিয়ে কিছু পেয়ে বেঁচে থাকার পথ পায় এই প্রান্তিক মানুষরা। বেঁচে থাকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement