Krishna Bose

বহুমাত্রিক বিশ্ববীক্ষার প্রতিফলন

প্রথম প্রবন্ধ ‘ঈশ্বরের সন্ধানে’-তে লেখিকার আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ পেয়েছে। প্রেমানন্দ মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণটি খুবই আকর্ষণীয়।

Advertisement

সুরঞ্জন দাস

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:৪১
Share:

প্রবন্ধ সংগ্রহ ১৯৫১-২০২০
কৃষ্ণা বসু
১১০০.০০

Advertisement

আনন্দ

কৃষ্ণা বসু, ঘনিষ্ঠ মহলে যাঁর পরিচিতি কৃষ্ণাদি নামে, ছিলেন এক সফল শিক্ষা প্রশাসক, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় সাংসদ এবং মনোযোগী পর্যবেক্ষক। তাঁর নিবন্ধের এই সুসম্পাদিত সঙ্কলনে ১৯৫১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে লেখা ১০৬টি নিবন্ধ। নিবন্ধগুলি মূলত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়, তবে কয়েকটি ইংরেজি লেখার বাংলা অনুবাদও এখানে সঙ্কলিত।

Advertisement

প্রথম প্রবন্ধ ‘ঈশ্বরের সন্ধানে’-তে লেখিকার আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ পেয়েছে। প্রেমানন্দ মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণটি খুবই আকর্ষণীয়। প্রেমানন্দ মহারাজ লেখককে বলেছিলেন, “ঘণ্টা নেড়ে ঠাকুরঘরে বসে পুজো করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। তোমার কাছে পড়াশোনাই পুজো।” মানুষের মধ্যে ঈশ্বরসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই কৃষ্ণাদি ছিলেন আজীবন সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী।

এই অধ্যায়ে ১৯৭৯, ২০০২ এবং ২০০৫ সালে কৃষ্ণা বসুর তাইপেই ভ্রমণের স্মৃতিচিত্র রয়েছে। ‘সৈনিক স্মৃতি’ নিবন্ধটি আবিদ হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা। এই নিবন্ধে যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে গড়ে ওঠা আজ়াদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে নেতাজির প্রথম সাক্ষাৎ, তাঁর নেতৃত্বগুণ, সহযোদ্ধাদের প্রতি মমত্ববোধ এবং জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয়তাবোধ সঞ্চারিত করার ক্ষমতার পরিচয় আছে।

নেতাজির সামাজিক ভেদাভেদের বিরোধিতার প্রমাণ পাই, যখন নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার শর্তে তিনি সিঙ্গাপুরের চেট্টিয়ার মন্দিরে যেতে রাজি হন। আবিদ এক বার নেতাজির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় কী? নেতাজির তাৎপর্যপূর্ণ জবাব ছিল, ‘নির্বাসিতের জীবন’।

‘এক নম্বর বাড়ি’ নিবন্ধে কৃষ্ণা বসু ১ উডবার্ন পার্কের বাড়ির দিনগুলোতে ছোট পরিবার থেকে এসে একান্নবর্তী সংসারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টার কথা বলেছেন। নেতাজি রিসার্চ বুরোর কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গের পাশাপাশি এসেছে, যে গাড়িতে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণ, সেই ওয়ান্ডারার গাড়িতে চড়ে ঘোরার স্মৃতি।

সঙ্কলনের দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে কলেজজীবনের স্মৃতি। শিক্ষক-ছাত্রের নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্ক, অস্বাস্থ্যকর ক্লাসঘর, জ্ঞানের খোঁজে নয় বরং পরীক্ষা পাশের জন্য পড়া মুখস্থর চাপের প্রসঙ্গ। আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার পুনরুজ্জীবনে অবনীন্দ্রনাথের অবদান, তরু দত্তের সাহিত্যসৃষ্টি এবং আমেরিকার শিল্পকলায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে নিবন্ধে কৃষ্ণাদির গভীর উপলব্ধির পরিচয়। ‘আমেরিকান চরিত্রচর্চা’ নিবন্ধে বুঝি, সে দেশে শিশুদের প্রতি স্নেহ, পরিবারে মহিলাদের গুরুত্ব, ছেলেমেয়েদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার সুযোগ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ও দেশের বর্ণবৈষম্য বাস্তব সত্য— আবার সমাজের গতিশীলতাও তাঁর নজর এড়ায়নি।

সঙ্কলনের তৃতীয় পর্বে রয়েছে তিনটি কবিতা। ‘সুভাষচন্দ্রের প্রতি’ কবিতাটি নেতাজির আদর্শের প্রতি তাঁর আনুগত্যের পরিচায়ক। ‘উডবার্ন পার্ক হইতে বিদায়’ কবিতাতে জাতীয় স্বার্থে উডবার্ন পার্কের বাড়ি অধিগ্রহণের ফলে বাড়ি ছাড়ার বেদনা ফুটে উঠেছে। প্রকৃতিপ্রীতির পরিচয় পাই ‘সৃষ্টির অপব্যয়’ কবিতাটিতে।

চতুর্থ পর্বের ২৩টি নিবন্ধের সব ক’টিই নেতাজি-সংক্রান্ত। বাসন্তী দেবীর স্মৃতিতে সুভাষচন্দ্রের কথা, ‘ইন্ডিয়া অ্যাট ক্রসরোড’ সম্পর্কে তাঁর প্রথম ধারণার কথা, ১৯৪৩ সালে নেতাজি যেখানে পা রেখেছিলেন, সেই আন্দামানে আবেগের যাত্রার কথা বলেছেন কৃষ্ণা বসু। মণিপুর ভ্রমণের কথা বলতে গিয়ে ইম্ফলের যুদ্ধক্ষেত্রের অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। ঝাঁসি রানি রেজিমেন্টের সাহসিকতা, নেতাজির সহযোগী মুহম্মদ কিয়ানি, আকবর শাহ এবং কর্নেল সেরিল জন স্ট্রেসি আর নেতাজির স্ত্রী এমিলির সঙ্গে তাঁর কথা থেকে উঠে এসেছে অনেক অজানা তথ্য। ‘রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র’ নিবন্ধে দুই ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক গভীর শ্রদ্ধার কথা আছে। ‘নেতাজি ও নেহরু’ নিবন্ধটি দু’জনের অমীমাংসিত সংঘাতের দিক তুলে ধরেছে: “এঁরা দু’জনে একসঙ্গে কাজ করতে পারলে কী হত আজ অনুমানসাপেক্ষ।”

১৯১৬-য় প্রেসিডেন্সি কলেজের অপ্রীতিকর সেই ঘটনার পরেও সুভাষের প্রতি ইংরেজির অধ্যাপক ওটেনের কতটা গভীর শ্রদ্ধা ছিল, সেটা তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি। নারী-অধিকারের প্রতি নেতাজির দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে কৃষ্ণাদি লিখেছেন, “মেয়েদের জন্য নেতাজি ঘরেবাইরে একটা আদর্শ জীবন কামনা করেছিলেন।” একটি নিবন্ধে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে জড়ানোর ব্যাপারে নেতাজির তীব্র আপত্তির কথা রয়েছে, যা বর্তমান সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক।

১৯৭৯ সালে কৃষ্ণা বসু জাপানের রেনকোজি মন্দির পরিদর্শন করেন। এই মন্দিরে যে পুরোহিতের হাতে নেতাজির ভস্মাধার তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে শিশির বসুর সাক্ষাৎ হয় ১৯৬৫ সালে। জওহরলাল নেহরুর পরে শিশির বসুই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যাঁর জন্য চিতাভস্মের বাক্সটির ঢাকনা খোলা হয়েছিল। নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি বলে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা এ নিয়ে কী বলবেন, তা অবশ্য জানা নেই।

সঙ্কলনের পঞ্চম পর্বের নিবন্ধগুলি শেষ জীবনের স্মৃতিচারণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতাজি রিসার্চ বুরোর সক্রিয়তা, ১৯৯৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্‌যাপনে মধ্যরাতে সংসদের ঐতিহাসিক অধিবেশনের কথা, ১৯৬৭ সালে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য ধাক্কা খাওয়ার কথা কৃষ্ণাদি স্মরণ করেছেন। স্মরণ করেছেন ইন্দিরা গান্ধী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, এ পি জে আবদুল কালাম, জয়ললিতা এবং পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গিরের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা। একই সঙ্গে আমরা পাই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী, লিবিয়ার লেখক হিসহাম মাতারের ইন দ্য কান্ট্রি অব মেন এবং স্বামী চেতনানন্দের লেখা সারদা দেবীর জীবনীর সমালোচনা।

আট বছর লোকসভার সাংসদ হিসাবে কৃষ্ণা বসু দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা রয়েছে সঙ্কলনের ষষ্ঠ পর্বে। আইনসভার ভিতরে-বাইরে রাজনীতিকদের মানের অবক্ষয় নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছেন। রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার সূত্রে অবদমিত সামাজিক হতাশা তুলে ধরেন তিনি। নির্ভয়া কাণ্ডের প্রতিবাদকে দেখেছেন যৌন অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতীয় মহিলাদের সঙ্কল্প হিসাবে।

মহিলা সংরক্ষণ বিল আইনে পরিণত না হওয়ার জন্য ক্ষোভ প্রকাশের পাশে তিনি একে সংসদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন বলে মনে করেছেন। সাংসদ তহবিলের টাকা খরচের পথে আমলাতান্ত্রিক বাধা নিয়ে তাঁর উষ্মা প্রকাশ পেয়েছে। অপরাধ দমনে মৃত্যুদণ্ড প্রসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন: “মৃত্যু কি যথার্থই কোনও শাস্তি? মৃত্যু তো এক ধরনের মুক্তি।”

এই পর্বের নিবন্ধগুলিতেই কৃষ্ণাদি তরুণ প্রজন্মের আত্মকেন্দ্রিকতা, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, শিক্ষাক্ষেত্রের রাজনীতিকরণ, দলিত সমস্যা সমাধানে ঐকান্তিক চেষ্টার অভাব, সন্ত্রাসবাদ, আধার-প্যান কার্ড বা কেওয়াইসি চাওয়ার নামে গোপনীয়তার অধিকারে হস্তক্ষেপ, নোটবন্দি এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রতিবাদ ন্যায্য হলেও হিংসার পথ নেওয়ায় তাঁর আপত্তি ছিল। কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে সাধারণ কাশ্মীরিদের মন জয় করতে ভারতীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার যোগসূত্রটি তিনি যথার্থ ভাবেই চিহ্নিত করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের নাম পাল্টে ‘বাংলা’ এবং ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ করার ভাবনার তিনি সমর্থক। গণতন্ত্রে বিরোধীশূন্য ধারণা তাঁর কাছে ‘বেমানান’। সঙ্কলনের অন্তিম পর্যায়ে আছে কৃষ্ণা ও শিশিরকুমার বসুর জীবনের শেষ দু’টি লেখা। কৃষ্ণা বসু নেতাজির দুই সহযোদ্ধা— আবিদ হাসান ও আকবর শাহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শিশিরকুমারের প্রবন্ধে পাই ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জাতি গঠনের সমস্যার সূক্ষ্ম আলোচনা।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি স্নেহের কথা কৃষ্ণা বসু নির্দ্বিধায় বলেছেন। তাঁর নেতৃত্বগুণ, মানুষের প্রত্যাশা উপলব্ধি করার ক্ষমতা ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা লেখিকার প্রশংসা কুড়িয়েছে। নির্ভীকতাকে মমতাদেবীর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত করেছেন কৃষ্ণাদি।

এই প্রবন্ধ সংগ্রহ কৃষ্ণা বসুর বহুমাত্রিক বিশ্ববীক্ষার প্রতিফলন। সঙ্কলনের সম্পাদক সুমন্ত্র বসু ঠিকই বলেছেন, “বাংলা ভাষার এমন স্বচ্ছ সাবলীল প্রয়োগ খুব কমই দেখা যায়।” গ্রন্থশেষে কৃষ্ণাদির লেখা বইয়ের তালিকাটি খুবই মূল্যবান। তবে তাঁর একটি কালানুক্রমিক জীবনরেখা থাকলে হয়তো আরও ভাল হত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement