review

গাঁধী-ইতিহাসে নতুন যোগ

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২১ ০৬:৩০
Share:

ইসলাম ধর্ম বিষয়ে গাঁধী কী ভাবতেন, তা নিয়ে বেশ কিছু বইপত্র থাকলেও ইসলামি দেশগুলির প্রতি গাঁধীর মনোভাব নিয়ে বেশি আলোচনা দেখা যায় না। আবদুলনবি আলশোয়ালার বইটি তাই গাঁধী-চর্চায় নাম রাখতে সমর্থ হবে। ভারতের বহির্দেশীয় নীতি বিষয়েও বইটি জরুরি পাঠ্য। কেননা গাঁধীর দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদেশ-ভাবনার প্রসঙ্গে তাঁর সহকর্মী, উত্তরাধিকারী জাতীয়তাবাদী নেতাদের মতামতও আলোচিত হয়েছে— বিশেষত জওহরলাল নেহরুর কথা বার বারই এসেছে। স্বাধীন দেশের বিদেশনীতি কী ভাবে স্থির হচ্ছিল, গাঁধী এবং নেহরুর ভাবনার মধ্যে কতখানি দূরত্ব ছিল, সেই দূরত্ব কি কেবল প্রায়োগিক নীতির ক্ষেত্রে, না কি আদর্শ ও দর্শনের ক্ষেত্রেও— এ সব আলোচনাও আছে বইটির পরিসরের মধ্যে।

Advertisement

সূচিপত্র বলে দেয় বইটির পরিসর কতখানি বড়। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন মুসলিম এবং ইহুদিদের সঙ্গে গাঁধীর অনেকখানি পরিচয় হয়। সেই অভিজ্ঞতা মূল্যবান, কেননা তার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী কালে আরব দুনিয়া বিষয়ে গাঁধীর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। গাঁধীর ইসলাম প্রীতি নতুন করে বলার কিছু নয়। তবু মুসলমানদের মধ্যেও তাঁর বিষয়ে কিছু সংশয় ছিল। তাঁর মতামতের হিন্দু ধর্মের উল্লেখ ও অনুষঙ্গ মিশে থাকত বলেই সেই সংশয়। আর একটি কথা: মুসলমান সমাজকে গাঁধী যেন সমসাত্ত্বিক বা হোমোজেনাস হিসাবে দেখতেন— তাদের মধ্যে গোষ্ঠীভেদ, স্বার্থভেদের বাস্তব অনেক সময় ঊহ্য থাকত। আলশোয়ালা মনে করিয়ে দেন, গাঁধী আরব ভূখণ্ডে ইহুদি বাসস্থানের বিষয়ে সহানুভূতিশীল ছিলেন না। একাধিক ইহুদি নেতা তাঁকে নিজেদের দিকটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু “দীর্ঘ কথোপকথনের পর আমি আমার মত পাল্টাতে পারতাম না।” (গাঁধী) তাঁকে সঙ্কটেও পড়তে হত এই জন্য— বেশ কিছু ইহুদি নেতাই তো ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বড় সমর্থক।

গাঁধী: হিজ় এনগেজমেন্ট উইথ ইসলাম অ্যান্ড দি আরব ওয়ার্ল্ড
আবদুলনবি আলশোয়ালা
৫৯৫.০০
রুপা

Advertisement

বইটির একটি সমস্যা অবশ্য এর বিস্তৃত পরিসরটিই। এত রকম ঘটনা ঢুকে পড়েছে গাঁধী-আলোচনার পাশ দিয়ে, যাতে আলোচনার সংহতি কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। নেহরু আমলের বিদেশনীতির পর্যালোচনা বা দেশভাগের পশ্চাৎপট বিশ্লেষ‌ণ এতখানি জায়গা না নিলেও পারত। আরও এক সমস্যা রয়েছে আলোচনার সময়বিন্যাসে। পাকিস্তান আন্দোলনের পরেই যখন চলে আসে জালিয়ানওয়ালা বাগের বিবরণ, পাঠকের সমস্যা হতেই পারে। বইটির অন্যতম গুণ এর সহজবোধ্যতা। অনেক পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছতে পারার ভাষা ও ভাব লেখকের আয়ত্ত, আজকাল ইতিহাস-চর্চার দুনিয়ায় যা ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই ইতিহাসের বিন্যাসেও সেই পাঠ-সুবিধার বিষয়টি মাথায় রাখলে ভাল হত বলে মনে হয়। তবে সব মিলিয়ে, গাঁধীবিষয়ক বইয়ের বিপুল সম্ভারের মধ্যে বইটি আলাদা স্থানের দাবিদার।

মহাত্মা গাঁধী আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দুই জনেই দৃঢ় ভাবে মনে করতেন, ভারতবর্ষকে জানতে হলে ভারতের মানুষকে চেনা জরুরি, তার রাজা-রাজড়া-শাসকদের নয়। “শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-’পরে” যে সব মানুষ কাজ করে, হাল ধরে, দাঁড় টানে, তাদের নিয়ে আসা দরকার ভারত-ভাবনার কেন্দ্রে। হিন্দ্ স্বরাজ-এ গাঁধী বলেছিলেন, দেশের ইতিহাস বলে যা শেখানো হয় সেটা আসল ইতিহাস হতে পারে না। এ দেশ আসলে যাদের, তাদের এক জন হওয়ার সাধনায় অনেক পথ হেঁটেছিলেন গাঁধী, পোশাকে, জীবনযাপনে, রাজনীতিচর্যায়। একই সঙ্গে এত পূর্ণ এবং এত অনিঃশেষ সেই সাধনা যে ১৯৪০-এ বলেছিলেন, “আই বিলং টু এভরিবডি অ্যান্ড বিলং টু নান।” গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথ এই ভাবনায় মিলেছিলেন বলে কি ১৯৪৫ সালে শান্তিনিকেতনে গাঁধী বলেন, অনেক মতপার্থক্যের পথ বেয়ে এসে তাঁর উজ্জ্বল আবিষ্কার যে, তাঁদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে ‘কোনও পার্থক্যই ছিল না’?

টেগোর অ্যান্ড গাঁধী: ওয়াকিং অ্যালোন, ওয়াকিং টুগেদার
রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়
৬৯৯.০০
আলেফ

কোথায় তাঁরা মিলেছিলেন, আর কোথায় মেলেননি? কেমন ছিল তাঁদের মতৈক্য ও মতপার্থক্যের যাত্রা? রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়ের এই বইতে সেই ‘যাত্রা’র সন্ধান আছে— আছে সেই হদিস যে, কোনও কোনও পথে তাঁরা কেবল িনজেরা আলাদা হয়ে যাননি, সকলের থেকেই আলাদা হয়ে গিয়ে প্রায় একাকী হেঁটেছেন, নিজের নিজের সত্যের দিকে। ১৯০০ সালে যখন ভারত নতুন রাজনীতির যুগে প্রবেশ করছিল, তত দিনে দুই মহাচিন্তকের চিন্তার জগৎ অনেকখানি তৈরি হয়ে গিয়েছিল— এর পর কেবল তাঁরা নিজস্ব রেখায় এগিয়ে গিয়েছেন। দু’টি পথ হয়তো মেলার কথা ছিল না, কেননা তাঁদের দুই জনের উৎস, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, নৈতিক ভাবনায় ছিল বড় বড় ফারাক।

গাঁধী আর রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে এই প্রথম বই লেখা হল না। কিন্তু ইতিহাসের গতির সঙ্গে মিলিয়ে তাঁদের অভিযাত্রাটিকে বোঝা, পারস্পরিক মতপার্থক্যকে দেখা— এ অভিজ্ঞতা সুলভ নয়। ব্যক্তি-সম্পর্কের ইতিহাস লিখতে গিয়ে অনেক সময় বৃহত্তর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটি গৌণ হয়ে পড়ার একটা বিপদ থাকে। রুদ্রাংশু এর আগে জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কের উপর লেখা বইটিতে দেখিয়েছেন কী ভাবে সেই বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতকে চলমান ধরে রেখে অর্থপূর্ণ ভাবে ধরা যায় তারকা-ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক বিনিময়কে। ওই একই ইতিহাস-ধারায় নতুন যোগ হল এই সুলিখিত বইটি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement