মাই নেম ইজ় রঘুরাম রাজন। আই ডু হোয়াট আই ডু।’ খবরের কাগজে এই উদ্ধৃতি পড়ে মনে হয়েছিল, কলার-তোলা ঔদ্ধত্য। রাজন তাঁর বইয়ে (যা ভাবি তাই করি, আনন্দ পাবলিশার্স, ৬০০.০০) জানিয়েছেন, নেহাত আত্মরক্ষার কৌশল ছিল কথাটা। সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন এক সাংবাদিক— সেই অবস্থায় কেটে বেরোনোর মরিয়া চেষ্টার ফল এই উদ্ধৃতি, যা পরে তাঁর বইয়ের শিরোনাম হল! ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তিন বছর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে ছিলেন। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে। তখন ভারতীয় অর্থব্যবস্থা টলোমলো। কী ভাবে রাজন অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন দিককে দেখলেন, তার উদাহরণ এই বইয়ে সঙ্কলিত বক্তৃতা-নিবন্ধের পাতায় পাতায়। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ভারতের আর্থিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন সহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক সম্ভ্রমবোধ।
গনগনে রোদে তপ্ত হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে আশীর্বাদের মতো আসে গাছের ছায়া, ধুলো-ওড়া পথের শেষে টলটলে দিঘিটি দেখা দেয় অহৈতুকী কৃপার মতো। তেমনই এই রুক্ষ সময়ে জয়া মিত্রের কলম স্নিগ্ধ আশ্বাসের মতো ছুঁয়ে যায় প্রাণ। (আমাদের চরাচর, সৃষ্টিসুখ, ১৬০.০০)উদ্বেগের কথাই লেখেন তিনি, লেখেন ভয়, হতাশার কথা। নদীকে গ্রাস করছে মানুষ, প্লাস্টিক প্রবেশ করছে সাগরতলের জীবের শরীরে। কিন্তু সে সব কথাই আসে তাঁরই কলামের ‘আকাশকামিনী’ নদীর মতো স্বতঃস্ফূর্ত ধারায়। দু’রকম প্রতিবেশিতার কথা মূর্ত হয়ে ওঠে— চারপাশের গাছ-পাহাড়-নদীর সঙ্গে, আর অন্যটা পূর্বজদের সঙ্গে। দেড়শো বছর আগে আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের এক গোষ্ঠীপতি সে দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখেছিলেন, ‘সাদা মানুষেরা যে বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় তার দিকে মন দেয় না। ... লাল লোকেদের কাছে বাতাস পবিত্র আর মূল্যবান, কেন-না প্রাচীন সব মানুষ গাছ জন্তু সবাইকার নিঃশ্বাস এই একই বাতাসের মধ্যে ধরা আছে।’ এই কলামের লেখাগুলিতে এমনই চিরজাগ্রত কিন্তু বিস্মৃত প্রতিবেশীদের ঘোরাফেরা।
পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যে দুই বালিকার কথা, এক জন অবহেলিত কন্যা, এক জন ‘হিংসুটি’। একাদশ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যে মাদার টেরিজার নোবেল বক্তৃতা, যেখানে তিনি গর্ভপাতকে ‘চরম পাপ’ বলে নিন্দা করছেন। এ ভাবেই কি স্কুল গড়ে দিচ্ছে না লিঙ্গ-বৈষম্যের ধারণাকে? যখন ছাত্র পড়ে গিয়ে কাঁদলে শিক্ষক বলেন, ‘ছেলেরা কাঁদে না,’ যখন মেয়েদের টয়লেটে নোংরা মন্তব্য লেখার জন্য ছাত্রদের শাসন না করে বিষয়টা উপেক্ষা করেন, তখনও এ ভাবেই পুরুষ-নারী বিভাগ শক্ত হয়। স্টাফরুম আর ক্লাসরুম দুটো জায়গাতেই তরুণী শিক্ষিকাদের মোকাবিলা করতে হয় সাবেকি পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার। ‘জেন্ডার’-এর ধারণার সঙ্গে স্কুলের বোঝাপড়া নিয়ে এই মূল্যবান সংকলন, সহজ আলাপে ইস্কুলে জেন্ডার (এবং আলাপ, ১৫০.০০)। অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন নানা জেলার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সম্পাদনা শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত এবং চান্দ্রেয়ী দে।
ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সুশাসন প্রবর্তনের পরিকল্পনাও ছিল গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলির। এই পরিকল্পনারই অঙ্গ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন। শুধু ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের প্রশিক্ষণ নয়, এই কলেজ ঘিরে উনিশ শতকের সূচনায় বিশেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে এক অভিনব তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি, গবেষকদের মতে, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্ভবত ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ প্রোথিত ছিল। ওয়েলেসলির মূল পরিকল্পনা যদিও সফল হয়নি, তবু যেটুকু হয়েছিল তাই নিয়েই বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করেছেন নিখিল সুর (ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, আনন্দ, ২৫০.০০)। কলেজ প্রতিষ্ঠা, ছাত্র-শৃঙ্খলা, গ্রন্থাগার, ভাষা শিক্ষা, অস্তিত্বের সঙ্কট ও উইলিয়াম কেরির ভূমিকা, সব দিকই সযত্নে আলোচনা করেছেন তিনি।
শহরের গজদন্ত মিনার থেকে নয়, বাংলার গ্রামীণ সম্পদকে তারাপদ সাঁতরা দেখেছিলেন অন্দরমহল থেকে। চরম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে তিনি একদম নিচু তলার আর্থ-সামাজিক স্তর থেকে আন্তর্জাতিক সারস্বত ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন সগৌরবে, তারাপদ সাঁতরা রচনা সংগ্রহ ১ম খণ্ডের (রাঢ় প্রকাশনী, ৬৫০.০০) প্রাক্কথনে লিখেছেন দেবাশিস বসু। বাংলার লৌকিক সম্পদের প্রায় প্রতিটি শাখাই ছিল তাঁর অভিনিবেশের বিষয়। সংগ্রহশালা সংগঠন করেছেন, ‘কৌশিকী’
পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের তিনি প্রণেতা। রচনাবলির প্রথম খণ্ডে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রচনা সঙ্কলিত।
‘‘ভোট দেওয়ার অধিকার স্বাধীনতার চরম উৎকর্ষ নয়, স্বরাজের নিদর্শন নয়,... ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও জাতি আপন আপন স্বাধীনতা, বিশিষ্টতা ও বৈচিত্র্য বজায় রেখে পরস্পরের সাহায্যে পূর্ণতা লাভ করতে পারে এবং পরিণামে নিখিল বিশ্ব-মানবের সঙ্গে সখ্য ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, এমন যে বিধান, সেই হল প্রকৃত স্বরাজ।’’ চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) দীর্ঘ এই অভিভাষণ, ‘স্বরাজ কোন্ পথে’, প্রকাশ পেল দেশবন্ধু গ্রন্থাবলী-তে (অরুণা প্রকাশন, ৫৯৫.০০)। ‘‘দেড়শো বছরের জন্মজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁকে নতুন করে ফিরে দেখার তাগিদেই এই ‘দেশবন্ধু গ্রন্থাবলীর’-র প্রকাশ।’’ ভূমিকা-য় জানিয়েছেন সনৎ নস্কর। দেশবন্ধু রচিত কাব্য, গল্প, প্রবন্ধ, বক্তৃতাবলির সমাহারে তৈরি এ-গ্রন্থ তাঁর মননের সামীপ্যে পৌঁছে দেবে।
বিদ্যাসাগর সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন ‘‘তিনি পড়ার বই নূতন করিয়া লিখিয়াছেন, সর্ব্বপ্রথম দেখাইয়া দিয়াছেন যে বাঙালীও ইংরেজের মত স্কুল-কলেজ করিয়া চালাইতে পারে, সর্ব্বপ্রথম দেখাইয়া দিয়াছেন যে সংস্কৃত ব্যাকরণ বাংলাতেও পড়ানো যায়, সর্ব্বপ্রথম সুরুচিপূর্ণ বাংলা বই তিনিই লিখিয়াছেন।’’ অসামান্য মানবদরদি বিদ্যাসাগর রাজনীতি-নিস্পৃহ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড, সত্যনিষ্ঠা, সততা কী ভাবে শুধু তাঁর সমসময়ে নয়, আজও বাঙালির জীবনে ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক, সে সবেরই প্রামাণ্য গ্রন্থ এটি (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর/ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, সম্পা: অর্ণব নাগ, অক্ষর প্রকাশনী, ৪০০.০০)। ‘সমসাময়িক দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর’, ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা’, ‘বিদ্যাসাগর: উত্তরকালের মূল্যায়ন’— এই অধ্যায়গুলিতে বিন্যস্ত গোটা বইটির রচনাগুলি। পড়তে পড়তে পাঠক টের পাবেন কী ভাবে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ক্রমশই কালোত্তীর্ণ বা বরণীয় হয়ে উঠেছিলেন। ‘সব মিলিয়ে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর তাঁর ব্যক্তিত্বের যে মিথ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তার আস্বাদ’ পাবেন পাঠক, জানিয়েছেন সম্পাদক অর্ণব নাগ।
প্রবাদপ্রতিম ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের কীর্তিকাহিনি বাঙালি পাঠকের কাছে অজানা নয়। স্রেফ সাইকেলে চেপে এক বাঙালি যুবকের আফগানিস্তান ভ্রমণ, বিশেষ করে সেই ১৯৪০-এ, মস্ত বড় ব্যাপার বইকি! নানা অভিজ্ঞতা, দেশভ্রমণের সঙ্গেই সে দেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকে চেনা, তা-ও আবার বিস্তর প্রতিবন্ধকতার মধ্যে, এটা এ-যুগের প্যাকেজ ট্যুর মানসিকতায় বোঝা খুবই মুশকিল। এই বইটির (আফগানিস্তান, ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, কোরক, ১২৫.০০) ভূমিকায় যথার্থই লিখেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘‘ছাপোষা বাঙালি জীবনে খুশি না থেকে, সাইকেল আর তিনটি মাত্র ভাষা, বাঙলা, হিন্দুস্থানী ও ইংরিজি এই সম্বল করে কেউ চারটে মহাদেশ ঘুরে আসতে পারেন— একথা ভাবতেই অবাক লাগত।’’
এ বঙ্গদেশের বনে-জঙ্গলে জগন্নাথ ঘোষ ঘুরছেন দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে। জঙ্গল-বন্যপ্রাণ-চা বাগান-অজানা হাট-মানবজমিন— কোনও কিছুই নজর এড়ায় না চিরপথিক এই মানুষটির। তাঁর দীর্ঘ যাত্রাপথের কিছু ঝলক ধরা পড়েছে সদ্য প্রকাশিত দু’টি খণ্ডে (বনবাসে বন আবাসে ১ ও ২, ৯ঋকাল বুকস, প্রতি খণ্ড ৫০০.০০)। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের নানা প্রান্তে, বর্ধমান-বীরভূমের রাঢ় মাটিতে নানা ঋতু ও কালে, প্রান্তিক মানুষজনের সঙ্গে সহজিয়া আলাপে নিছক ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, যেন কবিতার পঙ্ক্তির নির্মাণ হয়েছে জগন্নাথের এই দু’টি গ্রন্থের পাতায় পাতায়। দু’টি খণ্ডেই হিরণ মিত্রের অসাধারণ অলঙ্করণ গ্রন্থটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। নিরন্তর এক জীবন-পরিক্রমার কথাই যেন লেখেন জগন্নাথ, ‘এই আমিটার সন্ধানে হাতড়ে বেড়াই সবখানে।’
জলবায়ু বদলাচ্ছে। বিপন্ন পৃথিবীর প্রাণমণ্ডল। এ বিষয়ে প্রবন্ধ পড়া বা বক্তৃতা শোনার পরও আগ্রহী পাঠকের মনে থেকে-যাওয়া প্রশ্নের নিরসন করবে বইটি (জলবায়ু বদলের কী ও কেন, প্রদীপ দত্ত, দিশা, ১৪০.০০)। বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক, আবহাওয়া আর জলবায়ুর তফাত, বিভিন্ন তাপমাত্রার দেশে উষ্ণায়নের তারতম্য কী রকম, এতে বন্যা-খরা বাড়বে বা রোগ ছড়াবে কি না,... এমন নানান প্রসঙ্গ প্রশ্নোত্তরের ঢঙে আলোচনা করেছেন লেখক। তরতরে ভাষায় ফিরে গিয়েছেন একেবারে গোড়ার কথায়, তত্ত্বের জটিলতা কিংবা তথ্যের অনিবার্য ভারকে লঘু না করেও।